সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মা‘বূদ নেই। তিনি এক; তাঁর কোনো শরীক নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। ছালাত ও সালাম বর্ষিত হোক নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সকল সাথীদের উপর।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে উপকারী ইলম শিক্ষা দিন, আর যা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তা দ্বারা আমাদের উপকৃত করুন। আমাদের জ্ঞান বাড়িয়ে দিন, আমাদের জ্ঞানকে আমাদের বিপক্ষে দলীল বানিয়েন না; পক্ষে দলীল বানিয়ে দিন— হে মহিমাময়, মহান।
অতঃপর, হে সম্মানিত ভ্রাতৃবৃন্দ! নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘তুমি আগ্রহী হও সেসব জিনিসের প্রতি যা তোমাকে (দুনিয়া ও আখেরাতে) উপকার দিবে, আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও’। এটি হচ্ছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীছের একটি অংশ, যা ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহতাঁর ছহীহ মুসলিমে সংকলন করেছেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ.
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শক্তিশালী ঈমানদার দুর্বল ঈমানদারের তুলনায় আল্লাহর নিকট অধিক উত্তম ও প্রিয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত আছে। ‘তুমি আগ্রহী হও সেসব জিনিসের প্রতি যা তোমাকে (দুনিয়া ও আখেরাতে) উপকার দিবে, আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও, অক্ষম হয়ে যেয়ো না। এমন বলো না যে, যদি আমি (এমন) করতাম তবে এমন হতো; বরং বলো, আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেছেন। তিনি যা চেয়েছেন, তা সম্পাদন করেছেন। কেননা “যদি” শব্দটি শয়তানের কর্মের (দুয়ার) খুলে দেয়’।[1]
উপরিউক্ত হাদীছটির ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন যে, হাদীছটিতে বেশ কিছু ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য, মহান মূলনীতি ও উপকার নিহিত রয়েছে। তারা এই বাক্যের উপর স্থির হয়েছে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তুমি তোমার প্রত্যেক কল্যাণকর কাজের দিকে অগ্রসর হও! আর আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো’।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘তুমি আগ্রহী হও সেসব জিনিসের প্রতি যা তোমাকে (দুনিয়া ও আখেরাতে) উপকার দিবে, আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও’। এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাক্য, যাতে বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য কল্যাণকর বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে রয়েছে দুটি মূলনীতির প্রতি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ, যা ছাড়া দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা অসম্ভব।
প্রথম নির্দেশ: তাঁর বাণী, ‘তুমি আগ্রহী হও সেসব জিনিসের প্রতি যা তোমাকে (দুনিয়া ও আখেরাতে) উপকার দিবে’। এখানে উপকারী উপকরণ ব্যবহার করার ব্যাপারে উৎসাহ রয়েছে, যা ব্যক্তিকে দুনিয়া ও আখেরাতে উপকার দিবে।
দ্বিতীয় নির্দেশ: তাঁর বাণী, ‘আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও’। এখানে উপকরণের দিকে ভ্রুক্ষেপ ও নির্ভর না করা, আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা করার প্রতি আহ্বান রয়েছে, যাতে তাঁর সাহায্য, তাওফীক্ব ও সঠিকতা পাওয়া যায়।
হাদীছটিতে তাঁর বাণী ‘তুমি আগ্রহী হও সেসব জিনিসের প্রতি যা তোমাকে) উপকার দিবে’। ‘তুমি তোমার প্রত্যেক কল্যাণকর কাজের দিকে অগ্রসর হও’। এ অংশের মাধ্যমে যেসব উপকারী জিনিসের দিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা দ্বীনী ও দুনিয়াবী উভয় ধরনের কল্যাণকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা বান্দার যেমন দ্বীনী বিষয়ের প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি দুনিয়াবী বিষয়েরও প্রয়োজন রয়েছে।
কাজেই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বান্দাকে তাঁর দ্বীনী ও দুনিয়াবী কল্যাণকর বিষয়ের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। আর এই আকাঙ্ক্ষার সাথে সাথে উপকরণ ব্যবহার করবে, সঠিক পথ ও পন্থা অবলম্বন করতে প্রয়াসী হবে, যার মাধ্যমে সে তার মহান অভীষ্টে পৌঁছতে পারবে। আর এসব কাজে একমাত্র মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে। কারণ বান্দার (মন্দ থেকে বেঁচে থাকার) কোনো শক্তি ও (কল্যাণ সাধন করার কোনো) ক্ষমতা নেই আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহ যা চান তাই হয়, যা চান না তা হয় না।
দ্বীনী কল্যাণকর বিষয়সমূহ দুটি মহান মূলনীতির দিকে ফিরে যায়।
(ক) উপকারী জ্ঞান এবং (খ) সৎ আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন,هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি একে সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা অপছন্দ করে’ (আত-তাওবা, ৯/৩৩)।
হেদায়াত হলো উপকারী জ্ঞান আর সত্য দ্বীন হলো সৎ আমল।
উপকারী জ্ঞান হলো যা আল্লাহ তাআলার কিতাব ও রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করা হয়। এটি অন্তরসমূহকে পরিশুদ্ধ করে, মননকে সংস্কার করেন এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতা নিশ্চিত করে। তাই বান্দা উপকারী জ্ঞান অর্জনে প্রবল প্রচেষ্টা করবে এবং ইলম অর্জনের জন্য প্রতিদিনের কিছু অংশ বরাদ্দ রাখবে। কারও জন্য এটি সমীচীন নয় যে, সে জ্ঞান অর্জন ছাড়া একটি দিন অতিবাহিত করবে। তাইতো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিদিন ফজর ছালাতের সালাম ফেরানোর পর বলতেন,
اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا وَرِزْقًا طَيِّبًا وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا.
‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান, উত্তম রিযিক্ব, গ্রহণযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি’।[2] এটি সুস্পষ্ট করে দেয় যে, মুসলিম ব্যক্তির দিনের অন্যতম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হলো উপকারী জ্ঞান।
কাজেই কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য এটা সমীচীন নয় যে, জ্ঞান অর্জন ছাড়াই একটি দিন অতিবাহিত করা। এখান থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, মুসলিম ব্যক্তি উপকারী ইলমের জন্য প্রতিদিনের জন্য একটি প্রোগ্রাম সাজিয়ে নিবেন, যার মাধ্যমে সে ইলমের একটি অংশ অর্জন করবেন, যদিও তা পরিমাণে কম হয়। উপকারী জ্ঞান অর্জন ছাড়া যেন তার কোনো দিনও না কাটে।
অতঃপর আমলের প্রতি আগ্রহী হবে। ইলম অর্জনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আমল করা। যেমনটি আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, يحتف بالعلم العمل، فإن أجابه وإلا ارتحل ‘ইলম (সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে) আমলের আহ্বান করে। যদি সে তার আহ্বানে সাড়া দেয় (তবে ইলম তার কাছে বহাল থাকে); আর যদি সাড়া না দেয়, তবে সে চলে যায়’।
অতএব, মুসলিম ব্যক্তি আমলে নিজের অংশ থাকার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে, যা তাকে মহান আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো দ্বীনের ফরয ও ওয়াজিব বিধিবিধানের ব্যাপারে সচেষ্ট-যত্নবান হওয়া।
হাদীছে কুদসীতে এসেছে, ‘আমি যা ফরয করেছি তারচেয়ে প্রিয়তর কোনো জিনিস নেই, যার মাধ্যমে বান্দা আমার নিকটবর্তী হতে পারে’।
মুমিন বান্দার জন্য এটা মানানসই নয় ইসলামের ফরয অথবা দ্বীনের ওয়াজিব পরিত্যাগ করে দিন-রাত অতিক্রম করা। বরং তার উপর ওয়াজিব হচ্ছে ফরয ও ওয়াজিব পালনের মাধ্যমে সর্বাত্মক সচেষ্ট থাকবে। এর আওতাভুক্ত হলো আল্লাহর আনুগত্য, তাঁর সন্তুষ্টি কামনা ও তাঁর শাস্তির ভয়ে হারাম ও পাপাচার থেকে দূরে থাকা।
তেমনিভাবে হাদীছে দুনিয়াবী কল্যাণকর কাজের প্রতি আগ্রহী হতে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, ‘তুমি আগ্রহী হও সেসব জিনিসের প্রতি যা তোমাকে উপকার দিবে’। এই বাক্য দ্বীনী ও দুনিয়াবী কল্যাণ ও আল্লাহর নৈকট্যশীল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। বান্দা তার দুনিয়াবী প্রয়োজন থেকে মুক্ত নয়, যার দ্বারা সে কল্যাণ সাধন করবে ও দ্বীনী উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করবে। তবে এই গুরুত্বারোপ যেন সেসব বিষয়কে ছাপিয়ে না যায়, যেজন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করার জন্য তাকে অস্তিত্ব দেওয়া হয়েছে। আর সেটি হলো মহান আল্লাহর ইবাদত। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৫৬)।
সর্বোপরি, এই হাদীছটিকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘ব্যাপক অর্থবোধক উচ্চাঙ্গের ভাব ও ভাষা বাক্য’-এর পর্যায়ভুক্ত গণ্য করা হয়। এই হাদীছটি এমন অনেক বড় বড় উপকারিতা ও মাহাত্ম্যপূর্ণ সতর্কতামূলক বিষয়াবলিতে পরিপূর্ণ, যা থেকে কোনো ব্যক্তি মুসলিম ব্যক্তিই অমুখাপেক্ষী নয়, যা তার দ্বীন ও দুনিয়াবী বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।
আর আমি আল্লাহর কাছে কামনা করি, তিনি যেন আমার ও আপনাদের দ্বীনকে সংশোধন করে দেন, যা আমাদের সমস্ত বিষয়ের রক্ষাকবজ; আমাদের দুনিয়াকে সংশোধন করে দেন, যা আমাদের আবাসস্থল; আমাদের আখেরাতকে সংশোধন করে দেন, যা আমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল; আমাদের জীবনকে কল্যাণকর কাজে সুদীর্ঘ করুন; আমাদের মৃত্যুকে সকল অনিষ্ট থেকে আরামদায়ক করুন। নিশ্চয় তিনি বরকতময়, সুউচ্চ, দু‘আ শ্রবণকারী। তিনিই একমাত্র আশার স্থল। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট আর তিনি কতইনা উত্তম অভিভাবক!
আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক অবগত। দরূদ ও শান্তি বর্ষিত হোক আল্লাহর বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর, তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর সকল ছাহাবীদের উপর।
মূল: শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন আব্দুল মুহসিন আল-বদর
অনুবাদ: আব্দুল হাসিব বিন আব্দুল হাফীয
অধ্যয়নরত, মাদরাসা মুহাম্মাদীয়া আরাবীয়া, উত্তর যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৬৪।
[2]. ইবনু মাজাহ, হা/৯২৫।