ভূমিকা : অস্তিত্বের নাম ইতিহাস। যে ইতিহাস জানে না, সে নিজেকে চেনে না। ইতিহাস একটি জাতির দর্পণ। প্রতিটি ক্ষণে ষড়যন্ত্রের জাল ছিড়ে তাওহীদের ঝান্ডা নিয়ে সালাফে ছালেহীনের পথে এগিয়ে চলছে ‘আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ’ –ওয়া লিল্লাহিল হামদ-। এই মহান প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস জানতে ও জানাতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস— ‘আল-জামি‘আর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’।
আল-জামি‘আর সূচনা : শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ হাফিযাহুল্লাহ তার একটি ঐতিহাসিক বক্তব্যে বলেন, ‘আমি এদেশের মাটিতে উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়বই গড়ব ইনশা-আল্লাহ; যেখানে ছেলে-মেয়ে উন্নতমানের শিক্ষাগ্রহণ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে মুখে-কলমে-মিডিয়ায়’। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনের দিন বলেছিলেন, ‘আমার হাতে টাকা নাই এ কথা সত্য, কিন্তু এখানে প্রতিষ্ঠান গড়বে এ কথাও সত্য। কীভাবে গড়বে তা আমি জানি না। তবে গড়বেই গড়বে, অবধারিত গড়বে, গড়বেই গড়বে ইনশা-আল্লাহ’। তিনি আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহর আদর্শ নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘এদেশের শিরকমুক্ত প্রতিষ্ঠান আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ; এদেশের বিদআতমুক্ত প্রতিষ্ঠান আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ; দলীয় ও সাংগঠনিক সংকীর্ণতামুক্ত প্রতিষ্ঠান আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ’।
ইতিহাস : ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট, রোজ মঙ্গলবার কাঁঠালগাছের নিচে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ হাফিযাহুল্লাহ উক্ত কথা বলেন। ইতিহাসের পাতায় দু’জন ব্যক্তির নাম জানা যায়— গুলজার মাস্টার এবং ডা. আব্দুস সোবহান। এ বিশিষ্ট ব্যক্তিদ্বয়ের আহ্বানে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন হাটাব-বীরহাটাব গ্রামে আসেন। কেউ কেউ বলেছে, আনুমানিক প্রায় ২৫০ জন লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। সেদিন আরও অন্যান্য শায়েখ-মাশায়েখ উপস্থিত ছিলেন।
জামি‘আর প্রতিষ্ঠা : ঐতিহাসিক সেই দিনে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ বক্তব্য রাখেন। উপস্থিত অন্যান্য শায়েখ-মাশায়েখও বক্তব্য রাখেন। শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ-এর আশা জাগানিয়া ও উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্যে[1] বিমুগ্ধ, উৎসাহিত ও আশান্বিত হয়ে এলাকাবাসী তাকে প্রতিষ্ঠান করার অনুরোধ করেন। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ-এর তত্ত্বাবধানে ২৪ আগস্ট, রোজ মঙ্গলবার আনুমানিক দুপুর ২টায় আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ-এর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এমন অজ পাড়াগাঁয়ে প্রজ্বলিত হয় শতাব্দীর এক যুগান্তকারী প্রদীপ। এক দশক না পেরোতেই যার আলো ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। ইনশা-আল্লাহ ক্বিয়ামত অবধি এর আলোয় আলোকিত হবে পুরো বিশ্ব।
নামকরণের ইতিহাস : আনুমানিক ২০০ বছরের দলীলদস্তাবেজ ঘেঁটে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো নাম পাওয়া যায়নি। তবে সর্বশেষ যে নামটি পাওয়া যায় তা হলো— ‘বীরহাটাব কৃষক শ্রমিক হাফেযিয়া মাদরাসা’। বিশ্বস্তসূত্রে আরেকটি নাম জানা যায়, তা হলো— ‘বীরহাটাব কৃষক শ্রমিক ফোরকানিয়া হাফেযিয়া মাদরাসা’। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয়, ‘আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ’। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, এ সময় শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ-এর মেজো ছেলে আব্দুর রহমান বিন আব্দুর রাযযাক ভারতের বানারসে অবস্থিত জগদ্বিখ্যাত সালাফী প্রতিষ্ঠান আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহতে অধ্যয়নরত ছিলেন। তার পরামর্শে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ-এর সম্মতিতে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ‘আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ’।
আবাসিক ভবন : ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট, প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনের প্রথম দিনে ছাত্ররা মসজিদে রাত্রিযাপন করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বর্তমান বালিকা শাখার মূল ভবনের ডান পাশে প্রথম তিনটি রুম তৈরি করা হয়। আল-জামি‘আর আবাসিক ভবনের মূল কাজ শুরু হয় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। ২০১৮ সালে ভবনের কাজ সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য, ভবনের নামকরণ আগে করা হলেও ২০১৫ সালে দৃশ্যমান সাইনবোর্ড স্থাপনের মাধ্যমে ‘শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহ.) ভবন’ নামটি বাস্তবায়ন করা হয়। মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে শনৈ শনৈ আল-জামি‘আর সার্বিক উন্নতি-অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।
