কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

আসমান-যমীন কত দিনে সৃষ্টি এবং কোনটি আগে সৃষ্টি হয়েছে?

আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক সেই আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি স্বীয় আরশের উপর উঠেছেন। তিনি দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এমনভাবে যে, রাত্রি ও দিবস একে অন্যকে অনুসরণ করে চলে তড়িৎ গতিতে। সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি সবই তাঁর হুকুমের অনুগত। জেনে রেখো! সৃষ্টির একমাত্র কর্তা আর হুকুমের একমাত্র মালিক তিনিই, সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ বরকতময়’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৫৪)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ

‘তিনি আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও এতদুভয়ের অন্তবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে, অতঃপর তিনি আরশের উপর উঠেন। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো অভিভাবক এবং সুপারিশকারী নেই’ (আস-সাজদা, ৩২/৪)। আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, *

وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ وَالْأَرْضَ فَرَشْنَاهَا فَنِعْمَ الْمَاهِدُونَ وَمِنْ كُلِّ شَيْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَيْنِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ

‘আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী। আমি ভূমিকে বিছিয়ে দিয়েছি; আর আমি কত সুন্দরভাবেই না এটি বিছিয়েছি। আমি প্রত্যেক বস্তু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো’ (আয-যারিয়াত, ৫১/৪৭-৪৯)

উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ ছয় দিনে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর এই সবকিছু সৃষ্টি করার পর তিনি আরশের উপন উঠেছেন। আর শেষের আয়াতে বলা হয়েছে যে, তিনি নিজ ক্ষমতা বলে আকাশ সৃষ্টি করে তা সম্প্রসারণ করেছেন। আর তিনি সবকিছু জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। এখানে জোড়ায় জোড়ায় বলতে বোঝানো হয়েছে, আসমান-যমীন, রাত-দিন, জীবন-মৃত্যু, জল-স্থল, জান্নাত-জাহান্নাম, ঈমান-কুফর ইত্যাদি।

কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি হয়। এখন কথা হলো, এখানে ছয় দিন বলতে কী বুঝানো হয়েছে? সেই দিনগুলো এই দিনের মতো ছিল নাকি ১ হাজার বছর বিশিষ্ট দিন ছিল? এবিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে। তবে এখানে ‘দিন’ বলতে ‘সময়সীমা’ বোঝানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এখানে ‘দিন’ বলতে এক দিনের সূর্যোদয় থেকে পরের দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত বোঝানো হয়নি। কারণ তখনো সূর্য সৃষ্টি করা হয়নি। যার কারণে এটা বলা যাবে না।

এখন কথা হলো যে, পৃথিবী আগে সৃষ্টি হয়েছে নাকি আকাশ আগে সৃষ্টি হয়েছে? দু’টি সূরায় পৃথিবী সৃষ্টির কথা আগে এসেছে। সূরা আল-বাক্বারা, ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আকাশের প্রতি মনোনিবেশ করেছেন, এরপর তিনি আকাশকে সাতটি স্তরে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং তিনি সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানী’। আর সূরা ত্বো-হার ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যিনি যমীন ও সুউচ্চ আকাশমণ্ডলী সৃষ্টি করেছেন’। আর যেই সকল আয়াতে আকাশমণ্ডলী সৃষ্টির কথা আছে, সেই আয়াতগুলোর সংখ্যা হলো ৯টি। সূরা আল-আ‘রাফের ৫৪ নং আয়াত, সূরা ইউনুসের ৩ নং আয়াত, সূরা আস-সিজদার ২৪ নং আয়াত, সূরা ফাতিরের ৩৮ নং আয়াত, সূরা হাদীদের ৪ নং আয়াত, সূরা নাজিয়াতের ২৭-৩৩ নং আয়াত ও সূরা শামসের ৫-১০ নং আয়াতে। এই আয়াতগুলোতে আকাশের কথা আগে আছে।

এর সঠিক মত তাফসীর ইবনে কাছীরে রয়েছে, যা সূরা বাক্বারার ২৯ নং আয়াতের তাফসীরে এসেছে। সূরা ফুছছিলাতের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,

قُلْ أَئِنَّكُمْ لَتَكْفُرُونَ بِالَّذِي خَلَقَ الْأَرْضَ فِي يَوْمَيْنِ وَتَجْعَلُونَ لَهُ أَنْدَادًا ذَلِكَ رَبُّ الْعَالَمِينَ - وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيهَا وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءً لِلسَّائِلِينَ - ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ ائْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ فَقَضَاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ فِي يَوْمَيْنِ وَأَوْحَى فِي كُلِّ سَمَاءٍ أَمْرَهَا وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَحِفْظًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ

