কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

নফল ছালাত

ভূমিকা : 
أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ إِذَا صَلَّى أَنْ يَتَقَدَّمَ أَوْ يَتَأَخَّرَ أَوْ عَنْ يَمِينِهِ أَوْ عَنْ شِمَالِهِ ‘তোমাদের কেউ (ফরয) ছালাত পড়ার পর একটু সামনে এগিয়ে বা পিছনে সরে অথবা তার ডানে বা বামে সরে (নফল) ছালাত আদায় করতে কি অপারগ হবে?’[8] নফল ছালাত কিছু অংশ দাঁড়িয়ে ও কিছু অংশ বসে পড়া যায়।।[9]

নফল ছালাত আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একটি বড় মাধ্যম। এর মাধ্যমে হাশরের মাঠের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আলোচ‍্য প্রবন্ধে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতের সাথে সম্পৃক্ত আমরা যে ছালাতগুলো পড়ে থাকি, সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।*

নফল ছালাতের পরিচয় :

نَفْلٌ আরবীশব্দ।একবচন, বহুবচনে نَوَافِلٌ অর্থ : অতিরিক্ত, বাড়তি, ঐচ্ছিক ইত্যাদি। ফরয ছালাত ছাড়া অন্য যে ছালাত মানুষ আদায় করে, তাই নফল ছালাত। সুন্নাত, নফল, মানদূব ও মুস্তাহাব এসবই সমার্থক। সবগুলো শব্দই কাছাকাছি একই অর্থ বহন করে।

নফল ছালাতের গুরুত্ব  ফযীলত :

নফল ছালাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,

إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ عَمَلِه صَلَاتُه فَإِنْ صَلُحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ فَإِنِ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيْضَتِه شَيْءٌ قَالَ الرَّبُّ تَبَارَكَ وَتَعَالى: انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِىْ مِنْ تَطَوُّعٍ؟ فَيُكَمَّلُ بِهَا مَا انْتَقَصَ مِنَ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ يَكُونُ سَائِرُ عَمَلِه عَلى ذلِكَ

‘কিয়ামতের দিন সব জিনিসের পূর্বে বান্দার যে আমলের হিসাব হবে, তা হলো ছালাত। যদি তার ছালাত সঠিক হয়, তাহলে সে সফলকাম হবে ও নাজাত পাবে। আর যদি ছালাত বিনষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে বিফল ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি ফরয ছালাতে কিছু ভুল হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাগণকে বলবেন, দেখো আমার বান্দার নিকট নফল ছালাত আছে কি-না? তাহলে সেখান থেকে এনে বান্দার ফরয ছালাতের ত্রুটি পূরণ করে দেওয়া হবে। এরপর এ রকম বান্দার অন্যান্য হিসাব নেওয়া হবে’।[1] হাদীছে কুদুসীতে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ اللَّهَ قَالَ مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِى بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِى يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِى يَسْمَعُ بِهِ وَبَصَرَهُ الَّذِى يُبْصِرُ بِهِ وَيَدَهُ الَّتِى يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِى يَمْشِى بِهَا وَإِنْ سَأَلَنِى لأُعْطِيَنَّهُ وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِى لأُعِيذَنَّهُ وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَىْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِى عَنْ نَفْسِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ .

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার অলীর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব। বান্দা যা কিছু দিয়ে আমার নৈকট্য লাভ করে থাকে, তার মধ্যে আমার নিকট অধিক প্রিয় হলো সেই ইবাদত, যা আমি তার উপর ফরয করেছি। আর সে নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। অবশেষে আমি তাকে ভালোবাসি। অতঃপর আমি তার কান হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে শ্রবণ করে। তার চোখ হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে দেখে। তার হাত হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে ধরে। তার পা হয়ে যাই, যার মাধ্যমে সে চলে। সে আমার যা চাই আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় দিয়ে থাকি। আর আমি যে কাজ করি, তাতে কোনো দ্বিধাবোধ করি না- যতটা দ্বিধাবোধ করি একজন মুমিনের জীবন সম্পর্কে, কারণ সে মরণকে অপছন্দ করে। আর আমি তার (বেঁচে থেকে) কষ্ট পাওয়াকে অপছন্দ করি’।[2]