শিক্ষকমণ্ডলী : ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট, উদ্বোধনী ভাষণের পর বীরহাটাব জামে মসজিদে সমবেত জনতার সামনে শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ হাফিযাহুল্লাহ শিক্ষকমণ্ডলীকে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রথমদিকের শিক্ষকগণের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণ হচ্ছেন, শায়খ মোখলেসুর রহমান বিন আরশাদ মাদানী (প্রিন্সিপাল), আল ইমরান, নূরুল ইসলাম, মেছবাহ উদ্দীন ও হাফেয আব্দুর রাকীব। বর্তমান দেশ-বিদেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একদল অভিজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমান শায়খ আব্দুল আলীম ইবনে কাওছার মাদানী এবং এম. এ. এমরান যথাক্রমে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করে যাচ্ছেন।
স্মরণীয় ব্যক্তিবর্গ : প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পেছনে যাদের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— (১) গুলজার মাস্টার। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যে দু’জন ব্যক্তি শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফকে আহ্বান করেন, তাদের অন্যতম হচ্ছেন গুলজার মাস্টার। তিনি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যাবতীয় স্থানীয় বাধাবিপত্তি নিষ্পত্তি করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি আল-জামি‘আহকে অনেক ভালোবেসেছেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন এবং তার উপর রহম করুন। (২) ডা. আব্দুস সোবহান। আল-জামি‘আহ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে যে দু’জন ব্যক্তি শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফকে আহ্বান করেন, তাদের অপরজন হচ্ছেন ডা. আব্দুস সোবহান। তিনিই প্রথম ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল শায়খ আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফকে প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার অনুরোধ করেন। ডা. আব্দুস সোবহান ‘সালাফী কনফারেন্স’-এর এক বক্তব্যে বলেন, আমি আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহকে মদীনা ইউনিভার্সিটি হিসেবে স্বপ্ন দেখি। (৩) এম. এ. এমরান। আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ-এর বর্তমান উপাধ্যক্ষ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে আল-জামি‘আর প্রতিটি ইটের পেছনে তার পরিশ্রম রয়েছে। গুলজার মাস্টারের মৃত্যুর পরে যাবতীয় বাধা ও অপচেষ্টা রুখে দিতে তার অবদান অনস্বীকার্য।
পাশাপাশি সাবেক প্রিন্সিপাল হাশেম আলী এবং বর্তমান প্রিন্সিপাল শায়খ আব্দুল আলীম মাদানী উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। এর বাইরে এলাকাবাসীসহ দেশ ও প্রবাসের অসংখ্য দ্বীনী ভাই ও বোনের আল-জামি‘আর প্রতি অসামান্য অবদান রয়েছে, যাদের বিবরণ পেশ করা সম্ভব নয়! আল-জামি‘আহ তাদের সকলের অবদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকে উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন!
আল-জামি‘আর অবদান : বিশ্ব মানচিত্রে কালেমার পতাকা উড্ডীন রাখতে আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাওহীদের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে শিরক-বিদআতের মূলোৎপাটন করে জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে চলেছে আল-জামি‘আহ। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ইলমের আলো জ্বালাতে ইতোমধ্যে রাজশাহী, দিনাজপুর ও বরিশালেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ। আল-জামি‘আহ থেকে শিক্ষা সমাপনকারী বহু শিক্ষার্থী বর্তমান দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেশ ও জাতির জন্য ইলমী সেবাসহ নানামুখী সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কুরআনে কারীম ও ছহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে আল-জামি‘আহ থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে গবেষণামূলক পত্রিকা ‘মাসিক আল-ইতিছাম’। দিশেহারা সমাজের শিশু-কিশোরদের মেধা বিকাশে আল-জামি‘আহ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘ত্রৈমাসিক কিশলয়’। প্রকাশনার জগতে অবদান রাখতে আল-জামি‘আহ প্রতিষ্ঠা করেছে ‘মাকতাবাতুস সালাফ’, যেখান থেকে বেশকিছু বই-পুস্তক ইতোমধ্যে বের হয়েছে এবং আরো নানামুখী লেখনি প্রকাশের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। দাওয়াতী মাঠে বিশেষ ভূমিকা রাখছে ‘আদ-দাওয়াহ ইলাল্লহ’। ‘প্রতিটি মসজিদ হোক দ্বীন শিক্ষার প্রথম পাঠশালা’ —এই স্লোগান নিয়ে দেশব্যাপী মসজিদভিত্তিক মক্তব প্রতিষ্ঠা করে আল-কুরআনের আলো সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে আদ-দাওয়াহ ইলাল্লহ। আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ-এর রয়েছে সমাজসেবামূলক কর্ম তৎপরতা। তাইতো বন্যা, ঝড়সহ জনগণের নানা বিপদে আল-জামি‘আহ বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। আল-জামি‘আর সব শাখা মিলে শত শত ইয়াতীম ও অসহায় শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। এই অঙ্গনে কর্মসংস্থান হয়েছে শতাধিক নারী ও পুরুষের।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নিবরাস ইসলামিক রিসার্চফাউন্ডেশন’, যা সরকারিভাবে অনুমোদিত ও নিবন্ধিত। এই ফাউন্ডেশনের অধীনেই উল্লিখিত সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
মহান আল্লাহ আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহকে কবুল করুন- আমীন!
আল-জামি‘আর ইতিহাসপ্রিয় কতিপয় ছাত্র
প্রবন্ধটি লিখেছে আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ-এর দশম শ্রেণির ছাত্র ইবনু মাসঊদ ও আবূ সাঈদ।
প্রবন্ধটির মাঝে নিহিত তথ্য সংকলনে সহযোগিতা করেছে— শাহিনুর রহমান, সাকিব ইবনে ইসলাম।
[1]. এখানে আশা জাগানিয়া ও উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য বলতে ২০১৩ সালের ২৪ আগস্ট, রোজ মঙ্গলবার কাঁঠালগাছ তলার সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যকে বুঝানো হয়েছে।