‘বলুন, তোমরা কি সে সত্তাকে অস্বীকার করবে, যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুই দিনে এবং তোমরা তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে চাও? তিনি তো জগতসমূহের প্রতিপালক। তিনি ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে কল্যাণ নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন, সমভাবে পূর্ণ হলো জিজ্ঞাসুদের জন্য। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করলেন, যা ছিল ধুম্রপুঞ্জ বিশেষ। অতঃপর তিনি তাকে এবং পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা উভয়ে বলল, আমরা স্বেচ্ছায় অনুগত হয়ে আসলাম। অতঃপর তিনি আকাশমণ্ডলীকে দুই দিনে সপ্তাকাশে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আকাশকে তাঁর আদেশ প্রেরণ করলেন। আমি নিকটবর্তী আকাশকে প্রদ্বীপমালা দ্বারা সুশোভিত ও সুসংরক্ষিত করেছি। এটা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা’।

উক্ত আয়াত দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করছেন। তারপর সাতটি আকাশ নির্মাণ করেছেন। আমরা সকলেই জানি, একটা বিল্ডিং বানানো হলে প্রথমে নিচের অংশ বানাতে হবে। এরপর উপরের অংশ। মুফাসসিরগণের তাফসীর অনুযায়ী, এ জাতীয় আয়াতের ব্যাখ্যা জানতে এ সংক্রান্ত সকল আয়াত আনুধাবন করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন,

أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا - رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا - وَأَغْطَشَ لَيْلَهَا وَأَخْرَجَ ضُحَاهَا - وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَاهَا - أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعَاهَا - وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا - مَتَاعًا لَكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ

‘তোমাদের সৃষ্টি করা কঠিনতর নাকি আকাশ সৃষ্টি? তিনিই এটা নির্মাণ করেছেন, তিনি একে সুইচ্চ ও সুবিন্যস্ত করেছেন, তিনিই এর রাতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন ও এর সূর্যালোক প্রকাশ করেছেন এবং এরপর পৃথিবীকে করেছেন বিস্তৃত, তিনি এর মধ্য থেকে বের করেছেন পানি ও তৃণ, আর পর্বতকে তিনি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছেন। এর সবকিছু তোমাদের ও তোমাদের জন্তুর ভোগের জন্য’ (আন-নাযিয়াত, ৭৯/২৭-৩৩)।

উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আকাশের পর যমীন সৃষ্টি করেছেন। কারো কারো মতে, পরবর্তী আয়াতে আসমান সৃষ্টির পরে যমীন বিস্তৃত করা, সেখান থেকে পানি বের করা ইত্যাদির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে এটা বলা হয়নি যে, আকাশ সৃষ্টি করার পর যমীনকে সৃষ্টি করেছেন। তাই এটাই ঠিক যে, প্রথমে যমীন সৃষ্টি হয়েছে, তারপর আকাশ সৃষ্টি হয়েছে। তারপর যমীনকে সুসজ্জিত করা হয়েছে।

তাছাড়া আয়াতের মধ্যে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, সেখানে ثم বলা হয়েছে। আর ثم ব্যবহার হয় তখন, যখন কোনো কাজ শেষ করে অন্য কোনো কাজ শুরু করা হয়। আর এখানেও ঠিক একইভাবে বুঝানো হয়েছে যে, তিনি পৃথিবীতে তোমাদের যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছু সৃষ্টি করার পর আকাশে মনোযোগ দিয়েছেন।

তাছাড়া ছহীহ বুখারীতে এসেছে যে, ইবনে আব্বাস রযিয়াল্লাহু আনহু এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি উত্তরে বলেন যে, যমীন তো আকাশসমূহের পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যমীনকে বিছানো হয়েছে পরে।[1] ওলামায়ে কেরাম সকলের উত্তর এটাই; অতীতের এবং বর্তমানে অনেক তাফসীরকারক একই কথা বলেছেন।

উক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে, যমীন সৃষ্টি হয়েছে আকাশের আগে।

আব্দুর রাযযাক বিন মাসির

ছাত্র, ৮ম শ্রেণি, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।


[1]. ফাতহুল বারী, ৮/৪১৭।

Magazine