কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

বক্তৃতাও একটি আর্ট

বক্তৃতা একটি শক্তিশালী কৌশল। বক্তৃতা একটি আর্ট। একটি নন্দিত শিল্প। বক্তৃতা হচ্ছে সমবেত জনমণ্ডলীর সামনে কিংবা অডিও ভিজ্যুয়াল অথবা ইন্টারনেট বা অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশেষ বিষয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে উপস্থাপিত সুবিন্যস্ত উক্তি, যার অপর নাম ভাষণ, বক্তব্য বা আলোচনা।[1]

প্রিয় তরুণ বন্ধুরা! আজ আমি বক্তৃতার মুষ্টিমেয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু টপিক নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করব ইনশা-আল্লাহ।

বক্তৃতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : কুরআন মাজীদে ঘোষিত হয়েছে, ﴿خَلَقَ الْإِنْسَانَ - عَلَّمَهُ الْبَيَانَ﴾ ‘তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাকে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন’ (আর-রহমান, ৫৫/৩-৪)। এ বসুন্ধরায় যত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম আগমন করেছিলেন, প্রত্যেকেই অত্যন্ত উঁচু স্তরের বাকশক্তির অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ﴿وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ﴾ ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতীয় ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছি। যাতে তারা তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারে’ (ইবরাহীম, ১৪/৪)। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন,﴿وَشَدَدْنَا مُلْكَهُ وَآتَيْنَاهُ الْحِكْمَةَ وَفَصْلَ الْخِطَابِ﴾ ‘আমি সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাক নিপুণতা’ (ছোয়াদ, ৩৮/২০)। উল্লেখিত আয়াতে ﴿فَصْلَ الْخِطَابِ﴾ এর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, দাঊদ আলাইহিস সালাম অত্যন্ত উঁচু স্তরের বক্তা ছিলেন।[2]

উক্ত আয়াতসমূহ দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, মানবজীবনে ভাষা ও বক্তৃতার গুরুত্ব অপরিমেয়।

বক্তৃতার উপকরণ : বক্তৃতা শিখতে হলে প্রথমত তিনটি জিনিস প্রয়োজন। তা হলো : ১. একটি জিহ্বা। ২. একটুখানি আক্বল। ৩. এক মুষ্টি ইলম। এই তিনটি উপকরণ থাকলেই তুমি একজন বক্তা হয়ে উঠতে পারবে।

বক্তৃতার স্কেল : অনেকে বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রারম্ভেই হাই-স্কেলে (উচ্চকণ্ঠে) কথা বলা শুরু করে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই স্কেলটা বজায় রাখে। কিন্তু, না। গানের যেমন তাল, লয় আছে, ঠিক তেমনি বক্তৃতারও তাল, লয় আছে। অতএব, সেই তাল, লয় ঠিক রেখে বক্তৃতা করতে হবে। অর্থাৎ বক্তৃতার প্রারম্ভে স্বাভাবিকভাবে খানিকটা শান্ত নমিত কণ্ঠে বক্তৃতা শুরু করতে হবে। তারপর যেখানে জোর দিয়ে কথা বলার মতো, সেখানে একটু উচ্চ রবে কথা বলবে। আর কুরআনের আয়াত থাকলে সুমিষ্ট কণ্ঠে সুর দিয়ে তেলাওয়াত করার চেষ্টা করবে‌। বক্তৃতার অন্তিম মুহূর্তে এসে সমস্ত বক্তব্যের মূলভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে‌। কিছুটা আবেগ মিশিয়ে কথাগুলো বলবে‌। আর সমাপ্তি বাক্যগুলো খুব মনোহর ও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করবে। কেননা বক্তৃতার শেষ লগ্নের কথাগুলোই শ্রোতাদের মনে বেশি দাগ কাটে। বক্তৃতার সময় শ্রোতাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথা বলবে।

জড়তা দূরীকরণ : অনেকেই বলে, ভাইয়া! আমার তো বক্তা হওয়ার ইচ্ছা‌, কিন্তু মুখে অনেক জড়তা‌‌। হুম, ভাইয়া! তোমার মতো নবী মূসা আলাইহিস সালাম-এর মুখেও জড়তা ছিল। তজ্জন্য তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট দু‘আ করেছিলেন,﴿رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي - وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي - وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي -يَفْقَهُوا قَوْلِي﴾ ‘হে আমার রব! আমার সিনা খুলে দিন। আমার কাজগুলো সহজ করে দিন এবং আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ (ত্ব-হা, ২০/২৫-২৮)। তো ভাইয়া! এই সুন্দর দু‘আটি থাকতে আর চিন্তা কী?

