কালিজিরা এক প্রকারের মসলার নাম। মসলা হলেও যেন তার মধ্যে লুকিয়ে আছে হাজারো উপকারিতা। বিদ্যমান রয়েছে শতাধিক পুষ্টির উপাদান। তাহলে চলুন জেনে নেই কালিজিরা সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য। বাংলা একাডেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধানে’ উল্লিখিত আছে, ‘কালিজিরা/ কালিজিরা/ [বা.] বি. শীতকালে ফোটে এমন সাদা নীল পীতাভ প্রভৃতি রঙের ফুল বা তার ভেষজগুণসম্পন্ন বীরুৎশ্রেণির উদ্ভিদ যার গোলাকার ফলের কালো বীজ মসলারূপে ব্যবহৃত হয় (আনি. দক্ষিণ ইউরোপ), কালোজিরা’।[1]
ইংরেজিতে যাকে নামকরণ করা হয়েছে, ‘black-cumin’ এবং আরবীতে যাকে বলা হয়, ‘اَلْحَبَّةُ السَّوْدَاءُ’।
চলুন! এবার চিকিৎসকদের নিকট থেকে অবগত হই এর উপকারিতা সম্পর্কে, ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ক্বানুন ফিত তিব্ব’ (Canon of medicine)-এ বলেছেন, কালিজিরা দেহের প্রাণশক্তি বাড়ায় এবং এর মধ্যে শতাধিক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যার মধ্যে ২১ শতাংশ প্রোটিন, ৩৮ শতাংশ শর্করা, স্নেহ পদার্থ ৩৫ শতাংশ এবং বাকি অংশ ভিটামিন ও খনিজ।
আমেরিকার একজন বিখ্যাত ডাক্তার Joseph Mercola যিনি ‘Fat for fuel: A Revolution, The No-Grain Diet’-এর মতো কয়েকটি বিখ্যাত বইও লিখেছেন। কালিজিরা নিয়ে ৬৫০টি রিসার্চ হয় তার অধীনে। এই রিসার্চ সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি বলেন, কালিজিরার মধ্যে ফার্মাকোলজিকাল কমপক্ষে ২০টি উপাদান আছে। তার মধ্যে থাইমোকুইনোন (Thymoquinone) হলো এন্টি-ক্যান্সারের জন্য ব্যবহৃত উপাদান। অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও এর প্রচুর উপকারিতা উল্লেখ করেছেন।
এখন আমরা দৃষ্টিপাত করব রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছের প্রতি-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ عَلَيْكُمْ بِهَذِهِ الْحَبَّةِ السَّوْدَاءِ فَإِنَّ فِيهَا شِفَاءً مِنْ كُلِّ دَاءٍ إِلاَّ السَّامَ.
আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা এই কালো বীজ (কালোজিরা) নিজেদের জন্য ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করে নাও। কেননা, মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের নিরাময় এর মধ্যে রয়েছে’।[2]
আবার অনেকে এ হাদীছের অনুবাদ করেন এভাবে, ‘এই কালো দানা মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ’। কালিজিরার উপকারিতা সম্পর্কে হাদীছে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হল, شفاء যার অর্থ, আরোগ্য, নিরাময়, সুস্থতা। এর কোনো বহুবচন নেই। কিন্তু এর পরপরই আরেকটি شفاء রয়েছে।
যার বহুবচন হচ্ছে, أشفية এর অর্থ হচ্ছে ঔষধ।[3]
আমরা যদি شفاء এর অর্থ, নিরাময় না নিয়ে ঔষধ ব্যবহার করি তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে, কালিজিরা মৃত্যু ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, তাহলে কালিজিরা কি ক্যান্সার রোগের নস্যাৎকারী? এই প্রশ্ন শোনার পর আমরা থতমত খেয়ে বলব, আসলেই তো, ব্যাপার কী? তাই চলুন شفاء শব্দের অর্থ ইংরেজিতে কী ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা দেখে আসি?
এক হাদীছে এর অর্থটা Healing শব্দে ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ- উপশম, নিরাময়।[4] আরেক হাদীছে شفاء এর জায়গায় Remedy শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ, প্রতিকার, প্রতিষেধক।[5]
চলুন আমরা উপশম, নিরাময় প্রতিকার ইত্যাদি শব্দ গুলোর অর্থ সম্পর্কে অবগত হই।
উপশম : শান্তি, নিবৃত্তি, রোগের প্রশমন।[6]নিরাময় : বি. রোগমুক্ত অবস্থা, সুস্থতা। বিণ. নীরোগ; সুস্থ।[7]প্রতিকার : বি. দমন, সংযমন, নিবারণ।[8]
এখন যদি شفاء এর অর্থ, উপশম, নিরাময়, প্রতিকার ধরি, তাহলে কিন্তু এটা ঔষধের সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা, ঔষধ এক বিষয় আর নিরাময় অন্য বিষয়। তাহলে কি আমাদের অনুবাদে সমস্যা? যদি সমস্যাই হয়, তাহলে আমরা কোনটাকে প্রাধান্য দিব?
চলুন, আমরা দুটি অর্থ ব্যবহার করেই ব্যাখ্যা করি। যদি আমরা شفاء এর অর্থ Healing বা উপশম ধরি, তাহলে এর ব্যাখ্যা দাঁড়ায় যে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে কালিজিরা সেবন করলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং কোনো ব্যাধি আমাদের শরীরে আক্রমণ করলে অতি তাড়াতাড়ি লাঘব হবে।
এখন যদি ঔষধ হিসেবে ভাষান্তর করি, তাহলে এর সারমর্ম হচ্ছে, ধরুন কারো ক্যান্সার হয়েছে এবং সে এই মরণব্যাধি রোগের জন্য অনেক চিকিৎসা করেছে কিন্তু এই ব্যাধি কিছুতেই ভালো হলো না। তখন কেউ যদি এই কালিজিরা আল্লাহর উপর ভরসা করে ঔষধ হিসেবে নিয়মিত সেবন করে, তাহলে আল্লাহ হয়তো তাকে আরোগ্য দিতে পারেন।
উপরিউক্ত দুটি অর্থই গ্রহণযোগ্য হতে পারে। অতএব, আমরা যদি নিয়মিত কালিজিরা সেবনে অভ্যস্ত হই, তাহলে রাসূল a-এর সুন্নাহ পালনের সাথে সাথে আমাদের জীবনও সুখকর হবে ইনশাআল্লাহ।
ওমর বিন শফিক
অধ্যয়নরত, ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি ইন্সটিটিউট, উত্তরা, ঢাকা।
[1]. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৩০৩।
[2]. তিরমিযী, হা/২০৪১; ইবনু মাজাহ, হা/৩৪৪৮, হাদীছ ছহীহ।
[3]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, আল মু‘জামুল ওয়াফী, পৃ. ৬০৪।
[4]. English-Bangla dictionary, Bangla Academy, p. 328.
[5]. English-Bangla dictionary, Bangla Academy, p. 605.
[6]. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ২১২।
[7]. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৭৪৩।
[8]. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৮৫৬।