ছালেহীন যেমন ছিলেন
মুসলিম বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও উলামায়ে কেরামের মধ্যে শরীআতের বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েলে মতানৈক্য দেখা যায়। আর এই মতভেদের কারণে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দল ও ফেরকা তৈরি হয়েছে, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ বলেন, وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান, ৩/১০৩)। মহান আল্লাহ আরও বলেন,
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ
‘নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই’ (আল-আনআম,৬/১৫৯)।*
এ জাতীয় বহু প্রমাণ আছে যা দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন করা এবং দলাদলি হতে বিরত থাকা প্রত্যেকের একান্ত কর্তব্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও জ্ঞানীদের মধ্যে বিশেষ কারণবশত মতভেদ থাকতে পারে।
জ্ঞানীদের মধ্যে যে মতানৈক্য দেখা যায়, তার অধিকাংশই ছোটখাটো বা শাখাগত বিষয়। এইসব মতভেদ সম্পূর্ণরূপে মিটানো সম্ভব নয়, তবে কমানো অবশ্যই সম্ভব। এই মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও পরস্পরকে সম্মান করা, সৌজন্যমূলক আচরণ করা, গালমন্দ ও খারাপ সমালোচনা থেকে বিরত থাকা প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়। তাছাড়া মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে মিলেমিশে থাকা যায় এবং এক্ষেত্রে ইসলামের যে শিক্ষা রয়েছে তার আলোকে কীভাবে নিজেদের জীবন গড়া যায়, তা নিয়ে সর্বদা ভাবতে হবে। এ বিষয়ে বিশেষ করে আলেম সমাজকে বেশি ভাবতে হবে এবং উদারতার পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلْكَٰفِرِينَ ‘তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে’ (আল-মায়েদা, ৫/৫৪)। মুমিনের প্রতি নরম আর কাফেরের প্রতি কঠোর আচরণ করা প্রত্যেক
মুমিনের নৈতিক আদর্শ হওয়া যেমনটি ছিল ছাহাবায়ে কেরামের আচরণ। পরস্পরের মধ্যে মুমিনের আচরণ কেমন হবে এবং কাফেরের সাথে সে কেমন ব্যবহার করবে তার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, اَشِدَّاءُ عَلَي الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ ‘তারা কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল’ (আল-ফাতহ, ৪৮/২৯)।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, নিজেদের মধ্যে সামান্য মতভেদকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, কেউ কাউকে একদমই সহ্য করতে পারে না। আর মাযহাবী ক্ষেত্র হলে তো কথাই নেই। সেটা তিক্ততার এমন কঠিন পর্যায়ে চলে যায় যে, তা কোনো অমুসলিমের ক্ষেত্রেও ঘটে না। নিজের মত বা বিশ্বাসকে অভ্রান্ত সত্যের উত্স মনে করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে, তাকেই একমাত্র দ্বীন হিসেবে বিবেচনা করা হয়; যা মোটেও কাম্য নয়। তারা মনে করছে যে, নিজ পথ বা মাযহাবের প্রচার করছে মানে প্রকৃত দ্বীন প্রচার করছে।
নিজের বিশ্বাস বা মাযহাব রক্ষার চেষ্টা করা মানে দ্বীন রক্ষার চেষ্টা করা। এটাই আমাদের দুর্বলতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শরীআতের মাসআলা-মাসায়েল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে মতভেদপূর্ণ মাসআলা কম, কিন্তু এই মতভেদপূর্ণ মাসআলাগুলোই বেশির ভাগ সময় বিজয়ী হয়ে থাকে। সর্বদাই আমরা এসব মাসআলার পেছনে লেগে রয়েছি অথচ শরীআতের আরও অনেক মাসআলা আছে, যাতে কোনো রকম মতপার্থক্য নেই। সেগুলো নিয়ে আমাদের সেরকম আলোচনা হয় না বললেই চলে। কেন এই অবস্থা? যখন এতগুলো বিষয়ে ঐক্য রয়েছে। তখন আংশিক বিষয়গুলোতে কেন ঐক্য হয় না? ইখতিলাফী বিষয়গুলো কেন সর্বদা প্রাধান্য পাচ্ছে? এসব বিষয় সব সময় কেন আমাদের মস্তিষ্কে ও সমাজে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে?