বক্তৃতার কিছু শৈলী : এবার চলো, একজন ভালো বক্তা হওয়ার সামান্য কিছু কৌশল জেনে নেই। আমাদের দেশের ক্বওমী মাদরাসাগুলোতে প্রতি বৃহস্পতিবার ‘ইছলাহুল বায়ান’ অর্থাৎ ‘বক্তৃতা পরিশুদ্ধকরণ’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। উক্ত অনুষ্ঠান তোমাকে একজন সুবক্তা তৈরি করে তোলায় বিস্তর ভূমিকা রাখে। অতএব, অনুষ্ঠানটিতে নিয়মিত যোগদান করে একটু-আধটু বক্তৃতা করার চেষ্টা করতে পার। বিভিন্ন ওয়ায-মাহফিল, জনসভা অথবা সেমিনারের মঞ্চে ওঠার আগে প্রথম প্রথম বক্তৃতা শেখার একটি চমকপ্রদ শৈলী হলো, কোনো নির্জন প্রান্তরে, প্রভাতে বাড়ির ছাদে, পুকুর বা নদীর ধারে, রাত্রিবেলা বাড়ির সামনের উঠোনে অথবা পড়ন্ত বিকেলে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মন খুলে বক্তৃতা অনুশীলন করা।

একজন সুবক্তার দৃষ্টান্ত : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা সবাই চিনি। তিনি ছাত্র যামানায় পাট ক্ষেতের পাশে গিয়ে পাট গাছগুলোকে শ্রোতা বানিয়ে বক্তৃতা অনুশীলন করতেন। পরবর্তীতে তিনি একজন সুবক্তা হতে পেরেছিলেন। তিনি যে সত্যিই একজন সুবক্তা ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণই তার প্রমাণ বহন করে। যার দরুন লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে উদয় হয়েছিল যুদ্ধজয়ের তামান্না। সকলেই বে-সামাল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। কেড়ে এনেছিলেন বিজয় নামক মহা সাফল্য। আমাদের উপহার দিয়েছিল একটি সোনার বাংলাদেশ।

বক্তৃতা যখন যেমন : বক্তৃতা হচ্ছে একটি অস্ত্র। এ অস্ত্র নিয়ে তোমরা ময়দানে নেমে পড়ো। সমস্ত বাতিলপন্থীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সঠিক ইসলামের বৃক্ষ রোপণ করো। বক্তৃতা আবার কখনো এক খণ্ড রোদ্দুর, যা এঁদো স্যাঁতসেঁতে অবনিকে আলোকিত করে তোলে। কখনো এমন এক আলো, যা ঘন কৃষ্ণ মেঘমালার মধ্য দিয়ে উঁকি দিয়ে খুঁজে দেয় সিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথ। কখনো আবার এক পশলা বৃষ্টি, যা হৃদয়কোণে জমে থাকা ধুলোবালি ধুয়ে মুছে একাকার করে দেয়। মন-মাঝারে বয়ে দেয় ভোর-বিহনের মৃদুল সমীরণের একটা শীতল ঝাপটা।

স্বপ্ন যখন বক্তা হওয়ার : প্রয়াস করো! নিরলস পরিশ্রম করো! একদিন ভালো ও জনপ্রিয় একজন বক্তা হয়ে উঠবেই ইনশাআল্লাহ। তুমি দেখে নিয়ো! সেদিন তোমার মারফত লক্ষ লক্ষ যুবক প্রবেশ করবে ইসলামের গণ্ডিতে। মানুষেরা তাদের মনের মুকুরে জায়গা করে নেবে তোমাকে। আর মহান আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন,﴿وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى﴾ ‘মানুষ যা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে, তাছাড়া কিছুই পায় না’ (আন-নাজম, ৫৩/৩৯)। সুতরাং তুমিও পাবে। শুধু একটু সেক্রিফাইস করো। সাফল্য তোমার পদচুম্বন করবেই ইনশাআল্লাহ। আর হ্যাঁ, জড়তাটাকে কাটাতে﴿وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي﴾ ওয়াজিফাটি পড়তে ভুলবে না কিন্তু!

সাব্বির আহমাদ

অধ্যয়নরত, ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি ইন্সটিটিউট, উত্তরা, ঢাকা।


[1]. মুফতী আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা ও উপস্থাপনা, পৃ. ১৭।

[2]. ইবনু কাছীর, পৃ. ৪২৮।

Magazine