কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ক্বীমাতুয যামান বা সময়ের মূল্য

قِيْمَةُ الزَّمَن (ক্বীমাতুয যামান) দুটি আরবী শব্দ।*যার অর্থ হচ্ছে সময়ের মূল্য। এটি দুটি শব্দের একটি ছোট্ট শিরোনাম হলেও এর মাঝে লুকিয়ে আছে বিশাল অর্থের সমাহার। কেননা পৃথিবীর আদি থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত প্রত্যেক সফল মানুষই সময়ের মূল্য বুঝেছেন এবং তা যথাসাধ্য ব্যবহার করেছেন। যারাই সময়ের মূল্য বুঝেছেন তারাই সময়ের যথাযোগ্য ব্যবহার করেছেন। একজন কৃষক যেমনভাবে সময়কে কাজে লাগায় একজন রাজমিস্ত্রি কিন্তু সময়কে সেভাবে কাজে লাগায় না। অর্থাৎ একজন কৃষকের কাছে সময়ের মূল্য যেমন রাজমিস্ত্রির কাছে সময়ের মূল্য ঠিক তেমন নয়। আর ঠিক এভাবেই প্রত্যেক সত্তার কাছে সময়ের মূল্য এবং ব্যবহার পদ্ধতি ভিন্ন। আর ঠিক একইভাবে একজন প্রকৃত আলেমে দ্বীন ও ত্বলেবে ইলমের কাছে সময়ের মূল্য আরও মূল্যবান এবং ভিন্ন।

কিন্তু আমরা কে কীভাবে সময়ের ব্যবহার করছি? কতটুকু সময়ের মূল্য দিচ্ছি? আমরা কি সময়কে যথাযথভাবে ব্যবহার করছি? নিজেকে প্রশ্ন করলেই আমরা এর সঠিক উত্তর পেয়ে যাব। যেখানে আল্লাহ তাআলা বলছেন,وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ ‘যদি তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ গণনা কর, তাহলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। মানুষ অবশ্যই অতিমাত্রায় যালেম, অকৃতজ্ঞ’ (ইবরাহীম, ১৪/৩৪)। যেখানে আমরা আমাদের অস্তিত্বের সূচনালগ্ন থেকেই আল্লাহর অথৈ নেয়ামতে নিমজ্জিত। কিন্তু সেখানে আমরা নানা অপ্রয়োজনীয় কাজে আমাদের সময়কে অতিবাহিত করছি আর বলছি যে, আল্লাহর শুকরিয়া তো করছিই, সময়কে তো কাজে লাগাচ্ছিই।

এই জগৎ সংসারের সূচনালগ্ন থেকেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আকাশ-বাতাস, সূর্য-চন্দ্র, গ্রহ-নক্ষত্র এমনকি বিশ্বের সকল কিছুকেই এক নির্ধারিত সময়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। সূর্যের উদয়াস্তের এই চক্র সময়ের ফ্রেমেই শিকলবন্দী। আর ঠিক তেমনভাবেই চন্দ্রের খেলা আমরা প্রতি নিশিতেই লক্ষ্য করি। আর এভাবেই মহান আল্লাহ এই দিবারাত্রিকে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই পরিচালনা করে আসছেন। আর তিনি এখানেই ক্ষান্ত নন, আমাদের শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামের বিভিন্ন বিধি-বিধানকেও সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেমন হজ্জ একটি নির্দিষ্ট সময়ে করতে হয়। আর ছালাতেরও রয়েছে নির্ধারিত সময়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَوْقُوتًا ‘তোমরা ছালাত প্রতিষ্ঠা করো, নিশ্চয় ছালাত মুমিনদের উপরে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা ফরয’ (আন-নিসা, ৪/১০৩)। আর ঠিক এই একই কথা বর্ণিত হয়েছে হাদীছে। ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! কোন আমলটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, الصَّلَاةُ فِي أَوَّلِ وَقْتِهَا ‘শুরুর সময়ে ছালাত আদায় করা’।[1]

আমরা উল্লিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে সময়ের গুরুত্ব ও তাত্পর্য সম্পর্কে বুঝতে পারি। যেখানে মহান আল্লাহ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকনটিকে সময় নির্ভর করে দিয়েছেন। সময়ের গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় সময়ের কসম করেছেন। তিনি বলেন,وَاللَّيْلِ إِذَا يَغْشَى-وَالنَّهَارِ إِذَا تَجَلَّى ‘শপথ রাত্রির! যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের! যখন তা উদ্ভাসিত হয়’ (আল-লায়ল, ৯২/১-২)। তিনি আরও বলেন, وَالضُّحَى-وَاللَّيْلِ إِذَا سَجَى ‘শপথ পূর্বাহ্ণের! শপথ রাত্রির! যখন তা গভীর হয়’ (আয-যুহা, ৯৩/১-২)। তিনি আরো বলেন, وَالْفَجْرِ-وَلَيَالٍ عَشْرٍ ‘শপথ ফজরের! শপথ দশ রাতের!’ (আল-ফজর, ৮৯/১-২)। তিনি আরও বলেন, وَالْعَصْرِ-إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ ‘সময়ের শপথ! নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত’ (আল-আছর, ১০৩/১-২)। এভাবে আল্লাহ তাআলা কোথাও দিনের, কোথাও রাতের, কোথাও সকালের আবার কোথাও সময়ের কসম করেছেন। এভাবে রাত-দিনের কসম করে আল্লাহ তাআলা রাত, দিন, সকাল ও সন্ধ্যা এবং সর্বোপরি সময় নিয়ে বান্দাদেরকে চিন্তা ও গবেষণা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো খুব কম লোকই এগুলো নিয়ে গবেষণা করে, খুব কম সংখ্যক মানুষই সময়ের গুরুত্ব বুঝে।

