মানুষ সামাজিক জীব। মানুষকে দৈনন্দিন জীবনে একে অপরের সাথে সামাজিক ও পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হয়। একে অপরের সহযোগিতায় মানুষ অনুভব করে অসীম সুখ ও সীমাহীন শান্তি। সমাজ হয় সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ। ভ্রাতৃত্ব রক্ষায় ইসলাম সবচেয়ে বেশি তাগিদ দিয়েছে। বক্ষ্যমাণ আলোচনায় তারই কিছু নমুনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাব, ইনশা-আল্লাহ!
ইসলাম এক মুসলিমের সাথে অপর মুসলিমের ভ্রাতৃত্ব ও সহানুভূতি কেমন হওয়া কাম্য, তার একটি স্বরূপ উপস্থাপন করেছে। হাদীছে এসেছে,
عن النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيرٍ قال قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِي تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى.
নু‘মান ইবনু বাশীর রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তুমি মুমিন ব্যক্তিদেরকে তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুকম্পার ক্ষেত্রে একটি দেহের মতো দেখবে। যখন দেহের কোনো অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয়, তখন সমস্ত শরীর তার জন্য অনিদ্রা এবং জ্বরে আক্রান্ত হয়’।[1]
মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও মমত্ববোধের এমন চিত্র ইসলাম উপস্থাপন করেছে, যার দ্বারা একে অপরের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা নির্মূল হয়ে যায়। আবশ্যক হয়ে যায় একে অপরের মাঝে ভালোবাসা ও মমত্ববোধ।
তারপরও অনেককে দেখা যায় যে, কোনো এক নিতান্ত মামুলি বিষয়ে দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে একে অপরের সাথে মাসকে মাস, বছরকে বছর অতিবাহিত করে কোনো রকম কথা ছাড়াই। তাদের মাঝে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে প্রথমে সম্পর্কের হাত বাড়ায় এবং সর্বপ্রথম সালাম দেয়। তাহলে শুনুন! শান্তি ও ভালোবাসার অসম্ভব একটি দৃষ্টান্ত মহামানব মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই মর্মস্পর্শী বাণী।
عَنْ أَبِى أَيُّوبَ الأَنْصَارِىِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لاَ يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ يَلْتَقِيَانِ فَيُعْرِضُ هَذَا وَيُعْرِضُ هَذَا وَخَيْرُهُمَا الَّذِى يَبْدَأُ بِالسَّلاَمِ.
আবূ আইয়ূব আনছারী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় তিন রজনির অধিক তার ভাইকে এভাবে পরিহার করা যে, তাদের সাক্ষাৎ হয় অতঃপর একে অপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর তাদের মাঝে উত্তম হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়’।[2]
উল্লিখিত হাদীছের ভাষায় স্পষ্ট হয় যে, কোনো ব্যক্তির জন্য বৈধ হবে না যে, সে তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে তিন দিন পর্যন্ত কথা না বলে থাকবে। কোনো ভাষাজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য কীভাবে সম্ভব যে, এই সুস্পষ্ট ভাষা বুঝা সত্ত্বেও এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার পরও তাঁর সুস্পষ্ট কথাকে অমান্য করে, তা গুণীজনের বোধগম্য নয়।
একে অপরের ভ্রাতৃত্ব রক্ষার্থে ইসলামে এক অভূতপূর্ব ও অত্যন্ত সুন্দর বিধান বর্ণিত আছে, যা পারে একে অপরের বিদ্বেষকে মিটিয়ে দিতে ও হিংসাকে বিলীন করতে। যে বিধানকে প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির উচিত মযবূতভাবে আঁকড়ে ধরা এবং প্রত্যেক মুসলিমের আবশ্যক ইসলামের এই চমৎকার নিদর্শনকে সমুন্নত রাখা ও তা পালন করা। তা হচ্ছে একে অপরের সাথে সালাম বিনিময় করা। যেমনটি বলেছেন শান্তির প্রচারক, অনুপম আদর্শের অধিকারী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবূ উমামা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, إِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِاللَّهِ مَنْ بَدَأَ بِالسَّلَامِ ‘আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক নিকটবর্তী সেই ব্যক্তি, যে প্রথমে সালাম দেয়’।[3]
হে আমার প্রিয় ভাই! কে না চায় তার প্রতিপালকের নিকট প্রিয়তম হতে? তাহলে এই সামান্য এবং শ্রমহীন কাজে কেন এত কুণ্ঠাবোধ? কেন এত অবহেলা?
তাহলে কি তা আত্ম-অহমিকা?
