দৃষ্টিশক্তি অন্তরের অন্যতম চালিকাশক্তি। দৃষ্টিই ক্বলবের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে। দৃষ্টি দিয়ে আমরা যা দর্শন করি, তার নকশা সরাসরি অন্তরে তৈরি হয়। দর্শনকৃত বস্তু, ব্যক্তি বা ঘটনা আকৃতি আকারে ক্বলবের সঙ্গে আলিঙ্গন করে। আর হারাম দৃষ্টিপাত দ্বারা এমন পাথেয় সংগ্রহ করা যায়, যা অন্তরকে ত্যাগ করে না এবং অনুভূতিকেও জাগ্রত করে না। এর মতো অদৃশ্য এবং ভয়ানক কোনো অস্ত্র আর নেই। অস্ত্রের আঘাত ছাড়াই একজন পরাহত ও অপরজন পরাঘাতকারী হয়। এর কারণে অন্তর দিশেহারা হয়ে পড়ে। অপাত্রে চাহনিতে অন্তরে রোগের উৎপত্তি ঘটে। হারাম দৃষ্টিপাত আরামের ঘুম হারাম করে। চাহনির মাধ্যমে বীর বাহাদুরও সহজেই বশ্যতা স্বীকার করে। চোখের কুদৃষ্টির কারণে নফস বিভ্রান্ত হয় এবং সে মালিককে দাসে পরিণত করে। প্রত্যেকটা হারাম দৃষ্টিপাত মানুষের মাঝে প্রভাব সৃষ্টি করে। কুদৃষ্টির তিরগুলো দ্রুত পতিত হয়, অতঃপর অবসাদ ঘটিয়ে ফিরে চলে যায়। আলোচ্য নিবন্ধে এই বিষয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশা-আল্লাহ।
নেক সুরতে ধোঁকা:
শয়তান মানবজাতির প্রকাশ্য শত্রু। সে মহান আল্লাহর নিকট অবকাশ নিয়েছে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত। যাতে করে সে আমাদের প্রতিটা শিরা-উপশিরা ও রগের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলাফেরা করতে পারে। দিতে পারে কুমন্ত্রণা। নিপতিত করতে পারে ধোঁকায়।
শয়তান সাধারণত কোনো আলেম কিংবা আবেদের নিকটে সরাসরি আসে না। আসে না দ্বীনহীন কিংবা নগ্ন বেশে। কারণ সে জানে একজন মুমিন নারীকে যেমন বখাটে ঈমানহীন যুবকের চক্করে নিপতিত করা সহজ নয়, তেমনি একজন মুমিন যুবককে অর্ধনগ্ন, তৃতীয় শ্রেণির নারী দ্বারা ফেতনায় নিপতিত করাও সহজ নয়।
কেননা তাক্বওয়াবান নারী-পুরুষ উভয়েই তাদের থেকে দৃষ্টিকে হেফাযত করে থাকেন। ঈমান এবং ব্যক্তিত্ব বহাল রাখতে এড়িয়ে চলেন তাদের। তাছাড়া তাদের প্রতি দৃষ্টিপাতে থাকে না তেমন আকর্ষণ বরং চেহারায় ফুটে ওঠে একরাশ ঘৃণা কিংবা বিরক্তিবোধ। পক্ষান্তরে একজন মুমিন নারী ও পর্দানশিন নারীর প্রতি যেমন একজন ঈমানদার যুবকের সম্মান, শ্রদ্ধা এবং বিশেষ আকর্ষণ থাকে, তেমনি একজন পরহেযগার, দাড়িওয়ালা যুবকের প্রতি একজন মুমিনা নারীর সম্মান, শ্রদ্ধা এবং বিশেষ আকর্ষণ থাকে।
শয়তান এই সুযোগটা ব্যবহার করে তাক্বওয়াবান নারীর নিকট দাড়ি-টুপি পরিহিত বেশে সাক্ষাৎ করে। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, হুজুরদের দিকে দৃষ্টিপাত করা দোষের কিছু নয়। ফলশ্রুতিতে অনেক দ্বীনি বোন ধোঁকায় নিপতিত হন। বখাটে ঈমানহীন যুবকদের দিকে না তাকালেও হুজুরের দাড়ি-টুপির দিকে নযর বুলাতে ভুলেন না।
অনুরূপ শয়তান তাক্বওয়াবান যুবকের নিকটে বোরকাবৃত হয়েই সাক্ষাৎ করে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে এ তো তোমারই সমগোত্রীয়। সুতরাং বোরকা পরিহিতা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা দোষের কিছু নয়। ফলশ্রুতিতে অনেক দ্বীনদার যুবক ধোঁকায় নিপতিত হন। অর্ধনগ্ন, তৃতীয় শ্রেণির নারীদের দিকে না তাকালেও বোরকাওয়ালীর দিকে নযর বুলাতে ভোলেন না।
হারাম দৃষ্টিপাতের অপকারিতা:
