ভূমিকা:
কুরআন মাজীদ মহান আল্লাহর আওয়াজ, তাঁর শব্দ, বাক্য ও বাণী। পৃথিবীর মানুষের জন্য হেদায়াত হিসেবে এটিই যথেষ্ট। আরবী ভাষার সর্বোচ্চ সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্ব কুরআনের। কুরআনের আয়াতের মতো একটি আয়াতও মানুষের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আজ অসংখ্য মানুষ আরবী না জানার কারণে কুরআন থেকে দূরে। অথচ মানুষের বুঝার জন্য কুরআন কারীম অনেক সহজ। তবে অনুবাদ করে বুঝাতে চাইলে, কুরআনে যেভাবে অল্প কথায় ব্যাপক ভাব প্রকাশ করা হয়েছে, তার যথোপযুক্ত অনুবাদ অনেক কঠিন। তখন আলাদা করে তাফসীরের প্রয়োজন হয়। সময় স্বল্পতার কারণে বড় তাফসীর পড়াও মানুষের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। মানুষের কাছে কুরআনকে সহজ করে তোলার জন্য আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস এই লেখনি। যেখানে স্বাভাবিক প্রবন্ধের মতো পড়তে পড়তে মানুষ যেমন অনুবাদ শিখে ফেলবে, তেমনি প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাও শিখে ফেলবে, যা তাকে একসাথে কুরআনের মূল মেসেজটা বুঝতে সহযোগিতা করবে। লেখনির মধ্যে কুরআনের মূল অনুবাদ আলাদাভাবে হাইলাইট করা থাকবে, ব্যাখ্যাগুলো স্বাভাবিক থাকবে। মহান আল্লাহ আমাদের এই প্রয়াসকে কবুল করুন- আমীন!
سورةالفاتحة
সূরা ফাতিহা তথা উদ্বোধনকারী সূরা, যে সূরা দিয়ে কুরআন সূচনা করা হয়েছে।
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
শয়তান এত শক্তিশালী এবং তার ষড়যন্ত্র এত সূক্ষ্ম যে, মানুষের শক্তি ও বিবেক দিয়ে তার থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। শয়তান থেকে বাঁচার একমাত্র রাস্তা মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেওয়া আর শয়তানের সবচেয়ে বড় শত্রু কুরআন। শয়তান কখনোই আপনাকে কুরআন পড়া শুরু করতে দিবে না। শুরু করলেও একটানা অনেকক্ষণ পড়তে দিবে না। মুরগির বাচ্চারা যেভাবে মায়ের আঁচলের নিচে আশ্রয় নেয়, গোশত যেভাবে হাড়ের সাথে লেগে থাকে, আমি মহান আল্লাহর সাথে সেভাবে লেগে গিয়ে এবং তাঁর দিকে পরিপূর্ণরূপে ফিরে গিয়ে বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। মহান আল্লাহর দয়া ও আশ্রয় ব্যতীত শয়তানের হাত থেকে বাঁচানোর মতো কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই। তাই কুরআন তিলাওয়াতের শুরুতে আঊযুবিল্লাহ পড়ার আদেশ স্বয়ং মহান আল্লাহ দিয়েছেন।
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
মহান আল্লাহর নাম অত্যন্ত বরকতময়। তাঁর নামেই সকল কল্যাণকর কাজ শুরু করা উচিত। শুরু করছি মহান আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময় ও দয়ালু। মহান আল্লাহর দুটি গুণ ‘রহমান’ ও ‘রহীম’-কে বিসমিল্লাহর সাথে যুক্ত করা হয়েছে যেন মানুষের কল্পনায় মহান আল্লাহর দয়া ও ভালোবাসার দিকটি বেশি ফুটে উঠে। কুরআনও মহান আল্লাহর অনেক বড় দয়া। তাই প্রতিটি সূরার শুরুতে বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করা হয়।
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