সময়ের গুরুত্ব যে অপরিসীম এ কথার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমাদেরকে সময়ের মূল্য দিতে হবে, সময়কে ভালো কাজে লাগাতে হবে, সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে, হেলায় খেলায় অহেতুক কাজে সময়কে নষ্ট করা যাবে না। সময় এমন এক অমূল্য রত্ন, যা একবার চলে গেলে আর কখনই ফিরে আসে না। তাই উদাহরণ দেওয়া হয়, সময় হলো বহমান নদীর স্রোতের ন্যায়। নদীর স্রোত যেভাবে বয়ে চলে নিরবধি, যা একবার বয়ে চললে আর কখনো ফিরে আসে না। ঠিক সময়ও এরকম, যা একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না। ধনসম্পদ তো হারিয়ে গেলে তা আবার ফিরে পাওয়ার আশা থাকে, কিন্তু সময় যদি হারিয়ে যায় তা আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না। আর এ নিয়ে তো একটা বিখ্যাত ইংরেজি বাক্য আছে যা সবারই জানা, Time and Tide wait for none/no man. অর্থাৎ সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। 

যদি আমরা আমাদের সালাফে ছালেহীনের দিকে দেখি, কীভাবে তারা সময়কে কাজে লাগিয়েছেন তাহলে দেখব যে, আমাদের আর তাদের মাঝে কত পার্থক্য! কত মনীষী তো না খেয়ে শুধু পড়ার পিছনে সময় দিয়েছেন। কতজন তো না ঘুমিয়ে পড়ার পিছয়ে সময় দিয়েছেন। তারা এতই পরিশ্রম করেছেন যে, আমাদের পরিশ্রম তাদের পরিশ্রমের ধারে কাছেও না।

আমরা দেখি ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রাহিমাহুল্লাহ-কে, যিনি একাধারে ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ দাঊদ, ইমাম আবু হাতিম রাযী রাহিমাহুমুল্লাহ-এর মতো বড় বড় মুহাদ্দিছীনে কেরামের শিক্ষক ছিলেন। আলী ইবনুল মাদিনী রাহিমাহুল্লাহ তার সম্পর্কে বলেন, ইলম যেন তাঁর কাছে গিয়ে শেষ হয়ে যায়। তিনি তার পিতার ওয়ারিছ সূত্রে ১০ লক্ষ মুদ্রা পান। কিন্তু তিনি তার সম্পদের সবটুকুই তার পড়াশোনার পিছনে ব্যয় করেন। এমন এক সময় আসে যখন তার কাছে স্যান্ডেল কেনার মতো মুদ্রা ছিল না। তিনি তার পড়াশুনার পেছনে এতটা সময় ব্যয় করেছেন যে, এ বিপুল পরিমাণ সম্পদ দিয়ে আরাম-আয়েশ করার মতো সময় তার হয়নি।

হাফেয ইবনু মানদাহ রাহিমাহুল্লাহ তিনি ৪৫ বছর শিক্ষাঙ্গনে কাটান। জানা যায় তার শিক্ষকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭০০ জন। সুবহানাল্লাহ! তাদের কাছে সময় অতিবাহিত করার মানেই ছিল জ্ঞানার্জন। আর আমাদের কাছে সময় অতিবাহিত করার মানেই হচ্ছে ক্যারিয়ার গঠন। আর বর্তমান দুনিয়াতে তো ক্যারিয়ার গঠনের মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা-পয়সা উপার্জন। আসলেই এটা আমাদের জন্য একটি দুঃখজনক বিষয় ।

ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ-এর একটানা দুই বছর বিছানায় পিঠ রেখে ঘুমানোর মতো সময় হয়নি। সারাদিনে ১২টি বইয়ের দারস নিতেন এবং দিনে মাত্র এক বার খেতেন, ক্বাযায়ে হাজাতের (প্রাকৃতিক প্রয়োজন বেড়ে যাওয়া) ভয়ে। আর এভাবেই তিনি লাগাতার ছয় বছর পরিশ্রম করেছেন। আর আমাদের কাছে তো দিনের একটা নির্দিষ্ট অংশে বই নিয়ে বসে থাকাটাই পরিশ্রম।

