পৃথিবীর সকলেই চায় মুক্ত বিচরণ। চায় স্বাধীনতা। পরাধীনতার শিকল ছিন্ন করে মুক্তাকাশে বিচরণ করা সকলের কাম্য ও প্রবল বাসনা। ইতিহাস সাক্ষী, ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আলেম সমাজের অবদান অতুলনীয়। যা কখনো অস্বীকার করার মতো নয়। জাতির উত্থান-পতনের সভ্যতা বিনির্মাণে আলেম সমাজের দায়িত্ব সর্বযুগেই অপরিসীম। যা পৃথিবীর ইতিহাসে মোহরাঙ্কিত হয়ে আছে। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থান্বেষী মহলের মুখোশ উন্মোচন করে জাতিকে সর্বদা সচেতন রাখতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সোচ্চার সংগ্রামী আলেম সমাজ। স্বাধীনতার জন্য আলেমসমাজ নির্দ্বিধায় জীবন বিসর্জন দিতেও দ্বিধাবোধ করেন না। কখনো সংকোচ, সংশয়বোধ করেন না কারাবরণ কিংবা শত্রুর দুরভিসন্ধির। যদি আলেম সমাজ এ দেশের স্বাধীনতায় সংগ্রামী ভূমিকা পালন না করত, তাহলে বাংলার স্বাধীনতা এত সহজে আসতো না। আলেমসমাজ আছে বলেই ওই বন্ধুপ্রতীম (!) দেশ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও পারছে না ভোগ করতে। কারণ-
আলেম সমাজের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত আছে মর্দে মুজাহিদের তাজা খুন। অন্যায়-অবিচার, যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মূর্ত আতঙ্ক আলেম সমাজ। আমরা দেখতে পাই ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আলেম সমাজের দৃঢ় চেতনা ও দুর্বার গতি। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ বিশাল সাগরের গর্জনের বিরুদ্ধে হিমালয় পাহাড়ের মতো অবিচল আত্মবিশ্বাস, আস্থা এবং চেতনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি তাদেরকেই। দীপ্ত মশাল জ্বালিয়ে অন্যায়, যুলম ও অবিচারের বিরুদ্ধে মর্দে মুজাহিদের মতো রুখে দাঁড়ান আলেমসমাজই। সময়ের দাবিতে আলেম সমাজ কখনো বিপ্লবী বক্তব্য, ক্ষুরধার লেখনী, সভা-সেমিনার বিভিন্ন প্রকাশনা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য স্বাধীনতা। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক আল্লামা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলবী রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে পাহাড়সম দৃঢ় চেতা আর দুর্বার সাহসের এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন শায়খুল হিন্দ শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছে দেহলবী রহিমাহুল্লাহ। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তার ফৎওয়া ছিল সারা দুনিয়াজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী। ফলে মানুষ তার ফতওয়ায় আকৃষ্ট হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চালায়। জন্ম নেয় ইতিহাসের ইতিহাস। ব্রিটিশ শাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জন্ম নেয় জিহাদী আন্দোলন। গড়ে উঠে ঐক্য। ইতিহাসে আবির্ভাব হয় শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুজাহিদ শাহ ইসমাঈল শহীদ রহিমাহুল্লাহ। ১৮৩১ সালে বালাকোটের প্রাঙ্গণে শাহ ইসমাঈল শহীদ জীবন উৎসর্গ করে পৃথিবীর এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন। যা কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক মানব মনের গহীনে অনুপ্রেরণার চেরাগ জ্বালাবে। শাহ সাহেবের এই আপসহীন ফতওয়ার প্রভাব বাংলায় পড়ার কারণে বাংলার ইতিহাসেও জন্ম নেয় বীর সন্তান মাওলানা হাজী শরীয়ত উল্লাহ, নিসার আলী তিতুমীর, টিপু সুলতান রহিমাহুমুল্লাহ সহ অনেকে। যাদের একেকটি নাম একেকটি জীবন্ত ইতিহাস। একেকটি গর্ব ও অহংকারের বিজয়ী নাম। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য এই মর্দে মুজাহিদের গর্জে ওঠায় বৃটিশ বেনিয়ারা আতঙ্কিত হয়। ফলে মুজাহিদদের এই উত্তাল তরঙ্গমালাকে স্তমিত করার জন্য বৃটিশ বেনিয়ারা চালায় অসহনীয় নির্যাতনের স্টিম রোলার, জেল আর যুলম। অনেককে ঝুলায় ফাঁসির কাষ্ঠে । তবুও আপসহীন এই আলেম সমাজ তাদের সাথে আপস করেননি। বরং তারা হাসিমুখে শহীদী মর্যাদা লাভের আশায় আল্লাহর রাহে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। মূলত ১৭৫৭ সালের পলাশীর ট্রাজেডিতে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় মীর জাফরদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। পলাশীর ঐ ট্রাজেডির পর যখন ইংরেজরা উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করল, তখন এর তীব্র প্রতিবাদ করেন আল্লামা শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলবী রহিমাহুল্লাহ ও তার ছেলে শাহ আব্দুল আযীয দেহলবী রহিমাহুল্লাহ। ইতিহাসের পাতা লক্ষ আলেমের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়ে আছে। খোদ দিল্লিতেই ৫০০ আলেমকে ফাঁসি দেয় ইংরেজরা। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ লক্ষ মুসলিম শহীদ হয়। এমনকি শেরশাহ গ্ৰান্ড ট্যাংক রোডের দু’পাশের এমন কোনো গাছ ছিল না, যেখানে কোনো আলেমের লাশ ঝুলেনি। সত্যিই আজকে সেই বর্বর ইতিহাস স্মরণ করলে শরীরের লোম শিউরে উঠে। ১৮৩১ সালের বালাকোটের যুদ্ধে শাহ ইসমাঈল শহীদের শাহাদাত বরণের পর আর্বিভাব হয় ইতিহাসখ্যাত জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মাওলানা এনায়েত আলী ও মাওলানা বেলায়েত আলীর। ইতিহাস খুব গৌরব অর্জন করেছে এ সকল মর্দে মুজাহিদের নাম লিপিবদ্ধ করে। ভারতীয় উপমহাদেশের বুক থেকে ইংরেজদের চিরতরে বিদায় দেওয়ার জন্য বাংলার সুযোগ্য সন্তান ও বীর মুজাহিদ টিপু সুলতানও কিন্তু কম প্রচেষ্টা চালাননি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অবিরাম প্রচেষ্টা চালান ইংরেজদের বিরুদ্ধে। জাতি আজ তাদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের দুর্বার চেতনা ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে মুক্ত বিচরণের মহান লক্ষ্যে বাংলায়ও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। মাওলানা হাজী শরীয়ত উল্লাহ ফরায়েজীর আহ্বানে যাত্রা হয় ফরায়েজী আন্দোলন। মূলত এ আন্দোলনের কারণ হলো ইংরেজদের ইসলামবিদ্বেষী রীতি-রেওয়াজ ও ধর্ম পালনে হস্তক্ষেপ। হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্ব ইতিহাসের পাতায় রচিত হয় আরেকটি নতুন অধ্যায়। জন্ম নেয় বাঁশের কেল্লা খ্যাত মর্দে মুজাহিদ, স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক সাইয়েদ নেসার আলী তিতুমীর। জিহাদী আন্দোলনের তিতুমীর বাংলার প্রথম শহীদ। ইতিহাসের চাকা ঘুরে বাংলার আকাশে আবির্ভাব হন মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা আব্দুল হামীদ খান ভাসানী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা আব্দুল্লাহেল কাফী আল-কোরায়শী রহিমাহুমুল্লাহসহ অনেকে। তাদের নিরলস ত্যাগ-তীতিক্ষা আর আপসহীন সংগ্ৰামী চেতনায় পৃথিবীর মানচিত্রে শির উঁচু করে দাঁড়ায় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। তাদের প্রত্যেকের একেকটি জীবন একেকটি ইতিহাস। এ সময়ে বাংলার মানুষের গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশ হয়। যেমন: সেবক, যামানা, এছলাম, সত্যাগ্ৰহী। যেগুলোতে তাদের তেজদীপ্ত চেতনার ক্ষুরধার লেখনী প্রকাশিত হয়। ফলে তারা ইংরেজদের রোষানলে পড়েন। জীবনের ভয় তারা কভু করেননি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন উন্মুক্ত তরবারি। আমরা আজকের প্রবন্ধের ইতি টানব মাত্র দু’টি ঘটনা পেশ করার মাধ্যমে। যাদের এই চেতনাময়ী বীরত্ব আমাদের জীবন চলার পথে উৎসাহিত করবে।
