আমরা কথায় কথায় যুগকে গালি দিই। কখনো ভাবি না যে, যুগের ভালো-মন্দের প্রশ্ন কেন আসে। যুগ তো আমাদের ভালো-মন্দের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে না ভালোর পক্ষে, না মন্দের। ইতিহাস রচনা করার দায়িত্ব তার নয়, নয় ভালো-মন্দের তফাত দেখানো।
সময় খারাপ হয়ে গেছে, যুগটাও ভালো না, আগের মানুষ অনেক ভালো ছিল, সময় ও কালের সুফলে তাদের মধ্যে আমরা এত কিছু পাই— এধরনের কথা আমরা অনেক বলে থাকি। যদি এটাই হয় আমাদের বিশ্বাস, তাহলে বলব- এতে কাল বা যুগের অপরাধটা কী? তাহলে সামাজিক অবক্ষয়, মনুষ্যত্বের বিবর্তন আবিষ্কার কবে থেকে হয়েছে? আর কখনই-বা যুগ তার শক্তি-সামর্থ্য হারিয়ে মরতে বসেছে! আগের যুগ আর এখনকার যুগে তফাতটা হুট করেই হয়ে গেছে নাকি ধপাস করে আসমান থেকে কেউ যুগের টুঁটি চেপে ধরেছে যে, যুগ তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে কোনোমতে কালাতিপাত করছে?! সমালোচনার গোলটেবিল নোংরা মানসিকতার প্রকাশস্থলে পরিণত হচ্ছে। মানবতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরা হচ্ছে। আর শেষ পর্যন্ত কলঙ্কের কালি বসানো হচ্ছে যুগের কপালে, কালের চেহারায়। আর নিজেরা বসে আছেন আরাম-আয়েশের আলিশান মসনদে। যুগের পঙ্কিলতা যেন তাদের ধরাছোঁয়ার সীমায় আসতে না পারে। সমাজ গোল্লায় যাক এতে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। যত দোষ খুঁজে পাওয়া গেছে, সবই কালের। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى وَإِنْ تَدْعُ مُثْقَلَةٌ إِلَى حِمْلِهَا لَا يُحْمَلْ مِنْهُ شَيْءٌ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى إِنَّمَا تُنْذِرُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَمَنْ تَزَكَّى فَإِنَّمَا يَتَزَكَّى لِنَفْسِهِ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ ‘কোনো ভার বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না এবং যার উপর ভারী বোঝা চাপানো থাকবে, সে অন্য কাউকে তা বহন করার জন্য ডাকলে, তা থেকে কিছুই বহন করা হবে না যদিও সে (অর্থাৎ যাকে বোঝা বহনের জন্য ডাকা হবে সে) কোনো নিকটাত্মীয় হয়। (হে নবী!) তুমি তো কেবল তাদেরকেই সতর্ক করতে পার, যারা তাদের প্রতিপালককে না দেখে ভয় করে এবং যারা ছালাত ক্বায়েম করে। কেউ পবিত্র হলে সে তো নিজেরই কল্যাণার্থে পবিত্র হয়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহরই কাছে (সকলের) প্রত্যাবর্তন’ (আল-ফাত্বির, ৩৫/১৮)।
আল্লাহ তাআলা বলেন,فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ - وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ ‘সুতরাং কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করে থাকলে সে তা দেখতে পাবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করে থাকলে তাও দেখতে পাবে’ (আয-যিলযাল, ৯৯/৭-৮)। হাদীছে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, قَالَ اللَّهُ: يَسُبُّ بَنُو آدَمَ الدَّهْرَ، وَأَنَا الدَّهْرُ، بِيَدِي اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ ‘আল্লাহ বলেন, মানুষ যামানাকে গালি দেয়, অথচ আমিই যামানা (এর নিয়ন্ত্রণের মালিক)। একমাত্র আমারই হাতে রাত্রি ও দিনের পরিবর্তন’।[1]
সামাজিক অবক্ষয়ের দায় কিন্তু আমাদের কাঁধেই। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নেতা (ইমাম) একজন দায়িত্বশীল, সে তার অধীনস্থদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে। পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল, সে তার পরিবারের লোকদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার স্বামীর ঘরের (অর্থাৎ সন্তানসন্ততি, ধনসম্পদ ইত্যাদির) দায়িত্বশীল ও রক্ষক। তাকে তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি এর সবই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি। আমার ধারণা হয় তিনি একথাও বলেছেন, ছেলে তার পিতার সম্পত্তির রক্ষক এবং সেও জিজ্ঞাসিত হবে তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্বন্ধে। অতএব, তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তার অধীনস্থদের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে’।[2]
উক্ত হাদীছে প্রত্যেকের দায়দায়িত্বের কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। সাথে সাথে দায়িত্বের জবাবদিহিতার বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে যে, প্রত্যেকের দায়িত্ব কিন্তু অত্যন্ত কঠিন, আবার অনেকটাই সহজ। তা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে সচেষ্ট থাকা উচিত। একদিন এ সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।
হাদীছ থেকে শিক্ষা :
(১) আমরা কেউ দায়িত্বমুক্ত নই। আপন আপন ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উপরই কোনো না কোনো দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। সে দায়িত্ব পালনে প্রত্যেকেরই সচেষ্ট থাকা চাই।
(২) শাসকশ্রেণির কর্তব্য হলো দেশবাসীকে শরীআতের দিকনির্দেশনা মোতাবেক পরিচালনা করা।
(৩) গৃহকর্তার কর্তব্য হলো আপন সামর্থ্য অনুযায়ী পরিবারবর্গের দুনিয়াবী প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি তাদের দ্বীনী বিষয়ের তত্ত্বাবধান করা।
(৪) স্ত্রীর কর্তব্য হলো স্বামীর আনুগত্য করা এবং সন্তানসন্ততি ও ঘর-সংসারের প্রতি কল্যাণময় আচরণ করা।
(৫) আখেরাত সত্য। আখেরাতে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হবে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।
মাহমূদ হাসান ফাহিম
শিক্ষার্থী, জামিআহ ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৮১।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪০৯।