১. মৌমাছি
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَوْحَى رَبُّكَ إِلَى النَّحْلِ أَنِ اتَّخِذِي مِنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَمِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ - ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছির অন্তরে অহী করেছেন যে, তুমি গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল হতে কিছু কিছু আহার করো, অতঃপর তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ করো। ওর উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগমুক্তি; অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে’ (আন-নাহল, ১৬/৬৮-৬৯)।
উক্ত আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি মৌমাছির অন্তরে অহী করেছেন। এখন আমাদের জানা দরকার যে, অহী কী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অহী অর্থ ইলহাম। যেমন ইবনুল ক্বাইয়িম রহিমাহুল্লাহ-এর মতে অহী নাযিলের সাতটি পদ্ধতির অন্যতম হলো ইলহাম। (ইলহাম অর্থ— জিবরীল আলাইহিস সালাম-এর মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি কারো হৃদয়ে কোনো কিছু সম্পর্কে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করা) ইলহামের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের অহী করে থাকেন, যা নবুঅতের অংশ নয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা মৌমাছির অন্তরে অহী তথা অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেন। মৌমাছি ডানার সাহায্যে তার গৃহ নির্মাণ করে। এই ছোট্ট পতঙ্গটির মৌচাক (বাসা) বানানোর যে কৌশল, তা দেখে আশ্চর্য না হয়ে কেউ পারে না। তার বাসা কতই না সুন্দর! কতই না চমৎকার কারুকার্য খচিত শিল্পকর্ম! এরপর বলা হলো যে, (প্রত্যেক প্রকার ফল হতে আহার করো)। আয়াতে ثُمَّ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ এরপর। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, বাসা বানানোর পর মৌমাছিদের বিভিন্ন ফল থেকে আহার করতে বলা হয়েছে।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এটা প্রমাণিত সত্য যে, কোনো ফুলে যদি মৌমাছি, পিঁপড়া, পাখি বা প্রজাপতি না বসে, তাহলে সেই ফুল বড় হয় না। আর সেই ফুল হতে ফল হয় না। কারণ ফুল বড় হতে ও ফল হতে গেলে ফুলের পরাগায়নের দরকার। যেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৌমাছির মাধ্যমে হয়ে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাতাস বা মধু আহরণকারী পোকা-মাকড় ও পাখি ইত্যাদির মাধ্যমেও হয়ে থাকে।
এখানে আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন যে, মৌমাছি মধু সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়ায়। যখন কোনো মৌমাছি মধুর সন্ধান পায়, তখন সে নাচের মাধ্যমে অন্যান্য মৌমাছিকে মধু সংগ্রহের স্থান সম্পর্কে অবহিত করে। তখন সকল মৌমাছি সেখানে গিয়ে মধু সংগ্রহ করে। মধু সংগ্রহের পর তারা মৌচাকে ফিরে যায়। মৌচাকে ফিরে আসার ক্ষেত্রে পথ চিনতে তাদের মোটেও ভুল হয় না। মৌচাকে গিয়ে তারা ডিম, বাচ্চা ও মধুর নিকট অবস্থান গ্রহণ করে। আর মৌমাছি তাদের পিছনে অংশ দিয়ে ডিম দেয়।
তারপর বলা হয়েছে যে, (তোমার প্রতিপালকের সহজ পথ অনুসরণ করো) তাফসীর ইবনু কাছীরে উল্লেখ আছে, ক্বাতাদা রহিমাহুল্লাহ এবং আব্দুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনে আসলাম রহিমাহুল্লাহ বলেন, এর অর্থ অত্যন্ত বাধ্য ও অনুগত হয়ে’।[1] তারপর বলা হয়েছে, (তাদের [মৌমাছির] উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য রোগমুক্তির ব্যবস্থা)। এই আয়াতেشِفَاءٌ শব্দটিকে অনির্দিষ্ট (نكرة) ব্যবহার করে একথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এতে যে কোনো ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তির ব্যবস্থা আছে। এভাবেই পবিত্র কুরআনে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তির নানা উপায় সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা হয়েছে।
عَنْ أَبِى سَعِيدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنَّ أَخِى اسْتَطْلَقَ بَطْنُهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْقِهِ عَسَلاً فَسَقَاهُ ثُمَّ جَاءَهُ فَقَالَ إِنِّى سَقَيْتُهُ عَسَلاً فَلَمْ يَزِدْهُ إِلاَّ اسْتِطْلاَقًا فَقَالَ لَهُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ جَاءَ الرَّابِعَةَ فَقَالَ اسْقِهِ عَسَلاً فَقَالَ لَقَدْ سَقَيْتُهُ فَلَمْ يَزِدْهُ إِلاَّ اسْتِطْلاَقًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَدَقَ اللَّهُ وَكَذَبَ بَطْنُ أَخِيكَ فَسَقَاهُ فَبَرَأَ.