(১) ১৯৭৬ সালের ১৮ এপ্রিল। এ দেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, নিবেদিতপ্রাণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অকুতোভয় বীর সেনানী মাওলানা আব্দুল হামীদ খান ভাসানী (১৮৮০-১৯৭৬) ফারাক্কা বাঁধ সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে উদাত্ত আহ্বান জানান। ইন্দিরা গান্ধী আশ্বাস দেওয়ার পরও ব্যবস্থা নেননি। এতে ভাসানী সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে গণআন্দোলনের ডাক দেন। বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে দেশপ্রেমিক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মর্দে মুজাহিদ রুখে দাঁড়ান। তিনি ফারাক্কা বাঁধের সমস্যায় ভারতের এ দেশের মযলূম জনতার উদ্দেশ্যে চাঁপাই নবাবগঞ্জের কানসাটে লং মার্চে বিশাল জনসমুদ্রে জোরালো বক্তব্য পেশ করেন। সেদিন হাজারো জনতার মুখে শ্লোগান ছিল— ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেও, উড়িয়ে দেও, পানির ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের হিস্যার ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে ভারত সরকারকে বাধ্য করাই আমাদের আন্দোলন। আমি জানি এখানেই শেষ নয়। ভারত সরকারের জানা উচিত, বাংলাদেশীরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকেও পরোয়া করে না। যে কোনো হামলা থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করা আমাদের প্রকৃত দেশপ্রেম এবং অধিকার।
(২) মুসলিম সাংবাদিকতার জনক বলা হয় মাওলানা আকরাম খাঁ-কে। যখন তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন, বাংলার জনগণকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুললেন, ক্ষুরধার লেখনীতে যখন সত্যের আলো চমকাতে লাগল, তখন ইংরেজরা এই মর্দে মুজাহিদ পরহেযগার ব্যক্তিকে অনেক টাকার প্রলোভন দেখিয়ে পত্রিকায় না লেখার জন্য করজোড়ে অনুরোধ করে। মর্দে মুজাহিদ, দেশপ্রেমিক, ঈমান বিক্রি করে দেওয়ার মতো দামাল সন্তান নন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ‘না’ প্রতিউত্তর জানালে ইংরেজরা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। এমনকি তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। তিনি হুংকার দিয়ে বলেন, দেখুন জনাব! আমি জীবনে বহুবার শিকার করেছি। বন্দুকের গুলিতে অনেক পাখি মেরেছি। আমার প্রতি গুলি নিক্ষেপ করা হলে আমি হয়তো মারা যেতে পারি এটা ভালো করে জানি। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই জানবেন! আমাকে বন্দুকের গুলিতে নিহত করা হলে আমার দেহের প্রত্যেক রক্তবিন্দু ফোঁটা হতে বাংলার বুকে তত জন আকরাম খাঁ পুনর্বার জন্ম হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আলেম সমাজ জাতির হৃদয়ের স্পন্দন। অন্যায়-অবিচার, যুলম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক মূর্ত আতঙ্ক। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের এক অতন্দ্র প্রহরী। দেশ ও জাতির উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণের এক অনন্য কাণ্ডারী। সোনার মানুষ গঠনের শৈল্পিক কারিগর। তাই আলেম সমাজকে সম্মান করাই মূলত প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়।
মাযহারুল ইসলাম
অধ্যয়নরত, দাওরায়ে হাদীছ, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।