২০২৫ সালের ১৩ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত সময়কালে বিশ্ব এক নাটকীয় ও রক্তাক্ত দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়, যখন ইসরাঈল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ইরানের বিরুদ্ধে তিনটি বিস্তৃত সামরিক অভিযান চালায়। এই অভিযানের নাম ছিল যথাক্রমে—অপারেশন নার্নিয়া, অপারেশন রাইজিং লায়ন এবং অপারেশন মিডনাইট হ্যামার।
বিশেষ করে ‘অপারেশন নার্নিয়া’ ছিল মোসাদের দীর্ঘ ১৫ বছরের পরিকল্পনার ফসল। এর মূল লক্ষ্য ছিল—ইরানের পরমাণু কর্মসূচির মূল বিজ্ঞানীদের গোপনে হত্যা করে দেশটির পারমাণবিক সক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যস্ত করা। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক সফলতার পর ড. কাদের খান তাঁর প্রযুক্তিগত চক্রের মাধ্যমে ইরানসহ অন্তত আটটি রাষ্ট্রে সেন্ট্রিফিউজ ডিজাইন ও পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহ করেন। ২০০৩ সালে লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করতে নিজের পারমাণবিক কর্মসূচি ত্যাগ করেন এবং সেই সূত্রে ইরানের গোপন কর্মসূচির তথ্য প্রকাশ পায়। এরপর থেকেই ইসরাঈলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ একটি বিস্তৃত গুপ্তচর নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে এবং বিজ্ঞানীদের গতিবিধি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করে।
২০২৫ সালের ১৩ জুন, এই গুপ্তচরবৃত্তির চূড়ান্ত রূপ নেয় অপারেশন নার্নিয়া-তে। তেহরানে একযোগে ৯ জন শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। এর কিছুদিন পর ইসরাঈল শুরু করে অপারেশন রাইজিং লায়ন, যার লক্ষ্য ছিল ইরানের সামরিক ঘাঁটি ও পরমাণু স্থাপনাগুলিতে হামলা, শীর্ষ সামরিক নেতাদের হত্যা ও কৌশলগত সুবিধা অর্জন।
২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে তাদের হামলা—অপারেশন মিডনাইট হ্যামার—যার আওতায় ইউএস এয়ার ফোর্স এবং নেভি ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনায় বিমান হামলা চালায়। এসব হামলার ফলে নাতাঞ্জ, ফোরদো ও ইসফাহানের মতো প্রধান পরমাণু স্থাপনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইরানের তেল ও গ্যাস অবকাঠামোতেও অগ্নিকাণ্ড ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে।
এদিকে ইরানও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩ বা ‘ওয়াদা-ই-সাদিক’ নামে ইসরাঈলের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
ইসরাঈলি ও মার্কিন অভিযানে ইরানে প্রাণ হারায় প্রায় ৯৩৫ জন, যার মধ্যে ৩৮ শিশু ও ১৩২ নারী অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা রাযিয়াল্লাহু আনহুমাRছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরাযিয়াল্লাহু আনহুমছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিসেবে নিহতের সংখ্যা ১,১৯০ জন, যার মধ্যে ৪৩৬ জন বেসামরিক নাগরিক, ৪৩৫ জন সামরিক সদস্য এবং ৩১৯ জনের পরিচয় অজ্ঞাত। আহতের সংখ্যা ৩,৪৫০ থেকে ৪,৭৫০-এর মধ্যে।
অন্যদিকে, ইরানের হামলায় ইসরাঈলে নিহত হয় মাত্র ২৯ জন, যার মধ্যে ২৮ জনই বেসামরিক নাগরিক। আহত হয় ৩,২৩৮ জন। তাদের মধ্যে ২৩ জন গুরুতর, ১১১ জন মাঝারি এবং প্রায় ২,৯০০ জন হালকা আহত। ইসরাঈলি সূত্র মতে, ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেশটির ৫ বিলিয়ন শেকেল (প্রায় ১.৪৭ বিলিয়ন ডলার) মূল্যের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া যুদ্ধজনিত সর্বমোট ব্যয় ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকরা ৩৮,৭০০টি ক্ষতিপূরণ আবেদন জমা দিয়েছেন।
ইসরাঈলি হামলায় ইরানের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক নেতৃবৃন্দ—জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি এবং কুদস ফোর্সের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিহত হন। তাছাড়া ইরানের প্রায় ৬৫% ব্যালিস্টিক মিসাইল লঞ্চার ও ৮০০–১,০০০ মিসাইল ধ্বংস করা হয় বলে ইসরাঈল দাবি করেছে।
এই যুদ্ধে ইরান সামরিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়লেও, রাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে ইসরাঈল ও পশ্চিমা জোটের দুর্বলতা উন্মোচিত হয়। গোয়েন্দা ব্যর্থতা, প্রচার-যুদ্ধের বিভ্রান্তি এবং আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাঈলের সহানুভূতির অভাব—সবই এ যুদ্ধের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিশ্ব রাজনীতিতে এ যুদ্ধ এক নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রকাশ্যেই ইসরাঈলের পক্ষ নেয়, পক্ষান্তরে রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া ও মুসলিমবিশ্বের বড় একটি অংশ ইরানকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জানায়। এই বৈপরীত্য শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, কূটনৈতিক অঙ্গনেও নতুন উত্তেজনার জন্ম দেয়।
সবশেষে, এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে—শুধু সামরিক শক্তি নয়, বরং নৈতিকতা, প্রতিরোধ এবং জনসমর্থনও যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। ইরান যেখানে জ্বলন্ত আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের মশাল উঁচিয়ে ধরেছে, সেখানে পশ্চিমা বিশ্বের নৈতিক অবস্থান এক গভীর প্রশ্নের মুখে।