এভাবে যদি আমাদের পূর্ববর্তী সকল আলেমে দ্বীন, আমাদের সালাফে ছালেহীন, সফল ব্যক্তিগণের দিকে লক্ষ্য করা হয় তাহলেই তাদের কাছে সময়ের মূল্য কতটুকু ছিল এবং তারা সময়কে কীভাবে মূল্যায়ন করতেন তা উপলদ্ধি করা যায়। ‘কানযুল আজদাদ’ গ্রন্থে মুহাম্মাদ কুরদ আলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইবনু জারীর আত্ব-ত্বাবারী রাহিমাহুল্লাহ তার জীবনে এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করতেন না। কারণ তিনি বেঁচে ছিলেন প্রায় ৮৬ বছর। আর তার লিখিত রচনাবলির পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার। সে হিসেবে তিনি দিনে গড়ে প্রায় ১১ পৃষ্ঠা করে লিখতেন। সুবহানাল্লাহ।

ইয়াহইয়া ইবনে হাবায়রা রাহিমাহুল্লাহ বলেন,الوقت أنفُسُ ما عُنيتَ بحفظه وأراه أَسهلَ ما عليك يضيع ‘যা কিছুর সংরক্ষণে তুমি সচেষ্ট হতে পার, তন্মধ্যে সময় হচ্ছে সবচেয়ে মূল্যবান। অথচ আমি দেখছি, সেটাই সবচেয়ে সহজে তোমার কাছে বরবাদ হচ্ছে’।

আর সময়ের মূল্য বোঝানোর জন্য বলা হয়, الوقب كالسيف إن لم تقطعه قطعك অর্থাৎ ‘সময় হলো তরবারির মতো, যদি তুমি তাকে না কাটো, তবে সে তোমাকে কেটে ফেলবে’। অর্থাৎ কাজের মাধ্যমে তুমি সময়কে কর্তন করো। যথাযথভাবে সময়কে কাজে লাগাও। সে যেন তোমাকে কাজের আশ্বাস দিয়ে নিষ্কর্মা ও নিঃশেষ করে দিতে না পারে। এ বাক্যের অর্থ আরও স্পষ্ট করার জন্য বলা যায়, তুমি যদি সময়কে কাজে লাগানো এবং সময় থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে সজাগ না হও, তাহলে তুমি তরবারির আঘাতের সম্মুখীন হবে। কেননা, তরবারি থেকে আত্মরক্ষা জন্য যদি সজাগ না হও, তবে তরবারির আঘাত তোমাকে শেষ করে দিবে।

আমাদেরকে আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয় বুঝতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সময় দিতে হবে। এখন যদি কেউ বলে খেলাধুলা করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো তাই আমি সারাদিন খেলব অথবা খাওয়া তো আবশ্যকীয় বিষয় সুতরাং আমি দিনে ছয় বেলা করে খাব, তাহলে সেটি হলো বোকামী। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ধরুন একটা কলস রয়েছে এবং তার পাশে কিছু পাথরের ছোট্ট ছোট্ট টুকরা, বালি, ইটের গুড়া এবং পানি রয়েছে। এখন যদি আপনাকে বলা হয় যে, কলসটা এমনভাবে পূর্ণ করুন যাতে করে সবগুলো পদার্থই তার মধ্যে থাকে। এখন যদি আপনি আগে পানি দিয়ে কলসটা পূর্ণ করে দেন তারপর যদি অন্য জিনিস সেটাতে রাখতে চান তাহলে তো পানি উপচে পড়ে যাবে। আবার যদি আগে বালি দিয়ে পূর্ণ করে ফেলেন তাহলে পাথরের টুকরাগুলো রাখার জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না।

কিন্তু যদি আপনি প্রথমে পাথরের টুকরোগুলো রাখেন তাহলে দেখবেন পাথরগুলোর আকার বড় হওয়ার কারণে বেশকিছু অংশ ফাকা থাকবে, তারপর আপনি ইটের গুড়া রাখেন, তারপর বালিকণা রাখেন, তারপর পানি রাখেন তখন দেখবেন বালু প্রয়োজন অনুযায়ী পানি চুষে নিবে এবং প্রত্যেক বস্তু নিজ নিজ অবস্থানে চলে যাবে।

 আর এভাবেই কলসটা একদম আপনার চাহিদা অনুযায়ী পূরণ হয়ে যাবে।

ঠিক সেই পাথরের টুকরাগুলোর মতোই হচ্ছে আমাদের জীবনে ইসলামী জ্ঞানার্জন এবং আমাদের ইবাদত। আর অন্যান্য বিষয়গুলি সেই ইটের গুড়া, বালুকণা এবং পানির মতো। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে জীবনে কোনটার প্রয়োজন কেমন এবং তদনুযায়ী তার পিছনে কতটুকু সময় দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রয়োজন বুঝে সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

সায়্যিদ তাসনীম আল-আমান

* ছানাবিয়্যাহ ১ম বর্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, রাজশাহী।

Magazine