কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

মৃত্যুর স্মরণ!

post title will place here

যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর সমীপেই ফিরে যেতে হবে। শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি।

এই ধরার বুকে যারাই আগমন করেছে, তাদেরই পালাক্রমে আপন গন্তব্যের দিকে যেতে হবে। আজ আমরা যারা এই ধরাতে অবস্থান করছি, আজ থেকে ১০০ বছর পর কেউ হয়তো থাকব না। সকলকেই পাড়ি জমাতে হবে না ফেরার দেশে, যেখানে কেউ গেলে আর ফিরে আসে না। আজ যে প্রতাপ ও দাপট নিয়ে চলছি কিছুকাল পর সেই দাপটের উপর মৃত্যু এসে হানা দিয়ে সবকিছু তছনছ করে দিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ إِنَّ الْمَوْتَ الَّذِي تَفِرُّونَ مِنْهُ فَإِنَّهُ مُلَاقِيكُمْ ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ ‘বলুন, তোমরা যে মৃত্যু হতে পলায়ন কর, সেই মৃত্যুর সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হবেই। অতঃপর তোমরা উপস্থিত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাত আল্লাহর নিকট এবং তোমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হবে যা তোমরা করতে’ (আল-জুমুআ, ৬২/৮)

মৃত্যুর হাত থেকে যদি কেউ মুক্তি পেত, তাহলে বিশ্বনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুক্তি পেতেন। তাঁকেও মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। হাদীছে এসেছে, আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, مَا رَأَيْتُ أَحَدًا الْوَجَعُ عَلَيْهِ أَشَدُّ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর চেয়ে বেশি রোগযন্ত্রণায় কষ্ট পেতে হয়েছে এমন কাউকে দেখিনি’।[1] অন্য একটি হাদীছে এসেছে, আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,مَاتَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ حَاقِنَتِي وَذَاقِنَتِي فَلَا أَكْرَهُ شِدَّةَ الْمَوْتِ لِأَحَدٍ أَبَدًا بَعْدَ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুক ও চিবুকের মাঝে মাথা রেখে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর আর কারো মৃত্যু যন্ত্রণাকে আমি খারাপ মনে করি না’।[2] আয়েশা রযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘...তাঁর সামনে একটি পাত্রে পানি রাখা ছিল। তাতে তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয় হাত ঢুকিয়ে হাত দুটি দ্বারা আপন চেহারা মাসাহ করতে লাগলেন। এ সময় তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন,لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লহ, অবশ্যই মৃত্যুর যন্ত্রণা ভীষণ’। অতঃপর তিনি হাত উঠিয়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলতে থাকলেন, فِى الرَّفِيقِ الأَعْلَىঅর্থাৎ ‘উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বন্ধুর সাথে (আমাকে মিলিত করো)’-এ কথা বলতে বলতে তিনি ইন্তিকাল করেন এবং তাঁর হাত নিচে নেমে আসে’।[3]

এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবের মৃত্যুর অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে আমাদের কী অবস্থা হবে! একটু ভাবনার চাদর এপাশ-ওপাশ করুন! আমরা আমাদের জীবনের শেষ সময়ের কথা কতটুকু চিন্তা করি! আমাদের সামনে যখন মৃত্যু হাযির হবে, তখন কেমন ব্যবহার করা হবে আমাদের সাথে! আমাদের মৃত্যুর অন্তিম মুহূর্তে কি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরপত্তা ও শান্তির বার্তা শোনানো হবে নাকি আযাব ও শাস্তির বার্তা শোনানো হবে? আমাদের কোন জিনিস মৃত্যুর স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছে? সমাজের মানুষের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করে। তারা মনে করে চিরকাল দুনিয়াতে অবস্থান করবে। কখনই মৃত্যুবরণ করবে না! অথচ মৃত্যু তাদের নিকটে অবস্থান করছে। নির্দিষ্ট সময় আসার সাথে সাথেই তার সাথে আলিঙ্গন করতে হবে! একজন কয়েদী যখন জানতে পারে কিছুদিন পর তার ফাঁসি দেওয়া হবে, তখন কি সে শান্তিতে ঘুম ও তৃপ্তিসহকারে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে? না, সে কখনো তা পারে না! ঠিক তেমনিভাবে আমরাও কি অঘোষিত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নই? মৃত্যু যে কোনো সময় আমাদের সামনে হাযির হতে পারে।

ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার শরীরের এক অংশ ধরে বললেন,كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سبيلٍ وعُدَّ نفسَكَ فِي أهل الْقُبُور ‘পৃথিবীতে অপরিচিত মুসাফির অথবা পথযাত্রীর মতো জীবন-যাপন করো। আর প্রতিনিয়ত নিজেকে কবরবাসী মনে করো’।[4] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَنْكِبِي فَقَالَ كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ يَقُولُ إِذَا أَمْسَيْتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلَا تَنْتَظِرِ الْمَسَاءَ وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা হাত দিয়ে আমার দু’কাঁধ ধরলেন। তারপর বললেন, ‘দুনিয়ায় তুমি এমনভাবে থাকো, যেমন- তুমি একজন গরীব অথবা পথের পথিক’। (এরপর থেকে) ইবনু উমার রযিয়াল্লাহু আনহুমা (মানুষদেরকে) বলতেন, সন্ধ্যা হলে আর সকালের অপেক্ষা করবে না। আর যখন সকাল হবে, সন্ধ্যার অপেক্ষা করবে না। নিজের সুস্থতার সুযোগ গ্রহণ করবে অসুস্থতার আগে ও জীবনের সুযোগ গ্রহণ করবে মৃত্যুর আগে।[5]

আমাদের পূর্বপুরুষগণ মৃত্যু ও আখেরাতের ব্যাপারে কতটা সচেতন ও সতর্ক ছিলেন! আর আমরা দুনিয়ার ব্যাপারে কতটা সজাগ ও আখেরাতের ব্যাপারে কতটা গাফেল ও উদাসীন, তা আমাদের দুনিয়ার জীবনে চলাফেরা দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তানসন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। যারা উদাসীন হবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত’ (আল-মুনাফিকূন, ৬৩/৯)

হায় আল্লাহ! আমরা যা করছি তা কি আমাদের ক্ষতির সামনে দাঁড় করাবে না!

এখনো কি আমাদের আল্লাহর সামনে ফিরে আসার সময় হয়নি! অতএব হে জ্ঞানী! মৃত্যু থেকে উপদেশ গ্রহণ করুন। মৃত্যু আসার আগেই নিজের জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করুন। নিজেকে প্রস্তুত করুন মৃত্যুর জন্য। যেন আল্লাহর সামনে হাস্য চেহারা নিয়ে উপস্থিত হতে পারেন। বেশি বেশি তাঁর যিকির করুন।

পরিশেষে আল্লাহর কাছে আমাদের এই প্রার্থনা! প্রভু আমাদের সকলকে মৃত্যুর পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে আপনার সামনে হাযির হওয়ার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

আদিল আলাবি 

মা‘হাদ ২য় বর্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৪৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৭০; মিশকাত হা/১৫৩৯।

[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৪৬; মিশকাত হা/১৫৪০।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪৪৯; মিশকাত হা/৫৯৫৯।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৬; মিশকাত হা/৫২৭৪।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪১৬; মিশকাত হা/১৬০৪।

Magazine