রবীআ ইবনু কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,كُنْتُ مَعَ رَسُولِ اللّٰهِ صلى الله عليه وسلم فَأَتَيْتُه بِوَضُوئِه وَحَاجَتِه فَقَالَ لِي سَلْ فَقُلْتُ أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الْجَنَّةِ قَالَ أَوَ غَيْرَ ذلِكَ قُلْتُ هُوَ ذَاكَ قَالَ فَأَعِنِّي عَلى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ ‘আমি রাতের বেলা নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থাকতাম। ওযূর পানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দিতাম। একদিন তিনি আমাকে বললেন, (দ্বীন-দুনিয়ার কল্যাণের জন্য যা কিছু চাও) চেয়ে নাও। আমি নিবেদন করলাম, আমি শুধু জান্নাতে আপনার সহচর্য লাভ করতে চাই। তিনি বললেন, এছাড়া আর কিছু চাও? আমি বললাম, এটাই আমার একমাত্র আবেদন। তিনি বললেন, তুমি বেশি বেশি সেজদার মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করো’।[3] অর্থাৎ নফল ছালাতের মাধ্যমে আমার সাহায্য কামনা করো। উম্মে হাবীবা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে লোক দিনে-রাতে ১২ রাকআত ছালাত আদায় করবে, তার জন্যে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করা হবে। তা হলো, চার রাকআত যোহরের পূর্বে আর দুই রাকআত যোহরের পরে, দুই রাকআত মাগরিবের পরে, দুই রাকআত এশারের পরে আর দুই রাকআত ফজরের পূর্বে’।[4]

নফল ছালাতের নিয়ম :

নফল ছালাত বাড়িতে পড়া সুন্নাত। যায়েদ ইবনু সাবেত রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,أَفْضَلُ صَلاَتِكُمْ فِي بُيُوتِكُمْ إِلاَّ الْمَكْتُوبَةَ ‘ফরয ছালাত ব্যতীত তোমাদের বাড়িতে আদায়কৃত ছালাত সর্বোৎকৃষ্ট’।[5] ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, صَلُّوا فِي بُيُوتِكُمْ وَلاَ تَتَّخِذُوهَا قُبُورًا ‘তোমাদের বাড়িতেও ছালাত আদায় করো, তাকে কবরস্থানে পরিণত করো না’।[6] জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কারও মসজিদে ফরয ছালাত শেষ হলে সে যেন কিছু ছালাত বাড়িতে আদায়ের জন্য রেখে দেয়। কেননা আল্লাহ তার এ ছালাতের জন্য বাড়িতে কল‍্যাণ দান করবেন’।[7]

সুন্নাত ছালাত আদায় করার সময় স্থান পরিবর্তন করা সুন্নাত। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

ফজরের সুন্নাত :

ফজরের পূর্বে দুই রাকআত সুন্নাত অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,لَمْ يَكُنِ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى شَيْءٍ مِنَ النَّوَافِلِ أَشَدَّ تَعَاهُدًا مِنْهُ على رَكْعَتي الْفجْر ‘নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নফল ছালাতের মধ্যে ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত ছালাতের প্রতি যেমন অত্যধিক যত্ন নিতেন আর কোনো ছালাতের উপর এত অত্যধিক যত্ন নিতেন না’।[10] আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা আরও বলেন, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত ছালাত দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল জিনিসের চেয়ে অধিক উত্তম’।[11] তবে তা সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাফছা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘যখন মুআযযিন আযান দিত ও ফজর উদয় হতো, তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই রাকআত সংক্ষিপ্ত ছালাত পড়তেন’।[12]