আবার অনেকে সালাম গ্রহণ করতে অবহেলা করে, যা কোনোমতেই একজন মুমিন ব্যক্তির থেকে কাম্য নয়। কারণ সালামের জবাব দেওয়া তো মহান রবের পক্ষ থেকে আদেশ। মহান আল্লাহ বলেন,وَإِذَا حُيِّيتُمْ بِتَحِيَّةٍ فَحَيُّوا بِأَحْسَنَ مِنْهَا أَوْ رُدُّوهَا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ حَسِيبًا ‘যখন তোমরা সালাম ও অভিবাদন প্রাপ্ত হও, তবে তোমরাও তা হতে অতি উত্তম সম্ভাষণ অথবা (অনুরূপ সম্ভাষণ) ফিরিয়ে দাও, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী’ (আন-নিসা, ৪/৮৬)।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যে সালাম আমরা প্রাপ্ত হব, তার থেকেও উত্তমভাবে তা ফিরিয়ে দিতে বলেছেন। আর আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা অতি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়েও হিসাব গ্রহণকারী। আমরা যদি এর মাধ্যমে অহংকার প্রকাশ করে থাকি, তাহলে তিনিই এই বিষয়ে অধিক অবগত।
আমাদের বড় সমস্যাগুলোর একটা হলো- আমরা প্রয়োজনের থেকে বেশিই আত্মমর্যাদাবান মনে করি নিজেদেরকে। আমরা মনে করি, আমি কেন আগে তার সাথে কথা বলব? অথচ প্রয়োজনের সময় হলে ঠিকই তার নিকটেই যাই। তাহলে আপনাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেই সৃষ্টির সেরা ও মহামানবের কথা, যিনি সকলের কাছেই হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় পরিচিত। যিনি ছোটদের আগেই সালাম দিয়েছেন, যিনি ছোটদের সাথে কৌতুকের ছলে আলাপ করেছেন, যিনি এমন কারবার করেছেন যা আমাদের নিকট আশ্চর্যজনক হলেও তার নিকট ছিল স্বাভাবিক। তিনিই মহান সেই ব্যক্তি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা কি তাঁর থেকেও অধিক মর্যাদাবান ও সম্মানের অধিকারী? আমাদের সকলের উচিত আগে কথা বলা এবং হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় কথা বলা। কেউ আগে কথা বললে তাকে বিদ্রুপ না করা এবং এটাকে তুচ্ছজ্ঞান না করা। যেমনটি মর্যাদাবান ব্যক্তি মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী থেকে আমরা জানতে পারি। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى ذَرٍّ قَالَ قَالَ لِىَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «لاَ تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ».
আবূ যার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো ভালো কাজকেই তুচ্ছজ্ঞান করবে না। যদিও সেটা তোমার কোনো ভাইয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সাক্ষাৎ করা হয়’।[4]
আমাদের সকলেরই উচিত, আমরা এই ছোট কাজটাকে তুচ্ছ মনে না করে তার প্রতি আমল করা, যার মাধ্যমে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে ও সুন্দর হবে।
আর ভ্রাতৃত্ব রক্ষার্থে কারো উচিত নয় যে, সে তার ভাই সম্পর্কে কোনো অমূলক কুধারণা, গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান, পশ্চাতে নিন্দা, ঠাট্টা, বিদ্রুপ, দোষারোপ, মন্দ নামে ডাকার মতো গর্হিত কাজ করবে। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে সূরা আল-হুজুরাত এর ১১-১২ নম্বর আয়াতে।
এসব তো নমুনা মাত্র। এগুলো ছাড়াও অসংখ্য জায়গায় বিভিন্নভাবে ইসলামের পরতে পরতে মুসলিমের একে অপরের মৌলিক অধিকার, ভ্রাতৃত্ব, একে অপরের প্রতি দয়া, ভালোবাসা, মমতার বর্ণনা সুবিন্যস্তভাবে বর্ণিত রয়েছে। এসব বিষয় আবশ্যক করে প্রত্যেকের প্রতি ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখা এবং একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, যা আমাদের সামাজিক জীবনকে সীমাহীন সুখকর করে তোলে। যার মাধ্যমে দূরীভূত হতে পারে সমাজের অনাচার ও অত্যাচার। এভাবে সকলেই একে অপরের সাথে দ্বন্দ্ব ভুলে হয়ে ওঠে দয়ার্দ্র ও সহানুভূতিশীল। তারা একে অপরের ব্যথায় হয় ব্যথিত। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত তার মুসলিম ভাইয়ের মৌলিক অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখা। আল্লাহ আমাদেরকে ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
এম. এফ. রহমান বিন সিরাজ
শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০১১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯৬।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬০।
[3]. তিরমিযী, হা/২৬৯৪; আবূ দাঊদ, হা/৫১৯৭; মিশকাত, হা/৪৬৪৬, হাদীছ ছহীহ।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬২৬।