আল্লাহর নাম ও গুণাবলির গুরুত্ব ও ফযীলত:
কুরআনুল কারীমে সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ আয়াত ও সূরাগুলো মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলিতে পরিপূর্ণ। যেমন- সূরা ইখলাছের ক্ষেত্রে বলা হয়, এটি কুরআন মাজীদের এক-তৃতীয়াংশের সমান তথা কেউ যদি সূরা ইখলাছ একবার পড়ে, তাহলে সে কুরআন মাজীদের এক-তৃতীয়াংশ শেষ করল আর কেউ যদি সূরা ইখলাছ তিনবার পড়ে শেষ করে, তাহলে সে কুরআন মাজীদ সম্পূর্ণটাই শেষ করল। সূরা ইখলাছের মতো ছোট্ট সূরা হওয়ার পরও এত বেশি ফযীলতের কারণ হলো এই সূরাটি মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলি সমৃদ্ধ একটি সূরা। পুরো সূরাতে শুধু মহান আল্লাহর নাম, গুণাবলি ও পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে।
ঠিক তেমনি আয়াতুল কুরসীর ফযীলত আমরা জানি, কেউ যদি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের পরে আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, তাহলে তার জান্নাতে যাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা হলো তার মৃত্যু। কেউ যদি রাতে ঘুমানোর সময় আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, তাহলে তার শয্যাপাশে একজন ফেরেশতা দায়িত্বরত থাকেন। আয়াতুল কুরসীকে কুরআন মাজীদের সবচেয়ে মহান সূরা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আয়াতুল কুরসীর এত বিশাল ফযীলতের অন্যতম কারণ হচ্ছে- এই আয়াতটি মহান আল্লাহর নাম, গুণাবলি ও পরিচয় সমৃদ্ধ।
আল্লাহর নামের এত ক্ষমতা যে, শুধু আল্লাহর নামে শয়তান মাছির মতো ক্ষুদ্র হয়ে পলায়ন করে। শুধু আল্লাহর নামে যবেহকৃত প্রাণী হালাল হিসেবে গণ্য হয়। শুধু আল্লাহর নামে কোনো কিছু করলে, যেমন- খাবার গ্রহণ করলে, সেটি বরকতময় হয়। আল্লাহর নাম উচ্চারিত না হলে, খাবারে শয়তান অংশগ্রহণ করে, বাড়িতে শয়তান বসবাস করে।
দুনিয়াতে তাসবীহ ও যিকিরের ক্ষেত্রে যত ধরনের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তার সবই আল্লাহর নাম ও গুণের ফযীলত। কেননা তাসবীহ ও যিকির মূলত আল্লাহর নামের উচ্চারণ, আল্লাহর বড়ত্ব, মাহাত্ম্য ও বিভিন্ন গুণাবলির স্বীকৃতি।
মহান আল্লাহর ৯৯টি নাম কেউ যদি আয়ত্ত করে নেয়, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
দলীলসমূহ:
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا، مِائَةً إِلَّا وَاحِدًا، مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর ৯৯টি নাম রয়েছে, ১০০ থেকে ১ কম; যে ব্যক্তি এগুলো হিফয করে (মুখস্থ, অনুধাবন ও আমল করে), সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[1] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ قَرَأَ آيَةَ الْكُرْسِيِّ دُبُرَ كُلِّ صَلَاةٍ مَكْتُوبَةٍ، لَمْ يَمْنَعْهُ مِنْ دُخُولِ الْجَنَّةِ إِلَّا أَنْ يَمُوتَ ‘যে ব্যক্তি ফরয ছালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই বাধা দিতে পারে না’।[2] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ تَعْدِلُ ثُلُثَ ٱلْقُرْآنِ ‘সূরা ইখলাছ কুরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমতুল্য’।