আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘আপনি বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’ (আয-যুমার, ৩৯/৫৩)।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির তরে ক্ষমার হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন, যে তার অবাধ্যতায় স্বীয় হৃদয়কে ডুবিয়ে দিয়েছে অতল গহ্বরে। সমাজের অকাম্য নিয়মনীতি ও প্রগতির লোভনীয় চাকচিক্যতায় স্বীয় ঈমানকে বলবৎ রাখতে ব্যর্থ হয়ে অক্ষমতাকেই বরণ করেছে। এমন অপরাধীকে তিনি নিরাশার নিকষ আঁধার পাড়ি দিয়ে আশার মশাল হাতে তোলার প্রেরণা যোগাচ্ছেন।
অথচ আজকের সমাজে তথাকথিত শিক্ষিতদের নিকট এমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও স্বচ্ছ উদারতা কামনা করা অবান্তর বৈ কিছুই নয়। আমরা প্রবৃত্তি তথা মনের বাসনা অনুপাতে কার্য সম্পাদনের মাঝেই খুঁজে ফিরি সফলতার সোপান। সংগত-অসংগত বিচার করার অবসরটুকুও জোটে না আমাদের। কোনো দ্বীনী ভাই কিংবা বোন যখন সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভ্রষ্টতার পথে যাত্রা শুরু করে কিংবা কোনো অপরাধপ্রবণ কর্মে লিপ্ত হয়, তখন আমরা তৎক্ষণাৎ ‘ছিরাতুল মুস্তাক্বীম’-এ প্রত্যাবর্তনের প্রেরণা তো দূরের কথা বরং তার অন্যায় প্রকাশ করাটা নিজের জন্য ফরয বলে মনে করি। এক প্রকার মহাউল্লাস আমাদের মানসপটে উঁকি দেয়। শুরু করি তার সমালোচনা।
কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে অন্যায়কারী ব্যক্তির আত্মসংশোধনের মানসিকতা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তখন সে নিজের কাছেই নিজেকে পরাজিত বলে মনে করে। এর কারণে আত্মসংশোধনের মানসিকতা বা প্রবণতা নৈরাশ্যের অতল সমুদ্রে হারিয়ে যায়। যার দরুন হতাশা তাকে নিত্যসঙ্গী হওয়ার প্রস্তাব পাঠায়।
এসব আত্মপরাজিতদের হৃদয়ের শব্দহীন আর্তনাদ অনুধাবন করা, তাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা, কারণ উদ্ঘাটন করা এবং উত্তরণের পথনির্দেশ করার লোক নেই বললেই চলে। বরং তাদের চিত্তপট আমাদের বাঁকা চাহনি ও সমালোচনার চাবুকে জর্জরিত হয় প্রতিনিয়ত। আর এই সমালোচনাই তাদের আরো বড় অপরাধ করার ইন্ধন যোগায়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন,تَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ‘তোমরা নেকী ও কল্যাণের কাজে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করো, গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না’ (আল-মায়েদা, ৫/২)।
কিন্তু সমালোচনা করার দরুন আমরা তাদেরকে পরোক্ষভাবে আরো বড় অপরাধ করতে উদ্বুদ্ধ করি। এটা যেন তাদের মাঝে অপরাধের ধারাবাহিকতা চলমান রাখার এক অদৃশ্য প্রস্তাব। আসলে ভুক্তভোগীদের সমালোচনা করার অর্থ হলো, তাদেরকে চোরা পন্থায় অন্যায় করতে আরো উদ্বুদ্ধ করা। যার দরুন অপরাধের সুদূরপ্রসারী কুফল থেকে আমাদেরও মুক্তি মেলে না। আমাদেরও হতে হয় সমান অপরাধী। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا ‘যে ব্যক্তি হেদায়াতের দিকে আহ্বান জানায়, তার জন্য সে পথের অনুসারীদের ছওয়াবের অনুরূপ ছওয়াব রয়েছে। এতে তাদের ছওয়াব থেকে কিছুই কমবে না। আর যে ব্যক্তি ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান জানাবে, তার উপর তার অনুসারীদের গুনাহের অনুরূপ গুনাহ বর্তাবে। এতে তাদের গুনাহ থেকে কিছুই কমবে না’।[1]
হায় আফসোস! এই আত্মপরাজিতদের প্রতি একটু মানবিক আচরণ, একটু সংশোধনের প্রেরণাই তো তাদের ছিরাতুল মুস্তাক্বীমে প্রত্যাবর্তনের জন্য যথেষ্ট ভূমিকা পালন করত! তাদেরকে একটু হেদায়াতের অনুপ্রেরণা যোগানোর ফলে আমরাও হতে পারতাম সমান ছওয়াবের অধিকারী! সমালোচনায় ব্যস্ত না হয়ে যদি তাদের ত্রুটি গোপন রাখতে পারতাম, তাহলে মহাপ্রলয়ের দিন আমার ত্রুটিও গোপন রাখতেন আমার মহান রব। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তার ত্রুটি গোপন রাখবেন’।[2] সুবহানাল্লাহ! কতই না চমৎকার সুযোগ!
অথচ আমরা প্রবৃত্তিপূজায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। অবমূল্যায়ন করছি কুরআন-সুন্নাহকে।
প্রকৃতপক্ষে আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের নীতি-নৈতিকতা, ভুলে যাচ্ছি ইসলামের উদারতা, ভুলে যাচ্ছি প্রকৃত সফলতার উন্মুক্ত দ্বার। আত্মসমর্পণ করে পূজা করছি স্বীয় প্রবৃত্তির। অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদেরকে তাচ্ছিল্য করে আয়াত নাযিল করেছেন, তিনি বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا ‘(মুহাম্মাদ!) আপনি কি এমন ব্যক্তিকে দেখেছেন, যে স্বীয় প্রবৃত্তিকে ইলাহ রূপে গ্ৰহণ করেছে? আপনি কি তার যিম্মাদারী গ্ৰহণ করবেন?’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৪৩)।
সুতরাং হে মুসলিম! তুমি স্বীয় চিন্তাধারাকে উন্নয়নের পথে, অগ্ৰগামিতার জন্য তৎপর হও, করুণ অধঃপতনের অতল গহ্বরে তাকে স্থান দিয়ো না।
তুমি মুসলিম, তোমার হাত ও যবান নিয়ন্ত্রণই তোমার ঈমান। তুমি মুসলিম, তোমার দ্বারা অপর মুসলিমের মানহানি কাম্য নয়। তোমার নিজস্ব গতি আছে। তোমার নিজস্ব নৈতিকতা আছে। তোমার চেতনার উন্নয়নের জন্য রয়েছে তোমারই ইতিহাস। সুতরাং তুমি ওঠো, জাগো। তোমার ব্যক্তিত্বের উন্নতি সাধনে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাও। ঠুনকো বিষয়ের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে রাখা তোমাকে মানায় না। মনে রেখো! সফলতা তোমাকে আলিঙ্গন করবে পরচর্চার বদৌলতে নয়; বরং আত্মউন্নয়ন সাধনে।
পরিশেষে বলব, পরাজিত ঈমানদার মানুষের উপর নির্যাতন তাকে আরো অবাধ্য বানিয়ে দেয়, আত্মসংশোধনের সুযোগ সে পায় না। অতএব, সকলের কাছে সনির্বন্ধ আবেদন থাকবে, পরাজিত ঈমানের সমালোচনা নয়; বরং তাদের আত্মসংশোধনের সুযোগ দিন।
সুরাইয়া বিনতে মামূনুর রশীদ
শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ (বালিকা শাখা), ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৭৪।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮০।