কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ধৈর্যশীল হোন!

post title will place here

ছবর (صبر) আরবী শব্দ। এর অর্থ হলো ধৈর্য, ছবুর ও সহনশীলতা। পারিভাষিক সংজ্ঞায় ইবনুল ক্বাইয়িম রাহিমাহুল্লাহবলেন,الصبر حبس النفس عن الجزع واللسان عن الشكوى والجوارح عن لطم الخد وشق الجيب ونحوهما ‘ছবর হলো— বিপদের সময় অন্তরকে অস্থিরতা থেকে, জিহ্বাকে অভিযোগ থেকে, আর অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আঘাত করা, কাপড় ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত রাখা’।[1] ছবর বা ধৈর্য সম্পর্কে ইবনু আজীবাহ রাহিমাহুল্লাহবলেন, ‘ধৈর্য ঈমানের জন্য মাথার মতো, দেহ থেকে মাথা কেটে ফেললে যেমন দেহ মারা যায়, তেমনি ধৈর্য চলে গেলে ঈমানও শেষ হয়ে যায়’।[2]

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, ধৈর্য মানবজীবনে অপরিসীম ও সীমাহীন গুরুত্ব বহন করে। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘হে মুমিনগণ! ধৈর্য ও ছালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে থাকেন’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৩)

হে মুসলিম ভাই! আপনি আপনার সকল পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করুন এবং ধৈর্যধারণ করুন। ধৈর্য হলো মানবজীবনের সফলতার হাতিয়ার। মানুষের প্রতিটি কাজ নির্ভর করে ধৈর্যের উপর।

এই পৃথিবীতে যে যত বেশি আল্লাহভীরু, তার উপর বিপদ তত কঠিন। বিপদে পতিত হলে আমাদের বিচলিত হওয়া যাবে না; বরং ধৈর্যধারণ করতে হবে। আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসেন, তাকে বেশি বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন।

কোনো মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন সে মনে করে যে, হয়তো আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেন না, আমার কল্যাণ চান না; যদি কল্যাণ চাইতেন, তাহলে কেন আমাকে এত বিপদ দিয়েছেন? আমাদের এই ধারণা নিতান্তই ভিত্তিহীন, যেমনটি আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী থেকে জানতে পারি। শুধু তাই নয়, মানুষ আরও বলে, আমি তো পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় করি, দান-ছাদাক্বাও করি; তবুও কেন আমার উপরই আল্লাহ বিপদ দেন? এই কথাটি অজ্ঞ ব্যক্তি ছাড়া কেউ বলে না। যেমনটি আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী থেকে জানতে পারি। এই মর্মে হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ t قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ.

আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে তিনি দুঃখ-কষ্টে ফেলেন’।[3]

আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের বিপদাপদ, জানমাল ও সন্তানসন্ততির ক্ষতি দিয়ে আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন। আমরা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনী পড়লে এমন অনেক ঘটনা দেখতে পাই। হাদীছে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বার নিকটে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছিলেন আর কুরাইশের একদল লোক তাদের মজলিসে উপবিষ্ট ছিল। তাদের মধ্য হতে এক ব্যক্তি বলল, তোমরা কি এই লৌকিকতা প্রদর্শনকারীকে দেখছ না? তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে অমুক গোত্রের উট যবেহ করার স্থানে গিয়ে সেখান হতে গোবর, রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি নিয়ে আসবে, অতঃপর অপেক্ষা করবে। যখন তিনি সিজদায় যাবেন, তখন এগুলো তার দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দিবে? এ কাজের জন্য তাদের চরম দুর্ভাগা ব্যক্তি (উক্ববা ইবনু আবী মুআইত) উঠে দাঁড়াল (এবং তা নিয়ে আসল)। যখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় গেলেন, তখন সে তাঁর দুই কাঁধের মাঝখানে সেগুলো রেখে দিল। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় স্থির রয়ে গেলেন। এতে তারা পরস্পর হাসাহাসি করতে লাগল। এমনকি হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ের উপর লুটোপুটি করতে লাগল। (এ অবস্থা দেখে) এক ব্যক্তি ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট গেলেন। তখন তিনি ছিলেন ছোট বালিকা। তিনি দৌড়ে চলে এলেন। তখনও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় স্থির ছিলেন। অবশেষে তিনি (ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা) সেগুলো তাঁর উপর হতে ফেলে দিলেন এবং মুশরিকদের লক্ষ্য করে তিরস্কার করতে লাগলেন।[4]

শুধু তাই নয়, আমরা ছহীহ বুখারীর আরেকটি হাদীছ পড়লে বুঝতে পারি, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কাফেরদল কীভাবে নির্মমভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। একদিন ছালাতরত অবস্থায় উক্ববা ইবনু আবী মুআইত এসে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান! জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে খবর দিলে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন এবং বদমাশগুলোকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করতে চাও, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ? তিনি তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন। এ সময় তারা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ছেড়ে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বেদম প্রহার করে’।[5]

প্রিয় মুসলিম ভাই! আপনি একটু ভেবে দেখুন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কঠিন বিপদে পড়েও ধৈর্যহারা হননি। আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল ও ধৈর্যধারণ করে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করেছেন।

