কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ওযূর গুরুত্ব ওফযীলত

আল্লাহ তাআলা তার ইবাদতের জন্য আমাদের সৃষ্টি করেছেন। ছালাত ইবাদতের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত, যার জন্য পবিত্রতা অপরিহার্য। পবিত্রতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ওযূ। এর অনেক গুরুত্ব ও ফযীলত রয়েছে। নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে তা তুলে ধরা হলো।

ওযূর গুরুত্ব ও ফযীলত :

(১) ওযূকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন : ওযূর মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা প্রার্থীগণকে এবং যারা পবিত্র থাকে তাদেরকে পসন্দ করেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২২২)

(২) ওযূ ঈমানের অর্ধেক : এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى مَالِكٍ الأَشْعَرِىِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْوُضُوءُ شَطْرُ الإِيمَانِ.

আবু মালিক আল-আশ‘আরী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ওযূ ঈমানের অর্ধেক’।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে, إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ شَطْرُ الإِيمَانِ ‘সুষ্ঠুভাবে ওযূ করা ঈমানের অর্ধেক’।[2] 

(৩) ওযূ ছালাতের চাবি : ওযূ ছাড়া ছালাত আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَلِىٍّ رضي الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِفْتَاحُ الصَّلاَةِ الطُّهُورُ وَتَحْرِيمُهَا التَّكْبِيرُ وَتَحْلِيلُهَا التَّسْلِيمُ.

আলী রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ছালাতের চাবি হলো ওযূ আর ছালাতের ‘তাহরীম’ হলো ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার বলা) এবং তার ‘তাহলীল’ হলো (ছালাতের শেষে) সালাম ফিরানো’।[3] 

(৪) ওযূর মাধ্যমে ছোট পাপ ঝরে যায় : মুমিন বান্দা যখন ছালাতের জন্য ওযূ করে, তখন ওযূর সাথে তার ছোট পাপসমূহ বের হয়ে যায়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عُثْمَانَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِه حَتّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِه.

উছমান রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ওযূ করে এবং উত্তমভাবে ওযূ করে, তার শরীর হতে তার সকল গুনাহ বের হয়ে যায়, এমনকি তার নখের নিচ হতেও তা বের হয়ে যায়’।[4]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ أَوِ الْمُؤْمِنُ فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ المَاء مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خرجت من يَدَيْهِ كل خَطِيئَة بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَ كُلُّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوب.

আবু হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো মুসলিম অথবা মুমিন বান্দা ওযূ করে এবং তার চেহারা ধুয়ে নেয়, তখন তার চেহারা হতে পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে তার চোখের দ্বারা কৃত সকল গুনাহ বের হয়ে যায়, যা সে চোখ দিয়ে দেখেছে। যখন সে তার দুই হাত ধৌত করে, তখন তার দুই হাত দিয়ে করা গুনাহ পানির সাথে বা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায়, যা তার দুই হাত দিয়ে ধরার কারণে সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপভাবে সে যখন তার দুই পা ধৌত করে, তখন তার পা দ্বারা কৃত গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিন্দুর সাথে বের হয়ে যায় যে পাপের জন্য সে দুই পায়ে হেঁটেছে। ফলে সে (ওযূর জায়গা হতে উঠার সময়) সকল গুনাহ হতে পাক-পবিত্র হয়ে যায়’।[5]

(৫) ওযূ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করে : এ মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَلاَ أَدُلُّكُمْ عَلى مَا يَمْحُو اللّهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِه الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوا بَلى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِه وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ.

আবু হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কথা বিষয়ের বলব না, যা দিয়ে আল্লাহ তাআলা তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন এবং মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন? ছাহাবীগণ আবেদন করলেন, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! অবশ্যই। তখন তিনি বললেন, ‘কষ্ট হলেও রযিয়াল্লাহু আনহু পূর্ণভাবে ওযূ করা, মসজিদের দিকে অধিক পদক্ষেপ রাখা এবং এক ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের পর আর এক ওয়াক্ত ছালাতের প্রতীক্ষায় থাকা।[6]

(৬) ওযূ জান্নাত লাভের মাধ্যম : ওযূর মাধ্যমে মুমিন বান্দা জান্নাত লাভ করে। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ওযূ করবে এবং উত্তমভাবে ওযূ করবে, এরপর বলবে-

أَشْهَدُ أَنْ لَّا إِلهَ اِلَّا اللّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُولُه

উচ্চারণ : আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহূ ওয়া রাসূলুহু। অর্থ : ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল’; তাহলে তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে যাবে। এসব দরজার যেটা দিয়ে খুশি সে সেই দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে’।[7]