আবূ সাঈদ খুদরী রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কোনো এক ছাহাবী এসে তার ভাইয়ের পেটের সমস্যার কথা বললেন। তখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মধু পান করাতে বললেন। (দ্বিতীয় দিনও) এসে আবার ছাহাবী বললেন, অসুখ পূর্ববৎ বহাল রয়েছে। এইভাবে (ঐ ছাহাবী তিন দিন আসলেন আর) আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই উত্তর দিলেন। অতপর ঐ ছাহাবী চতুর্থ দিন আসলে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখনও তাকে মধু পান করার পরামর্শ দিলেন। তখন তিনি (ছাহাবী) বললেন, অসুখের কোনো পার্থক্য হয়নি (পেটের সমস্যা পূর্বের মতো বলবৎ আছে)। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। এরপর রোগীকে আবার মধু পান করানো হয় এবং সে সুস্থ হয়ে উঠে।[2] এখানে উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হচ্ছে ওষুধের কোনো দোষ নেই। রোগীর বিশেষ মেজাজের কারণে ওষুধ দ্রুত কাজ করেনি। অপর এক হাদীছে আছে, ইবনু আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনটি জিনিসে শিফা বা রোগমুক্তি রয়েছে। শিঙ্গা লাগনো, মধু পান করা ও লোহা দ্বারা দাগ দিয়ে নেওয়া। কিন্তু আমার উম্মতকে আমি দাগ দিতে নিষেধ করেছি’।[3]
তারপর বলা হয়েছে, (অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে) তাফসীর ইবনু কাছীরে উল্লেখিত হয়েছে, হে মানবমণ্ডলী! মৌমাছির মতো অতি দুর্বল ও শক্তিহীন প্রাণীর মধু সংগ্রহ করা, মোম তৈরি করা, স্বাধীনভাবে বিচরণ করা, বাসস্থান চিনতে ভুল না করা ইত্যাদি সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণার জন্য তোমাদের খোরাক রয়েছে। যারা আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব এবং মহত্ত্ব নিয়ে ভাবে, তাদের জন্য এগুলোতে বড় নিদর্শন রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ তাআলার সীমাহীন প্রজ্ঞা, অসীম জ্ঞান এবং পরম দয়া সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে।
২. মাকড়সা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِياءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتاً وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كانُوا يَعْلَمُونَ
‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তাদের দৃষ্টান্ত ঐ মাকড়সার মতো, যে ঘর বানায়। আর সকল ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই সবচেয়ে দুর্বল ঘর, যদি তারা জানত’ (আল-আনকাবূত, ২৯/৪১)।
ড. মরিস বুকাইলি তার ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ বইয়ে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, উক্ত আয়াতে মাকড়সার ঘরের অস্থায়ী অবস্থা বিশেষভাবে দেখানো হয়েছে। মাকড়সার ঘরের মতো হালকা অস্থায়ী জিনিস আর কোনো কিছু হতে পারে না। উক্ত আয়াতে আরও বলা হয়েছে, তাদের অবস্থা মাকড়সার ঘরের মতোই ভঙ্গুর ও পতনশীল, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাফসীর ইবনু কাছীরে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে অভিভাবক গ্রহণ করে, এদের দৃষ্টান্ত তাদের মতো, যারা মাকড়সার জালের নিচে আশ্রয় পাওয়ার প্রত্যাশা করে।
গ্রন্থি থেকে নির্গত এক প্রকার লালার সাহায্যে মাকড়সা ঘর বানায়। জালিকা দিয়ে তৈরি তাদের এই ঘর অনেক পাতলা ও হালকা, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। জালিকা দিয়ে এ জাতীয় গৃহ নির্মাণ করা কোনো মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। মাকড়সার তৈরি এই ঘরের কারুকার্য বা শৈল্পিক নকশা দেখে কোনো জ্ঞানীই হতবাক না হয়ে পারে না।
উল্লেখ্য, মাকড়সার স্নায়ুবিক কোষের অবস্থানগত বৈচিত্র্যের কারণেই জ্যামিতিকভাবে নিখুঁত অমন অসাধারণ বুননকার্য সম্পাদন করা সম্ভব হয়ে থাকে।
আল্লাহ আমাদের উপলব্ধি করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
[1]. তাবারী, ১৭/২৪৯।
[2]. ফাতহুল বারী, ১০/১৭৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২২১৭।
[3]. ফাতহুল বারী, ১০/১৪৩।