[3] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ قَالَ بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ، فِي الْأَرْضِ، وَلَا فِي السَّمَاءِ، وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ، ثَلَاثَ مَرَّاتٍ، لَمْ تُصِبْهُ فَجْأَةُ بَلَاءٍ ‘যে ব্যক্তি তিনবার বলবে, بِسْمِ اللهِ الَّذِي لَا يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ، وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ অর্থাৎ আমি মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি, যার নাম থাকলে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই আমার কোনো ক্ষতি পারবে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। এই দু‘আ তিনবার পড়লে সে হঠাৎ ক্ষতির সম্মুখীন হবে না’।[4]
আল্লাহরনামেরইবাদত:
আমরা পূর্বের আলোচনায় দেখেছি, আল্লাহর নাম আয়ত্ত করার ফযীলত। অনেকেই মনে করে শুধু নাম মুখস্থ করলেই সে ফযীলত পাওয়া যাবে, কিন্তু এটি ভুল ধারণা। শুধু নাম মুখস্থ করলেই হবে না, বরং সেই নামের উপর ইবাদত করাও জানতে হবে। আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ইবাদতই মূলত আল্লাহর নাম ও গুণাবলিকে আয়ত্ত করা। আমরা কয়েকভাবে মহান আল্লাহর নামের উপর ইবাদত করতে পারি।
মুখস্থ করা ও সেই নামে দু‘আ করা:
ইবাদতের প্রথম স্তর হচ্ছে আল্লাহর নামগুলো মুখস্থ করা। কেননা মুখস্থ না করলে নামগুলো কোনো কাজেই লাগানো যাবে না। মুখস্থ করার পর নামের অর্থগুলো বুঝার চেষ্টা করতে হবে। নামের অর্থগুলো বুঝলে সেই অনুযায়ী মহান আল্লাহর নিকট এই সমস্ত নাম ব্যবহার করে দু‘আ করতে হবে। যেমন- কারো যদি রিযিকের দরকার হয়, তাহলে সে বলবে, হে রাযযাক! আপনি আমাকে রিযিক দেন; কারো যদি ক্ষমার দরকার হয়, তাহলে সে বলবে, হে গাফফার! আপনি আমাকে ক্ষমা করুন; কারো যদি দয়ার দরকার হয়, তাহলে সে বলবে, হে রহমান! হে রহীম! আমাদের উপর দয়া করুন; হে মুগীছ! বিপদ থেকে উদ্ধারকারী! আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করুন! এভাবে নামের অর্থের সাথে মিল রেখে সেই সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় চাওয়ার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সেই নামের অসীলা দিয়ে দু‘আ করতে হবে।
আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়া:
আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ইবাদতের অন্যতম আরেকটি বিষয় হচ্ছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলির প্রভাব নিজের জীবনে প্রতিফলিত করা। আর এটি দুইভাবে হতে পারে— প্রথমত, আল্লাহর নাম ও গুণাবলি অনুযায়ী নিজের স্বভাব-চরিত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসা। যেমন- মহান আল্লাহ সবকিছু শুনেন—এই গুণে পরিপূর্ণ বিশ্বাসের মাধ্যমে আমরা কল্পনা করব, মহান আল্লাহ যেহেতু আমাদের সকল কথা শুনছেন, সেহেতু আমি যদি কোনো অশ্লীল কথা বা মিথ্যা কথা বলি সেটিও তিনি শুনবেন। অতএব, আমি আজ থেকে আর মিথ্যা বা অশ্লীল কথা বলব না। আল্লাহর গুণাবলিকে সবসময়ের জন্য স্মরণে রেখে নিজের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে এই ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসাই আল্লাহর নামের ইবাদত। ঠিক তেমনি মহান আল্লাহ সবকিছু দেখেন। অতএব, রাতের অন্ধকারে বা লোকচক্ষুর আড়ালে কোনো কিছু করলে সেটি আল্লাহর দৃষ্টির আড়াল হয় না। তাই মহান আল্লাহর এই গুণকে সামনে রেখে যখন আমরা গোপন গুনাহ পরিত্যাগ করি, তখনই সেটি হয় মহান আল্লাহর গুণের ইবাদত।