ফজরের সুন্নাত ছালাতে প্রথম রাকআতে সূরা কাফেরূন এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইখলাছ পাঠ করা সুন্নাত। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَرَأَ فِي رَكْعَتَي الفَجْرِ قُلْ يَا أَيُّهَا الكَافِرُونَ وَ قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের দুই রাকআত সুন্নাতে সূরা ‘কুল ইয়া আইয়্যুহাল কাফেরূন’ ও ‘কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ পাঠ করতেন’।[13] নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো ফজরের দুই রাকআত সুন্নাতে সূরা বাক্বারার ১৩৬ ও সূরা আলে ইমরানের ৬৪ নং আয়াত পড়তেন।[14] ফজরের সুন্নাত শেষ করে ডান পার্শ্বে শোয়া মুস্তাহাব। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إذَا صَلَّى رَكعَتَي الفَجْرِ اضْطَجَعَ عَلَى شِقِّهِ الأَيْمَنِ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত পড়তেন, তখন ডান পার্শ্বে শুয়ে (বিশ্রাম) নিতেন’।[15]

যোহরের সুন্নাত :

যোহরের পূর্বে চার রাকআত ছালাত পড়া সুন্নাত। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,كَانَ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم لاَ يَدَعُ أَرْبَعاً قَبْلَ الظُّهْرِ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের পূর্বে চার রাকআত সুন্নাত কখনো ত্যাগ করতেন না’।[16] আবদুল্লাহ ইবনুস সায়েব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য হেলে যাওয়ার পর যোহরের ছালাতের পূর্বে চার রাকআত ছালাত আদায় করতেন। তিনি বলতেন, এটা এমন এক সময় যখন (নেক আমল উপরের দিকে যাওয়ার জন্যে) আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। তাই এ মুহূর্তে আমার নেক আমলগুলো উপরের দিকে চলে যাক এটা আমি চাই’।[17] আবূ ছালেহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যোহরের ছালাতের পূর্বে চার রাকআত ছালাত তাহাজ্জুদের ছালাতের মতো ফযীলতপূর্ণ’।[18] অন‍্য হাদীছে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি চাশতের চার রাকআত ছালাত ও যোহরের পূর্বে চার রাকআত ছালাত পড়বে, তার জন্যে জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করা হবে’।[19]

যোহরের পূর্বে দুই রাকআত ছালাতও পড়া যায়। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الظُّهْرِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَهَا وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْمَغْرِبِ فِي بَيْتِهِ وَرَكْعَتَيْنِ بَعْدَ الْعِشَاءِ فِي بَيْتِهِ قَالَ: وَحَدَّثَتْنِي حَفْصَةُ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ خَفِيفَتَيْنِ حِينَ يَطْلُعُ الْفَجْرُ ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে যোহরের ফরযের পূর্বে ও পরে দুই রাকআত ও মাগরিবের ফরযের পরে দুই রাকআত ছালাত তাঁর বাড়িতে এবং এশার ফরযের পর দুই রাকআত তাঁর বাড়িতে আদায় করেছি। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু আরও বলেছেন, হাফছা রাযিয়াল্লাহু আনহা আমার নিকট বলেছেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হালকা করে দুই রাকআত ছালাত ফজরের ছালাতের সময় আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গে আদায় করতেন’।[20]

যোহরের পরে চার রাকআত ছালাতও পড়া যায়। উম্মু হাবীবা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি,مَنْ حَافَظَ عَلَى أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ قَبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعٍ بَعْدَهَا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ ‘যে ব্যক্তি যোহরের পূর্বে ও পরে চার রাকআত ছালাত আদায়ের প্রতি যত্নবান হয়, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন’।[21]

আছরের সুন্নাত:

আছরের পূর্বে চার রাকআত ছালাত পড়া সুন্নাত। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,رَحِمَ اللَّهُ امْرَءًا صَلَّى قَبْلَ الْعَصْرِ أَرْبَعًا ‘আল্লাহ তাআলা ঐ লোকের উপর রহমত বর্ষণ করেন, যে লোক আছরের পূর্বে চার রাকআত ছালাত আদায় করে’।[22]

মাগরিবের সুন্নাত :

