এবার কিছু উদাহরণ আয়িম্মা ও মুহাদ্দিছগণের যুগ থেকে দেখা যাক :
(১) ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ-এর বিখ্যাত ঘটনা : ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ-এর বয়স ছিল ১৫ বছর। এটা ছিল তার ছাত্রজীবনের ঘটনা। এক ব্যক্তির ঘটনা সম্পর্কে ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ-কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, একটা বুলবুল পাখি সবসময় কিচিরমিচির করবে এই শর্তে ক্রয় করা হয়েছে। কিন্তু সেটা দিনের কিছু অংশে কিচিরমিচির করে, সারা দিন করে না। তখন ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ উত্তরে বলেন, সেই পাখিকে ফেরত দেওয়া বৈধ হবে। প্রশ্নকারী ফিরে গিয়ে ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, যদি দিনের বেশিক্ষণ কিচিরমিচির করে, তবে ফেরত দেওয়ার অধিকার নেই। প্রশ্নকারী ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ-কে এই বিষয়ে আবার চিন্তা-ভাবনা করতে বললেন; কিন্তু তিনি বললেন, সেটাই আমার মত, যেটা আমি তোমাকে বলেছি। প্রশ্নকারী বলেন, আপনার একজন সুযোগ্য ছাত্র বলেছেন যে, ফেরত দেওয়ার অধিকার নেই। তখন ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ বললেন, তাকে ডেকে নিয়ে এসো। তারপর ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ-কে উপস্থিত করা হলে তিনি বললেন, তুমি বলেছ, সেটা ফেরত দেওয়ার অধিকার নেই? তিনি বললেন, হ্যাঁ। সেটা তুমি কীভাবে বলছ? তখন ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ ফাতেমা বিনতু ক্বয়েস রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর হাদীছ শুনিয়ে বললেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আবূ জাহাম এমন একজন লোক, যে তার কাঁধ থেকে লাঠি নামিয়ে রাখে না। আর মুআবিয়া গরীব মানুষ, তুমি উসামাকে বিয়ে করে নাও। তিনি এখান থেকে বুঝাতে চাইছেন যে, আবূ জাহাম কাঁধ থেকে লাঠি রাখে না অর্থাৎ সবসময় সফর করে কিন্তু অনেক সময় বাড়িতেও থাকে। অতএব, এখান থেকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় ধরে নিয়ে সম্পূর্ণ সময়কে বুঝাতে চেয়েছেন আর এই ধরনের তা‘বীর (ব্যাখ্যা) আরবী ভাষায় বৈধ রয়েছে। এর জন্য আমিও বললাম যে, দিনের অধিকাংশ সময় কিচিরমিচির করলে তো সেটা ফেরত দেওয়া ঠিক হবে না। কেননা এটা সম্পূর্ণ সময়কে ধরে নেওয়া হয়েছে।
অবস্থা দেখুন, ইমাম মালেকর ছাত্র ইমাম শাফেঈ নিজের শিক্ষকের উত্তর অথবা মাসআলাকে খণ্ডন করেছেন। তবুও শিক্ষক নিজের ছাত্রের উপর অসন্তুষ্ট হলেন না, বরং সেটা কবুল করে নিলেন। মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও এটাই ছিল পরস্পর ভালোবাসা ও সম্মানের উদাহরণ।[1]
(২) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল ও আলী ইবনুল মাদীনী রহিমাহুমুল্লাহ-এর ঘটনা : একদা ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল ও আলী ইবনু মাদীনী রহিমাহুমুল্লাহ-এর মধ্যে কোনো এক বিষয় নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়। ওই দিন ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ-এর কাছে তিনি আরোহী অবস্থায় এসেছিলেন। বাহন থেকে নেমে সেই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। বর্ণনাকারী বলছেন, আলোচনার মধ্যে খুব উচ্চৈঃস্বরে আওয়াজ হতে শুরু করেছিল। কিন্তু আলোচনা শেষে রওনা হবার সময় ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ আলী ইবনুল মাদীনী রাহিমাহুল্লাহ-কে ভালোভাবে বাহনের উপর বসালেন এবং বিদায় জানালেন। সুবহানাল্লাহ! কী অবাক ঘটনা! এত তর্ক-বিতর্ক হওয়ার পরপরই এই ভালোবাসা ও সম্মান।
এগুলো তো ছিল সোনালিযুগের কিছু দৃষ্টান্ত। এবার দেখা যাক বিংশ শতাব্দীর কিছু উদাহরণ :
(১) আল্লামা ছানাউল্লাহ আমৃতসরি রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম এবং নামকরা মুনাযির (তার্কিক)। তিনি বিভিন্ন ফেরকা ও নানান ধর্মের লোকের সাথে মুনাযারা করেছেন। তাঁর একটা বড় গুণ ছিল যে, মুনাযারা (তর্ক) শেষে তিনি বিপক্ষের লোকদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য দাওয়াত দিতেন এবং তার বাসায় অবস্থান করার দাওয়াত দিতেন।
(২) শায়খুল হাদীছ ইসমাঈল সালাফী গুজরানওয়ালা রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, একদা হজ্জের মৌসুমে হাজীগণের দল একসাথে বের হয়ে স্টেশনে পৌঁছান। সেখানে খুব ভিড় ছিল। ছালাতের সময় হলে কিছুসংখ্যক লোক সেখানে কাতার হয়ে শায়খ ইসমাঈলকে ইমামতি করার জন্য আগে যেতে বলেন। যখনই তিনি মুছল্লায় দাঁড়াতে যাবেন, তখনই পিছন থেকে আওয়াজ এলো যে, তাঁর পিছনে ছালাত হবে না। কারণ তিনি সালাফী আক্বীদার মানুষ। তখন তিনি নিজের রুমাল কাঁধে নিয়ে পিছনে সরে গিয়ে বললেন, তাহলে আপনিই (নির্দিষ্ট কাউকে সম্বোধন করে) ছালাত পড়িয়ে দিন। আপনার পিছনে আমার ছালাত হয়ে যাবে। সেই লোকটি তখন খুব লজ্জিত হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করল এবং তাকেই ছালাত পড়াতে বলল। বর্তমান সময়ের মতো মানুষ যদি সেই জায়গায় থাকতো, তবে অবস্থা কেমন হতো! অন্ততপক্ষে এমনটা তো হতোই যে, ইমাম সাহেব তাঁর লোকদের নিয়ে একটা জামাআত করতেন, আর আরেকদল আরেকটা জামাআত করত। এভাবে দুই দলে বিভক্ত হয়ে যেত।[2]
বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত তিন জন ইসলামী পণ্ডিত আল্লামা নাছিরুদ্দিন আলবানী, আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনু বায ও আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-উছায়মীন রহিমাহুমুল্লাহ, তাদের মধ্যেও অনেক বিষয়ে পরস্পরে মতবিরোধ দেখা যায়। এমনকি এই তিন জন শায়খকে নিয়ে দুই খণ্ডের একটি বই রচনা করা হয়েছে, যার নাম—
الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز
এই বইয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উল্লিখিত শায়েখদের মতানৈক্যগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের প্রমাণ এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতামতগুলোও বর্ননা করা হয়েছে। অথচ তারা পরস্পরে কোনোদিন শত্রুতা, ঝগড়া-বিবাদ, খারাপ সমালোচনা করেননি, বরং তারা একে অপরের প্রশংসা করেছেন এবং আন্তরিকতা ও সুধারণায় অন্যের জ্ঞানী হওয়ার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মতভেদ পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখার জন্য ছিল না।
তার একটি উদাহরণ হলো রুকূর পরে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাঁধা সম্পর্কে শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলছেন, রুকূর পরে বুকে হাত বাঁধা হচ্ছে বিদআত। কিন্তু শায়খ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ বলছেন, এটা স্পষ্ট ভুল ফৎওয়া; এটা বিদআত নয়, আর আমার জানা মতে কোনো আলেম এ রকম বলেননি।
তা সত্ত্বেও দেখুন! শায়খ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলছেন, আমি তার জ্ঞানের পরিধি ও পরিসর সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করি না। আমার জানামতে তিনি একজন সুযোগ্য আলেম। আমি সাক্ষ্য দিই যে, তিনি সুন্নাতের প্রতি খুবই আগ্রহী এবং অনেক উপকারী বই রচনা করেছেন। তবে অন্যান্য আলেমের মতো তাঁরও কিছু বিষয়ে ভুল হয়েছে, আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করুন।
শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ শায়খ ইবনু বায রাহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলছেন, ইবনু বায এমন একজন আলেম, যিনি ইসলামী দুনিয়াকে নিজের জ্ঞান দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
এই ছিল তাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানবোধ।
এছাড়া শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ এবং ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ-এর মধ্যেও কিছু মতানৈক্য ছিল। তার একটি উদাহরণ বলি, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলছেন, ক্বিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করা খোলা জায়গায় হোক অথবা কোনো আড়ালে হোক একেবারেই অবৈধ। কিন্তু ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ বলছেন, খোলা জায়গায় ক্বিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করা ঠিক নয়, তবে কোনো আড়াল থাকলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ এ ধরনের মতবিরোধের কারণে শায়খ ইবনু উছায়মীন রাহিমাহুল্লাহ-কে ছোট মনে করেননি, বরং তার জ্ঞানের প্রশংসা করে বলেছেন, ইবনু উছায়মীন হচ্ছেন, একজন বড় মাপের যোগ্য আলেম।[3]
সুধী পাঠক! উল্লিখিত উদাহরণসমূহ বর্ননা করার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে, সেখান থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা আর তা হলো এই যে, আমাদের মধ্যে পরস্পরে মতভেদ থাকতেই পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একথা সবসময় মাথায় রাখতে হবে যে, এই মতভেদের কারণে আমাদের কথা বা কাজের মাধ্যমে অপর পক্ষের যেন সম্মানহানি না হয় বা তারা যেন কষ্ট না পায়। আর এটাও ভাবা উচিত যে, কিছু বিষয় এমনও রয়েছে, যাতে কোনো রকমের আদর্শ বা বিশ্বাসের কথাই আসবে না, বরং সামাজিক ও মানবিক কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে। এসব বিষয়ে সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে, তা না হলে আমাদের মধ্যে মদভেদ, বিরোধিতা, শত্রুতা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হতে থাকবে, যা আমাদের জন্য খুবই ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হবে।
আসুন! আমরা পরস্পরে মতভেদ, মতপার্থক্য ও ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি। পরস্পরকে ভাই-ভাই মনে করে সকলেই দ্বীনে ইসলামের ছায়াতলে একতাবদ্ধ হই। আল্লাহ প্রদত্ত বিধান এবং রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের আলোকে জীবন গড়ে তুলি। আমাদের ইহকাল-পরকালকে সাফল্যমণ্ডিত করার চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন! ছুম্মা আমীন!!
* শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বানারাস, ভারত।
[1]. ‘আদাবুল খেলাফ’-এর উর্দূ অনুবাদ সালীকায়ে ইখতিলাফ, পৃ. ৩৭।
[2]. শায়খ আসআদ আ‘জামী t (শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বানারাস, ভারত)-এর লেখনী থেকে নেওয়া কিছু অংশ।
[3]. আল-ইজায ফী বা‘যি মা ইখতালাফা ফীহিল আলবানী ওয়া ইবনু উছায়মীন ওয়া ইবনু বায, পৃ. ৮৮।