(৭) ওযূর স্থান দেখে ক্বিয়ামতের দিন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে চিনবেন : ক্বিয়ামতের দিন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমস্ত মানুষের মধ্যে তার উম্মতকে চিনবেন। এ ব্যাপারে ছাহাবীগণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কীভাবে আপনি নূহ আলাইহিস সালাম থেকে আপনার উম্মত পর্যন্ত এতো লোকের মধ্যে আপনার উম্মতকে চিনে নিবেন? উত্তরে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমার উম্মত ওযূর কারণে ধবধবে সাদা কপাল ও ধবধবে হাত-পা বিশিষ্ট হবে, অন্য কোনো উম্মতের মধ্যে এরূপ হবে না’।[8]

(৮) ওযূ করে নিদ্রা যাপনকারীর জন্য ফেরেশতারা দোআ করে : হাদীছে এসেছে,

عن ابن عمر رضي الله عنهما قال قال رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَن باتَ طاهراً باتَ في شِعاره مَلَكٌ، فلا يستيقظُ إلا قال الملَكُ: اللهم اغفِرْ لعبدِك فلانٍ فإنّه باتَ طاهراً.

ইবনে উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় নিদ্রা যাপন করবে, তার সাথে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখন সে পার্শ্ব পরিবর্তন করে, তখন ফেরেশতা বলে, আল্লাহ! এই বান্দাকে ক্ষমা করুন! কেননা সে পবিত্র অবস্থায় নিদ্রা যাপন করেছে’।[9]

(৯) ওযূতে শয়তানের গিঁট খুলে যায় : ঘুম থেকে উঠে ওযূ করলে শয়তানের গিঁট খুলে যায়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رضي الله عنه أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلاَثَ عُقَدٍ يَضْرِبُ كُلَّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيلٌ فَارْقُدْ فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللَّهَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ فَأَصْبَحَ نَشِيطًا طَيِّبَ النَّفْسِ وَإِلاَّ أَصْبَحَ خَبِيثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ.

আবু হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কোনো লোক যখন (রাতে) ঘুমিয়ে যায়, শয়তান তার মাথার পেছনের দিকে তিনটি গিরা লাগায়। প্রত্যেক গিরায় শয়তান তার মনে এ কথার উদ্রেক করে দেয় যে, এখনো অনেক রাত বাকী, কাজেই ঘুমিয়ে থাকো। সে যদি রাতে জেগে উঠে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করে, তাহলে তার (গাফলতির) একটি গিরা খুলে যায়। তারপর সে যদি ওযূ করে (গাফলতির) আরও একটি গিরা খুলে যায়। যদি সে ছালাত আরম্ভ করে, তখন তার তৃতীয় গিরাটিও খুলে যায়। বস্তুত এই লোক পাক-পবিত্র হয়ে ভোরের মুখ দেখে, নতুবা অপবিত্র হয়ে ভোরের দিকে কলুষ অন্তর ও অলস মন নিয়ে উঠে’।[10]

(১০) ওযূ করে নিদ্রা যাপনকারীর দোআ কবুল হয় : হাদীছে এসেছে,

عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَبِيتُ عَلى ذِكْرٍ طَاهِرًا فَيَتَعَارَّ مِنَ اللَّيْل فَيَسْأَلُ اللّهَ خَيْرًا إِلَّا أَعْطَاهُ إِيَّاه .

মুআয ইবনে জাবাল রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে মুসলিম রাত্রে পাক-পবিত্র অবস্থায় আল্লাহর যিকির করে ঘুমিয়ে যায়, তারপর রাত্রে জেগে উঠে আল্লাহর নিকট কল্যাণ কামনা করে, আল্লাহ তাকে (দুনিয়া ও আখেরাতে) অবশ্যই কল্যাণ দান করেন’।[11]

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ওযূর ফযীলত অনেক। পরিপূর্ণভাবে ওযূ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে অশেষ কল্যাণের অধিকারী হওয়া যায়। আল্লাহ যেন আমাদেরকে সুন্দরভাবে ওযূ করে এই ফযীলতগুলো অর্জনের তাওফীক্ব দান করেন- আমীন!

মো. দেলোয়ার হোসেন

আলিম ২য় বর্ষ, চরবাটা ইসমাঈলিয়া আলিম মাদরাসা, সুবর্ণচর, নোয়াখালী।


[1]. তিরমিযী, হা/৩৫১৭; ছহীহ জামে‘ ছাগীর, হা/৭১৫২।

[2]. ইবনে মাজাহ, হা/২৮০; নাসাঈ, হা/২৪৩৭; ছহীহ তারগীব, হা/১।

[3]. আবুদাঊদ, হা/৬১৮; তিরমিযী, হা/৩; মিশকাত, হা/৩১২।

[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫; মিশকাত, হা/২৮৪।

[5]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৪; মিশকাত, হা/২৮৫।

[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫১; মিশকাত, হা/২৮২।

[7]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৪; তিরমিযী, হা/৫৫; মিশকাত, হা/২৮৯।

[8]. আহমাদ, হা/৩১২৩০; মিশকাত, হা/২৯৯।

[9]. ছহীহ তারগীব, হা/৫৯৭।

[10]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৭৬; মিশকাত, হা/১২১৯।

[11]. আবুদাঊদ, হা/৫০৪২; মিশকাত, হা/১২১৫।

 

Magazine