মাগরিবের পূর্বে ও পরে দুই রাকআত ছালাত পড়া সুন্নাত। আবদুল্লাহ ইবনু মুগাফফাল রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,صَلُّوْا قَبْلَ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ صَلُّوْا قَبْلَ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ رَكْعَتَيْنِ قَالَ فِي الثَّالِثَةِ لِمَنْ شَاءَ ‘মাগরিবের পূর্বে তোমরা দুই রাকআত ছালাত আদায় করো। মাগরিবের পূর্বে তোমরা দুই রাকআত ছালাত আদায় করো। তৃতীয়বার তিনি বলেছেন, যিনি ইচ্ছা করেন (তিনি পড়বেন)’।[23] আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা মদীনায় ছিলাম। (এ সময়ে অবস্থা এমন ছিল যে, মুআযযিন মাগরিবের আযান দিলে (কোনো কোনো ছাহাবী) মসজিদের খুঁটির দিকে দৌড়াতেন আর দুই রাকআত ছালাত আদায় করতে আরম্ভ করতেন। এমনকি কোনো মুসাফির লোক মসজিদে এসে অনেক লোককে একা একা ছালাত আদায় করতে দেখে মনে করতেন, (ফরয) ছালাত সমাপ্ত হয়ে গেছে। অথচ লোকেরা এখন সুন্নাত পড়ছে’।[24]

মারছাদ ইবনে আব্দুল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন,أَتَيْتُ عُقْبَةَ الْجُهَنِيَّ فَقُلْتُ أَلَا أُعَجِّبُكَ مِنْ أَبِي تَمِيمٍ يَرْكَعُ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ صَلَاةِ الْمَغْرِبِ؟ فَقَالَ عُقْبَةُ إِنَّا كُنَّا نَفْعَلُهُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قُلْتُ فَمَا يَمْنَعُكَ الْآنَ قَالَ اَلشُّغْلُ ‘আমি একবার উক্ববা ইবনু আমির আল-জুহানী রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, আমি কি আপনাকে আবূ তামীম আদ-দারীর (তাবেঈ) একটি বিস্ময়কর ঘটনা শুনাবো না? তিনি মাগরিবের ছালাতের পূর্বে দুই রাকআত ছালাত আদায় করেন। তখন উক্ববা রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এ ছালাত তো আমরা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় আদায় করতাম। তখন তিনি বললেন, তাহলে এ ছালাত এখন আদায় করতে আপনাকে কী বাধা দিচ্ছে? উত্তরে তিনি বললেন, (দুনিয়ার) কর্মব্যস্ততা’।[25] উল্লেখ্য, মাগরিবের পরে চার, ছয় বা বিশ রাকআত ছালাত পড়ার মর্মে হাদীছগুলো দুর্বল।[26]

এশার সুন্নাত :

এশার পরে দুই রাকআত ছালাত পড়া সুন্নাত। যেমনটি পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে এবং বিতরের ছালাত পড়া অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। আবদুল্লাহ ইবনু শাক্বীক্ব রাহিমাহুল্লাহ বলেন,

سَأَلْتُ عَائِشَةَ عَنْ صَلَاةِ رَسُولِ اللّهِ صلى الله عليه وسلم عَنْ تَطَوُّعِه فَقَالَتْ كَانَ يُصَلِّىْ فِي بَيْتِىْ قَبْلَ الظُّهْرِ أَرْبَعًا ثُمَّ يَخْرُجُ فَيُصَلِّىْ بِالنَّاسِ ثُمَّ يَدْخُلُ فَيُصَلِّىْ رَكْعَتَيْنِ وَكَانَ يُصَلِّىْ بِالنَّاسِ الْمَغْرِبَ ثُمَّ يَدْخُلُ فَيُصَلِّىْ رَكْعَتَيْنِ وَيُصَلِّىْ بِالنَّاسِ الْعِشَاءَ وَيَدْخُلُ بَيْتِىْ فَيُصَلِّىْ رَكْعَتَيْنِ وَكَانَ يُصَلِّىْ مِنَ اللَّيْلِ تِسْعَ رَكَعَاتٍ فِيهِنَّ الْوِتْرُ وَكَانَ يُصَلِّىْ لَيْلًا طَوِيلًا قَائِمًا وَلَيْلًا طَوِيْلًا قَاعِدًا وَكَانَ إِذَا قَرَأَ وَهُوَ قَائِمٌ رَكَعَ وَسَجَدَ وَهُوَ قَائِمٌ وَإِذا قَرَأَ قَاعِدًا رَكَعَ وَسَجَدَ وَهُوَ قَاعِدٌ وَكَانَ إِذَا طَلَعَ الْفَجْرُ صَلّى رَكْعَتَيْنِ.

‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নফল ছালাতের ব্যাপারে আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-কে প্রশ্ন করেছি। আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে আমার ঘরে যোহরের পূর্বে চার রাকআত ছালাত আদায় করতেন। তারপর মসজিদে যেতেন। সেখানে লোকদের নিয়ে ছালাত আদায় করতেন। তারপর তিনি কক্ষে ফিরে আসতেন এবং দুই রাকআত ছালাত আদায় করতেন। (ঠিক এভাবে) তিনি লোকদেরকে নিয়ে মাগরিবের ছালাত মসজিদে আদায় করতেন। তারপরে ঘরে ফিরে এসে দুই রাকআত ছালাত আদায় করতেন। রাতে তিনি (তাহাজ্জুদের) ছালাত কখনো ৯ রাকআত পড়তেন। এর মাঝে বিতরের ছালাতও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর রাতে তিনি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ও দীর্ঘ সময় বসে বসে ছালাত আদায় করতেন, যে সময় তিনি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতেন, দাঁড়ানো থেকেই রুকূ-সেজদায় চলে যেতেন। আর যখন বসে বসে ছালাত আদায় করতেন, বসা থেকেই রুকূ-সেজদায় চলে যেতেন। ছুবহে ছাদিকের সময় ফজরের দুই রাকআত সুন্নাত আদায় করে নিতেন’।[27]

জুমআর সুন্নাত :

জুমআর ফরয ছালাতের পূর্বে নির্দিষ্ট কোনো সুন্নাত ছালাত নেই। ইমামের খুৎবার পূর্বে দুই দুই বা চার রাকআত করে ছালাত পড়া যায়। সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

لَا يَغْتَسِلُ رَجُلٌ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَيَتَطَهَّرُ مَا اسْتَطَاعَ مِنْ طُهْرٍ وَيَدَّهِنُ مِنْ دُهْنِهِ أَوْ يَمَسُّ مِنْ طِيبِ بَيْتِهِ ثُمَّ يَخْرُجُ فَلَا يُفَرِّقُ بَيْنَ اثْنَيْنِ ثُمَّ يُصَلِّي مَا كُتِبَ لَهُ ثُمَّ يُنْصِتُ إِذَا تَكَلَّمَ الْإِمَامُ إِلَّا غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَين الْجُمُعَة الْأُخْرَى

‘যে ব্যক্তি জুমআর দিন গোসল করবে, যতটুকু সম্ভব পবিত্রতা অর্জন করবে, তারপর নিজের তেল হতে তার শরীরে কিছু তেল মাখাবে, অথবা ঘরে সুগন্ধি থাকলে কিছু সুগন্ধি লাগাবে। তারপর মসজিদের দিকে রওনা হবে। দুই ব্যক্তির মধ্যে ফাঁক করবে না। যতটুকু সম্ভব ছালাত আদায় করবে। চুপচাপ বসে ইমামের খুৎবা শুনবে। তাহলে এই জুমআ ও পূর্বের জুমআর মাঝখানে তার সব (ছগীরা) গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে’।[28] জুমআর ফরয ছালাতের পরে মসজিদে চার রাকআত ছালাত পড়া সুন্নাত। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের যে লোক জুমআর (ফরয ছালাতের) পর ছালাত আদায় করতে চায়, সে যেন চার রাকআত ছালাত আদায় করে নেয়’।[29]

আর বাড়িতে পড়লে দুই রাকআত পড়া সুন্নাত। ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لَا يُصَلِّي بَعْدَ الْجُمُعَةِ حَتَّى يَنْصَرِفَ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ فِي بَيْتِهِ ‘নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমআর ছালাতের পর বাসায় পৌঁছার পূর্বে কোনো ছালাত আদায় করতেন না। বাসায় পৌঁছার পর তিনি দুই রাকআত ছালাত আদায় করতেন’।[30]

উপসংহার :

পরিশেষে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাতের সাথে সাথে নফল ছালাতের প্রতি যত্নবান হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!