যে উপকার করে আমরা তার শুকরিয়া আদায় করি। যে দেখতে সুন্দর অথবা কোনো বিশেষ যোগ্যতা আছে আমরা তার প্রশংসা করি। মহান আল্লাহর বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও ভিন্ন। তিনি একাধারে যেমন সকল শ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী, ঠিক তেমনি তাঁর সৃষ্টিজীবের একচ্ছত্র মালিক হওয়ার পাশাপাশি নিবিড়ভাবে তাদের জীবন ধারণের সকল উপকরণের ব্যবস্থাপনা করার মাধ্যমে তিনি তাদের লালনপালনকারী। আর তাঁর এই দয়া ও মায়ায় ভরা অভিভাবকত্ব শুধু মানুষ ও এই পৃথিবীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং মহান আল্লাহ যত জগৎ, আসমান, যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং তার মধ্যে যত ধরনের জীবজন্তু, পশু-পাখি রয়েছে, তাদের সকলের জন্য প্রযোজ্য।
আমরা ভালোমন্দ যে অবস্থাতেই থাকি না কেন সকল অবস্থার জন্য, সকল কালের জন্য চিরস্থায়ীভাবে সকল জগতের অভিভাবক মহান আল্লাহর শুকরিয়া ও প্রশংসা।
সর্বদা এভাবে প্রশংসার মেজাজে থাকলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল কমে আর হ্যাপি হরমোন সেরোটনিন বাড়ে, যা মানুষের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। পরিবেশ যত কঠিনই হোক না কেন, সমাধানের রাস্তা বের করে টিকে থাকার লড়াইকে সহজ করে দেয়।
الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
আমাদের প্রতিপালক শুধু আমাদের প্রভু ও সৃষ্টিকর্তা নন, বরং তিনি আমাদের উপর দয়ালু। তাঁর দয়ার ব্যাপকতা এত বেশি যে, তাকে অমান্যকারী ব্যক্তির রিযিক্বের ব্যবস্থাও তিনি করে দেন। তাঁর দয়া এত বেশি যে, তাঁর কাছে না চাইলে তিনি রাগ করেন আর চাইলে খুশি হন; অথচ মানুষের কাছে বেশি চাইলে মানুষ রাগ করে। পৃথিবীর জীবজন্তু, পশু-প্রাণী ও মানুষ-জিন পরস্পরের মধ্যে যত ধরনের ভালোবাসা ও দয়ার বিনিময় করে থাকে, তা মহান আল্লাহর মাত্র একটি দয়ার প্রভাব। মহান আল্লাহর দয়া গভীর ভালোবাসা থেকে আসে। মায়ের প্রতি সন্তানের যে গভীর ভালোবাসা আছে, তার চেয়েও সীমাহীন গভীর ভালোবাসা রয়েছে মহান আল্লাহর।
রহমানের দয়া সকল সৃষ্টিজীবের জন্য। রহমানের দয়া সর্বাবস্থায় ও তৎক্ষণাৎ। রহীমের দয়া মুমিনদের জন্য। রহীমের দয়ার প্রভাব সাথে সাথে পাওয়া জরুরী নয়। বর্তমানে মুমিন বিপদগ্রস্ত হলেও রহীমের দয়ায় একসময় সে উদ্ধারপ্রাপ্ত হবে। অতএব, জগৎসমূহের অভিভাবক মহান আল্লাহ তাঁর সকল সৃষ্টিজীবের জন্য ব্যাপকভাবে দয়ালু আর তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য বিশেষভাবে দয়ালু।
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ
মহান আল্লাহ শুধু দয়ালু নন; তিনি সকল কাজের হিসাব রাখেন এবং তার প্রতিদান দিবেন। কেউ কারও প্রতি অন্যায় করলে তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। মানুষের হয় দয়া থাকে, না হয় রাগ থাকে। মহান আল্লাহর একদিকে দয়া আর আরেকদিকে তাঁর ন্যায়। তিনি শাস্তি দিলে সেটি ন্যায়। তিনি রাগ করলে সেটি ন্যায়। তিনি রাগ থেকে মানুষের উপর শাস্তি দিবেন না। তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে শাস্তি দিবেন। মানুষ যেন শুধু আল্লাহর দয়ার আশায় বসে না থাকে। যদি থাকে, তাহলে সে ধোঁকাগ্রস্ত হবে। মানুষের জানা থাকতে হবে যে, তাদের প্রতিপালক যেমন দয়ালু—তেমন তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী। বিচার দিনের একচ্ছত্র মালিকানা একমাত্র তাঁর হাতে। আর সেদিনই তিনি মানুষের সকল কাজের হিসাব নিবেন, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, ভালো বান্দাদের পুরস্কার দিবেন এবং গুনাহগারদের শাস্তি দিবেন। এটিই মহান আল্লাহর সৃষ্টির পূর্ণতা। তিনি অনর্থক কোনো কিছুই সৃষ্টি করেন না।
(ইনশা-আল্লাহ! চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক*
* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বিএ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।