‘আদাবুল খেলাফ’ অর্থাৎ মতভেদের আদব সম্পর্কে অনেক লেখনি, প্রবন্ধ, বই ইত্যাদি লেখা হয়েছে। এই বিষয়ের মূলকথা এই যে, একে অপরের সাথে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও পরস্পরকে সম্মান করতে হবে, ভালোবাসা বজায় রাখতে হবে, মিলেমিশে থাকতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে, পরামর্শ দিতে ও নিতে হবে ইত্যাদি। এসব বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়।
এর অনেক দৃষ্টান্ত স্বর্ণ যুগ থেকে আজ পর্যন্ত হাদীছের পাতায়, ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়।[1]
কতিপয় উদাহরণসমূহ :
(১) উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতভেদ : উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দুজনেই বিখ্যাত ছাহাবী ছিলেন। ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলছেন যে, দুজনের মধ্যে ১০০টিরও অধিক বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। চিন্তা করুন! ১০০টিরও অধিক বিষয়ে মতভেদ ছিল, কিন্তু তারা কি পরস্পর ঝগড়া করতেন? অশালীন সমালোচনা করতেন? পরস্পরে ঘৃণা করতেন? না, কখনোই না। তাদের জীবনীতে লেখা রয়েছে, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সম্পর্কে বলতেন যে, كَنِيفٌ مُلِئَ عِلْمًا آثَرْتُ بِهِ أَهْلَ الْقَادِسِيَّةِ ‘তিনি (ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু) হচ্ছেন ইলমের আশ্রয়স্থল, আমি তাঁর কারণেই কাদেসিয়াবাসীদের প্রতি প্রভাবিত হয়েছি’।[2]
শত মতভেদ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তার জ্ঞানের প্রশংসা করছেন। অপরদিকে ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যুর পর বলতেন,
إِنَّ عُمَرَ كَانَ لِلْإِسْلَامِ حِصْنًا حَصِينًا يَدْخُلُ فِيهِ الْإِسْلَامُ وَلَا يَخْرُجُ مِنْهُ فَلَمَّا قُتِلَ عُمَرُ انْثَلَمَ الْحِصْنُ فَالْإِسْلَامُ يَخْرُجُ مِنْهُ وَلَا يَدْخُلُ فِيهِ
‘উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ইসলামের এক অতি মযবূত দূর্গ, তার মাধ্যমে ইসলাম (বিভিন্ন স্থানে) প্রবেশ করেছিল কিন্তু কখনোও (সে স্থানগুলো থেকে) ইসলাম বের হয়নি। যখন তিনি শহীদ হয়ে গেলেন, তখন সে দূর্গ ভেঙে গেল, ফলে সেখান থেকে ইসলাম বেরিয়ে গেল আর প্রবেশ করল না’।[3] এই ছিল তাদের পরস্পর ভালোবাসা ও সম্মানের দৃষ্টান্ত। আজ আমরা কোথায়?
(২) যায়েদ ইবনু ছাবিত ও আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মতভেদ : আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুসহ অনেক ছাহাবীর মতোই ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মত ছিল যে, পিতার উপস্থিতিতে যেমন মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকার থেকে ভাই-বোন বঞ্চিত হয়ে যায়, ঠিক তেমনি দাদার উপস্থিতিতেও ভাই-বোন বঞ্চিত হয়ে যাবে। কিন্তু যায়েদ ইবনু ছাবিতসহ অন্যান্য ছাহাবীর মত ছিল, দাদার উপস্থিতিতে ভাই-বোনের অংশ বলবৎ থাকবে।
একদিন ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার! যায়েদের আল্লাহর ভয় হয় না? পৌত্র (পোতা)-কে পুত্রের স্থান দিচ্ছে কিন্তু দাদাকে পিতার স্থান দেয় না!
তবুও দেখুন, পরস্পরের ভালোবাসা ও সম্মান। একদা ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু যায়েদ ইবনু ছাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে আরোহণ অবস্থায় দেখলেন। তারপর ইবনু আব্বাস যায়েদ ইবনু ছাবিতের পশুর লাগাম ধরে চলতে লাগলেন। তাঁকে লাগাম ছাড়তে বলা হলে, তিনি বললেন, উলামা ও বড়দের সাথে আমাদের এ ধরনের আচরণ করতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। এবার যায়েদ ইবনু ছাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আপনার হাতটা আমাকে একটু দেখাবেন? সঙ্গে সঙ্গে ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের হাতখানা বের করে দেখালেন। দেখামাত্রই যায়েদ ইবনু ছাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তার হাতে চুমু দিয়ে বলেন, আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আহলে বায়েতের সাথে এ ধরনের আচরণ করতে বলা হয়েছে।
এছাড়া যখন যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যু হয়, তখন ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, এভাবেই জ্ঞান শেষ হয়ে যাবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, এভাবেই ইলম শেষ হয়ে যায়, আজকে অনেক জ্ঞান দাফন করা হলো।
এই ছিল ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসা ও সম্মানের দৃষ্টান্ত। ছাহাবীগণের এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
তাওহীদুর রহমান ইবনু মঈনুল হক্ব
* শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বানারাস, ভারত।
[1]. শায়খ আসআদ আ‘জামী হাফিযাহুল্লাহ (শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বানারাস, ভারত)-এর লেখনী থেকে নেওয়া কিছু অংশ।
[2]. তারিখে দেমাশক, ৩৩/১৪৫।
[3]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/৩১৩৫৫।