মানবের কল্যাণে আল্লাহ তাআলা কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআনে রয়েছে ১১৪টি সূরা এবং ৬২৩৬টি আয়াত। হাদীছে কিছু সূরা ও আয়াতের বিভিন্ন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্যে সূরা আল-বাক্বারার ১৫৫ নং আয়াত রয়েছে, যেটি কুরআনের সবচেয়ে বেশি ফযীলতপূর্ণ আয়াত যাকে ‘আয়াতুল কুরসী’ বলা হয়। হাদীছে আয়াতুল কুরসীর অনেক ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে সে সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা হলো।
আবূ উমামা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয ছালাতের পরে ‘আয়াতুল কুরসী’ পাঠ করবে, সে ব্যক্তির জন্য তার মৃত্যু ছাড়া আর অন্য কিছু জান্নাতে প্রবেশের পথে বাধা নেই।[1] হাদীছে এসেছে,
عَنْ أُبَىِّ بْنِ كَعْبٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «يَا أَبَا الْمُنْذِرِ أَتَدْرِى أَىُّ آيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ مَعَكَ أَعْظَمُ». قَالَ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ «يَا أَبَا الْمُنْذِرِ أَتَدْرِى أَىُّ آيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللَّهِ مَعَكَ أَعْظَمُ». قَالَ قُلْتُ اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ. قَالَ فَضَرَبَ فِى صَدْرِى وَقَالَ «وَاللَّهِ لِيَهْنِكَ الْعِلْمُ أَبَا الْمُنْذِرِ».
উবাই ইবনু কা‘ব রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, হে আবুল মুনযির! তোমার কাছে আল্লাহর কিতাবের কোন আয়াতটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি আবার বলেন, হে আবুল মুনযির! তোমার কাছে আল্লাহর কিতাবের কোন আয়াতটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ? আমি বললাম, ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূম’ (আয়াতুল কুরসী)। তখন তিনি আমার বুকে (হালকা) আঘাত করে বলেন, হে আবুল মুনযির! তোমার জ্ঞান আনন্দদায়ক হোক।[2]
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি বস্তুরই চূড়া আছে। কুরআনের সর্বোচ্চ চূড়া হলো সূরা আল-বাক্বারা। এতে এমন একটি আয়াত আছে, যা কুরআনের আয়াতসমূহের প্রধান। তা হলো আয়াতুল কুরসী।[3]
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (একবার) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রামাযানের যাকাত (ফেত্বরার মাল-ধন) দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। বস্তুত (আমি পাহারা দিচ্ছিলাম ইত্যবসরে) একজন আগমনকারী এসে আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং বললাম, ‘তোকে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে পেশ করব’। সে আবেদন করল, ‘আমি একজন সত্যিকারের অভাবী। পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার উপর, আমার দারুণ অভাব’। কাজেই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হাযির হলাম।) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে আবূ হুরায়রা! গত রাতে তোমার বন্দী কী আচরণ করেছে?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে তার অভাব-অনটন ও (অসহায়) সন্তানের-পরিবার অভিযোগ জানালো। সুতরাং তার প্রতি আমার দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’। তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’।
আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুরূপ উক্তি শুনে সুনিশ্চিত হলাম যে, সে আবার আসবে। কাজেই আমি তার প্রতীক্ষায় থাকলাম। সে (পূর্ববৎ) এসে আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে বললাম, ‘অবশ্যই তোকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে পেশ করব’। সে বলল, ‘আমি অভাবী, পরিবারের দায়িত্ব আমার উপর, (আমাকে ছেড়ে দাও) আমি আর আসব না’। সুতরাং আমার মনে দয়া হলো। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে উঠে (যখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম তখন) রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘আবূ হুরায়রা! গত রাত্রে তোমার বন্দী কীরূপ আচরণ করেছে?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে তার অভাব-অনটন ও অসহায় সন্তান-পরিবারের অভিযোগ জানালো। সুতরাং আমার মনে দয়া হলে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’। তিনি বললেন, ‘সতর্ক থেকো, সে আবার আসবে’।
সুতরাং তৃতীয়বার তার প্রতীক্ষায় রইলাম। সে (এসে) আঁজলা ভরে খাদ্যবস্তু নিতে লাগল। আমি তাকে ধরে বললাম, ‘এবারে তোকে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে হাযির করবই। এটা তিনবারের মধ্যে শেষবার। ‘ফিরে আসব না’ বলে তুই আবার ফিরে এসেছিস’। সে বলল, ‘তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাকে এমন কতকগুলো শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন’। আমি বললাম, ‘সেগুলো কী?’ সে বলল, ‘যখন তুমি (ঘুমাবার জন্য) বিছানায় যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করে (ঘুমাবে)। তাহলে তোমার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রক্ষক নিযুক্ত হবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসতে পারবে না’।
সুতরাং আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। আবার সকালে (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গেলাম) তিনি আমাকে বললেন, ‘তোমার বন্দী কী আচরণ করেছে?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে বলল, “আমি তোমাকে এমন কতিপয় শব্দ শিখিয়ে দেব, যার দ্বারা আল্লাহ আমার কল্যাণ করবেন।” বিধায় আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’। তিনি বললেন, ‘সে শব্দগুলো কী?’ আমি বললাম, ‘সে আমাকে বলল, ‘যখন তুমি বিছানায় (ঘুমানোর জন্য) যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূম’ পড়ে নেবে’। সে আমাকে আরো বলল, ‘তার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বদা তোমার জন্য একজন রক্ষক নিযুক্ত থাকবে। আর সকাল পর্যন্ত তোমার কাছে শয়তান আসবে না’। (এ কথা শুনে) তিনি বললেন, ‘শোনো! সে নিজে ভীষণ মিথ্যাবাদী; কিন্তু তোমাকে সত্য কথা বলেছে। হে আবূ হুরায়রা! তুমি জানো, তিন রাত ধরে তুমি কার সাথে কথা বলছিলে?’ আমি বললাম, ‘না’। তিনি বললেন, ‘সে শয়তান ছিল’।[4]
পরিশেষে, আমরা যেন বিশেষ ফযীলতপূর্ণ আয়াতুল কুরসীর গুরুত্ব ও ফযীলত জেনে তা আমল ও পাঠ করে অশেষ উপকার পেতে পারি, আল্লাহ সেই তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
* ছনকান্দা, বটতলা, শ্রীবরদী, শেরপুর।
[1]. নাসাঈ কুবরা, হা/৯৯২৮; ত্বাবারানী, হা/৭৫৩২; ছহীহুল জামে‘, হা/৬৪৬৪; সিলসিলা ছহীহা, হা/৯৭২, হাদীছ ছহীহ।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮১০; আবূ দাঊদ, হা/১৪৬০।
[3]. তিরমিযী, হা/২৮৭৮; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৪৬১, হাসান লিগায়রিহী।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩১১।