মো. দেলোয়ার হোসেন

আলিম ২য় বর্ষ, চরবাটা ইসমাঈলিয়া আলিম মাদরাসা, সুবর্ণচর, নোয়াখালী।


[1]. আবূ দাঊদ, হা/৮৬৪; তিরমিযী, হা/৪১৩; নাসাঈ, হা/৪৬৬; মিশকাত, হা/১৩৩০।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৫০২।

[3]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪৮৯; আবূ দাঊদ, হা/১৩২০, নাসাঈ, হা/১১৩৮; মিশকাত, হা/৮৯৬।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭২৮; তিরমিযী, হা/৪১৫; নাসাঈ, হা/১৮০৬; ইবনু মাজাহ, হা/১১৪১; মিশকাত, হা/১১৫৯ ‘সুন্নাত ছালাতসমূহ ও এর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।

[5]. তিরমিযী, হা/৪৫০, ‘বাড়িতে নফল ছালাত আদায়ের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২১৯; আবূ দাঊদ, হা/১০৪৪।

[6]. তিরমিযী, হা/৪৫১, ‘বাড়িতে নফল ছালাত আদায়ের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-২১৯।

[7]. ছহীহ তারগীব, হা/৪৩৩।

[8]. ইবনু মাজাহ, হা/১৪২৭, ‘ফরয ছালাত আদায়ের স্থানে নফল ছালাত আদায় প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ; আবূ দাঊদ, হা/১০০৬।

[9]. ফিক্বহুস সুন্নাহ, (শতাব্দী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ : ২০১০ খ্রি.), ১/১৬৫।

[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭২৪; মিশকাত, হা/১১৬৩, ‘সুন্নাত ছালাতসমূহ ও এর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।

[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭২৫; মিশকাত, হা/১১৬৪, ‘সুন্নাত ছালাতসমূহ ও এর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।

[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭০৯।

[13]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭২৩।

[14]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭২৪-১৭২৫

[15]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৬০, ‘ফজরের দুই রাকআত সুন্নাতের পর ডান কাতে শোয়া’ অনুচ্ছেদ-২৩।

[16]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮২।

[17]. তিরমিযী, হা/৪৭৮, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/১১৬৯, ‘সুন্নাত ছালাতসমূহ ও এর ফযীলত’ অনুচ্ছেদ-৩০।

[18]. সিলসিলা ছহীহা, হা/১৪৩১।

[19]. সিলসিলা ছহীহা, হা/২৩৪৯।

[20]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮১, ‘যোহরের পূর্বে দুই রাকআত ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৭২৯; মিশকাত, হা/১১৬০।

[21]. আবূ দাঊদ, হা/১২৬৯, ‘যোহরের পূর্বে ও পরে চার রাকআত ছালাত প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ-২৯৬; তিরমিযী, হা/৪২৮; নাসাঈ, হা/১৮১৬; ইবনু মাজাহ, হা/১১৬০, হাদীছ ছহীহ; মিশকাত, হা/১১৬৭।

[22]. আবূ দাঊদ, হা/১২৭১; তিরমিযী, হা/৪৩০, ‘আছরের পূর্বে চার রাকআত’ অনুচ্ছেদ-২০৬; মিশকাত, হা/১১৭০।

[23]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮৩, ‘মাগরিবের পূর্বে ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৫; আবূ দাঊদ, হা/১২৮১; মিশকাত, হা/১১৬৫।

[24]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৩৭; মিশকাত, হা/১১৮০।

[25]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৮৪, ‘মাগরিবের পূর্বে ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৫; মিশকাত, হা/১১৮১।

[26]. জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছালাত (আছ-ছিরাত প্রকাশনী, দ্বিতীয় সংস্করণ), পৃ. ৩১৬-৩২০

[27]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৩০; আবূ দাঊদ; হা/১২৫১; মিশকাত, হা/১১৬২।

[28]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৮৩; মিশকাত, হা/১৩৮১।

[29]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮১, ‘জুমআর পর সুন্নাত ছালাত সম্পর্কে’ অনুচ্ছেদ-১৮; মিশকাত, হা/১১৬৬।

[30]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৮৮২, ‘জুমআর পর সুন্নাত ছালাত সম্পর্কে’ অনুচ্ছেদ-১৮; মিশকাত, হা/১১৬১।

Magazine