তিনি অন্ধকার থেকে আলোর পথে, জাহান্নাম থেকে জান্নাতের পথে মানুষকে নিয়ে এসেছেন। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পরশপাথরের ছোঁয়ায় জাহেলী যুগের অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষগুলোকে আদর্শ ও সোনার মানুষে পরিণত করেছেন। পৃথিবীতে চলার ক্ষেত্রে আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষতি দিয়ে পরীক্ষা করেন, এর মানে এই নয় যে, আল্লাহ বান্দার ক্ষতি চান। আল্লাহ যে মানুষকে মহামূল্যবান জান্নাতে দিবেন, তা কি কোনো প্রকার পরীক্ষা ছাড়াই দিবেন? আল্লাহ দেখতে চান বান্দা আমার জন্য সব অবস্থাতে প্রস্তুত আছে কি-না। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ ‘আমরা তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আর তুমি ধৈর্যশীলদেরকে শুভ সংবাদ দাও’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫৫)

শুধু তাই নয়, আমরা যদি আরও কিছু শতাব্দী পূর্বে দেখতে যাই, তাহলে ইয়াকূব আলাইহিস সালাম-এর সন্তান হারানোর কঠিন মুহূর্তে উত্তম ধৈর্যধারণ করার নমুনা দেখতে পাই। বালক ইউসুফ আলাইহিস সালাম একদিন তার পিতা ইয়াকূব আলাইহিস সালাম-এর কাছে এসে বললেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, ১১টি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্র আমাকে সিজদা করছে’। একথা শুনে পিতা বললেন, বৎস! তোমার ভাইদের সামনে এ স্বপ্নের বর্ণনা করো না। তাহলে ওরা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু (ইউসুফ, ১২/৪-৫)

১০ জন বৈমাত্রেয় ভাই মিলে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে হত্যার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য তাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয় নিল। তারা একদিন পিতা ইয়াকূব আলাইহিস সালাম-এর কাছে এসে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে সাথে নিয়ে পশু চরাতে যাওয়ার প্রস্তাব করল। তারা পিতাকে বলল যে, আপনি তাকে আগামীকাল আমাদের সাথে প্রেরণ করুন, সে আমাদের সঙ্গে যাবে, সানন্দে ঘোরাফেরা করবে আর খেলাধুলা করবে, আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব’। জবাবে পিতা বললেন, ‘আমার ভয় হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে আর তোমাদের অসতর্ক মুহূর্তে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলবে’। তারা বলল, ‘আমরা এক দল লোক থাকা সত্ত্বেও যদি নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে তো আমরা সকলেই অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হব’ (ইউসুফ, ১২/১২-১৮)

যাহোক, ছেলেদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি রাজি হলেন, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে তাদের সাথে পাঠান। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছেই শয়তানী চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠল। তারা ইউসুফকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হলো। তখন বড় ভাই ইয়াহুদা তাদের বাধা দিল। অবশেষে বড় ভাই প্রস্তাব করল, বেশ! তবে ওকে হত্যা করো না; বরং ঐ দূরের একটা পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দাও, যাতে কোনো পথিক এলে ওকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তাতে তোমাদের দুটি লাভ হবে— ১. সে পিতার কাছ থেকে দূরে যাবে এবং তোমরা তখন পিতার নিকটবর্তী হবে। ২. নিরপরাধ কাউকে হত্যা করার পাপ থেকে বেঁচে যাবে। ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে অন্ধকার কূপে ফেলে দিয়ে দলটি ছাগলছানা যবেহ করে তার রক্ত ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর পরিত্যক্ত জামায় মাখিয়ে তারা সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরল এবং কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলো এবং বলল, হে পিতা! আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আসবাবপত্রের কাছে রেখেছিলাম। এমতাবস্থায় বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলেছে। আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী। এ সময় তারা তার মিথ্যা রক্তমাখানো জামা হাযির করল। এটা দেখে ইয়াকূব আলাইহিস সালাম অবিশ্বাস করে বললেন, ‘কখনোই নয়, বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কথা তৈরি করে। অতএব, উত্তম ছবর করাই শ্রেয়। তোমরা যা কিছু বললে তাতে আল্লাহই আমার একমাত্র সাহায্যস্থল (ইউসুফ, ১২/১৬-১৮)

প্রিয় মুসলিম ভাই! দেখুন ইয়াকূব আলাইহিস সালাম কোনো প্রতিবাদ না করে ধৈর্যধারণ করলেন। তাই আমাদের সকল বিপদাপদে ধৈর্য ধরতে হবে।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে ধৈর্যশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন- আমীন!

তাওহীদুর রহমান ইবনু মঈনুল হক্ব

অধ্যয়নরত, আলিম ১ম বর্ষ, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।


[1]. মাদারিজুস সালিকিন, ২/১৬৮।

[2]. আল-বাহরুল মাদীদ ফী তাফসীরিল ‍কুরআনিল মাজীদ, ১/৪৫৭; আল-হিদায়াহ ইলা বুলূগিন নিহায়াহ, ১/৮৮১।

[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৬৪৫; মিশকাত, হা/১৫৩৬।

[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২০।

[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩৭৮।

Magazine