দ্বিতীয়ত, মহান আল্লাহর যে গুণগুলো মানুষের জন্য অর্জন করা সম্ভব, সে গুণগুলো অর্জন করার চেষ্টা করা। যেমন- মহান আল্লাহ দয়ালু, মানুষেরও উচিত দয়া করার চেষ্টা করা। মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল, মানুষেরও উচিত ক্ষমা করার চেষ্টা করা। মানুষ যখন মানুষকে ক্ষমা করতে শিখবে, তখন মহান আল্লাহ তাকে এমনিতেই ক্ষমা করে দিবেন। মানুষ যখন সকল সৃষ্টির উপর দয়া করতে শিখবে, তখন মহান আল্লাহও তার উপর দয়া করবেন। মানুষ যখন অন্যের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিবে, তখন মহান আল্লাহ তাকে আরও বেশি রিযিক দিবেন। মানুষ যখন অন্যের দোষ দেখার পরও সেটি ঢেকে রাখবে, তখন আল্লাহ তাআলাও মানুষের দোষ ঢেকে রাখবেন, তাকে অপমানিত করবেন না। এভাবে আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়াও মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলির ইবাদত।
দলীলসমূহ:
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ يَقُولُ فِي دُعَائِهِ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ...
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দু‘আর মধ্যে বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে তোমার সেই সকল নামের অসীলা প্রার্থনা করছি, যেসব তুমি নিজের জন্য রেখেছ অথবা তোমার কিতাবে অবতীর্ণ করেছ অথবা তোমার কোনো বান্দাকে শিক্ষা দিয়েছ অথবা তোমার কাছে গায়েবী জ্ঞানে সংরক্ষিত রেখেছ...’।[5]
আল্লাহ নামে ইলহাদ কাবীরা গুনাহ:
ইলহাদ মূলত চার প্রকার—
১. আল্লাহর কোনো নাম অথবা তাঁর অন্তর্নিহিত গুণ ও নির্দেশ অস্বীকার করা। যেমন- একদল মানুষ মহান আল্লাহর আসমানে আরশে ওঠাকে অস্বীকার করে।
২. আল্লাহর নামকে সৃষ্টির গুণের সাথে তুলনা করা (তাশবীহ)। মনে রাখতে হবে, মানুষও শ্রবণ করে, আল্লাহও শ্রবণ করেন; তবে আল্লাহর শ্রবণ সম্পূর্ণ ভিন্ন, যা ধারণা করাও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
৩. আল্লাহকে এমন নামে ডাকা, যা তিনি নিজেকে বলেননি, যেমন- খ্রিষ্টানরা আল্লাহকে ‘পিতা’ (الأب) বলে ডাকে, দার্শনিকরা আল্লাহর নাম দিয়েছে ‘কার্যকারণের সৃষ্টিকর্তা’ (العلة الفاعلة)। আল্লাহর নামসমূহ তাওকীফী অর্থাৎ শুধু কুরআন ও হাদীছ দ্বারা নির্ধারিত। নিজের পক্ষ থেকে কোনো নাম আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা বিকৃতি ও সীমালঙ্ঘন।
৪. আল্লাহর নাম থেকে অন্য কারো নামকরণ করা। যেমন- العزيز (আল-আযীয) থেকে মূর্তির নাম বানানো العزى (আল-উযযা), الإله (আল্লাহ) থেকে বানানো اللات। ঠিক তেমনি কারো নাম গাউছুল আ‘যম, মুশকিল কুশা, শাহজাহান রাখা।
(ইন-শা-আল্লাহ চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৩৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৭।
[2]. নাসাঈ, হা/৯৯২, ‘হাসান’; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৫৯৫।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৮১১।
[4]. আবূ দাঊদ, হা/৫০৮৮; তিরমিযী, হা/৩৩৮৮, ‘হাসান ছহীহ’।
[5]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৯৭১।
[6]. বাদাইউল ফাওয়ায়েদ, ১/১৬৩-১৬৪।