চক্ষু অন্তরের আয়নাস্বরূপ। কেউ যখন তার চক্ষুকে নতজানু রাখে, তখন অন্তর প্রবৃত্তি ও প্রবঞ্চনাকে দমিয়ে রাখে। আর যখন সে চক্ষুকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়, এদিক-সেদিক তাকায়, তখন অন্তরও দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে। কামনা-বাসনার তাড়নায় নানান জায়গায় ঢুঁ মারে। এজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আদম সন্তানের চোখের জন্য যেনার একটি অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অবশ্যই সে তাতে নিপতিত হবে। চোখ যেনা করে, আর তা হচ্ছে হারাম দৃষ্টিপাত। জিহ্বা যেনা করে, আর তা হচ্ছে অশ্লীল বাক্যালাপ। হাত যেনা করে, আর তা হচ্ছে অনৈতিক স্পর্শ। পা যেনা করে, আর তা হচ্ছে অন্যায় পথে পদক্ষেপ। অন্তর যেনা করে, আর তা হচ্ছে কুভাবনা ও কামনা-বাসনা। যৌনাঙ্গ এ সকল যেনার বাস্তবায়নকারী কিংবা প্রত্যাখ্যানকারী’।[1]
সুধী পাঠক! লক্ষ করুন, উল্লিখিত হাদীছে যেনার বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করা হয়েছে। তন্মধ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখের কথা প্রথমে উল্লেখ করেছেন। কেননা অশ্লীলতা তথা যাবতীয় ব্যভিচারের সহজ পন্থা হলো হারাম দৃষ্টিপাত। চোখের দ্বারাই যেনার সূচনা হয়। হাত, পা, মুখ, অন্তর এবং লজ্জাস্থানের যেনার মূলেই হলো চোখ। এ সকল যেনার বাস্তবায়নের তরে চোখ অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহে সর্বদা তৎপর থাকে। ফলে একসময় ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বর্ণিত রয়েছে, আবূ আদইয়ান রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার ওস্তায আবূ বকর দাক্কাক রাহিমাহুল্লাহ-এর সাথে ছিলাম। ইতোমধ্যে এক সুবদন কিশোর পার হয়ে যাচ্ছিল। আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার ওস্তায আমাকে ওর প্রতি তাকিয়ে থাকতে দেখলে তিনি আমায় বললেন, ‘বেটা! এর প্রতিফল তুমি পাবে… যদিও কিছু পরে’। অতঃপর আমি ২০ বছর ধরে লক্ষ করেও ওই প্রতিফল বুঝতে পারলাম না। একদা রাত্রিবেলা ওই কথা চিন্তা করে ঘুমিয়েছি। সকালে জাগ্রত হয়ে দেখি, আমাকে কুরআন ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।[2]
সুধী পাঠক! আপনি ভাবনার চাদর এপাশ-ওপাশ করুন! এ তো সুদর্শন কিশোর দেখার প্রতিফল। পুরুষে পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করাতেই যদি এত ভয়াবহ প্রতিফল হয়, তাহলে যুবতি নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এর ভয়াবহতা কত প্রকট হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের অনুধাবনে ত্রুটি থাকলেও সালাফগণ এর ভয়াবহতা খুব করে উপলব্ধি করতেন এবং কামনা করতেন কুদৃষ্টির কারণে যেন কেবল স্বীয় চক্ষুকেই তুলে নেওয়া হয়, এর চেয়ে যেন অত্যধিক শাস্তির মুখোমুখি তাদের না করা হয়। আমর ইবনে মুরবাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘যদি আমি নারীর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে আকৃষ্ট হই, আর এতে করে আমার দৃষ্টিশক্তি তুলে নেওয়া হয়, তাহলে আমি কামনা করি যে, কেবল এ শাস্তিই যেন আমার অপরাধের কাফফারা হিসেবে পরিগণিত হয়’।[3]
সুধী পাঠক! মনে রাখবেন, সব বিদ্যুৎ চমকানোই কিন্তু কল্যাণের লক্ষণ নয়; কিছু কিছু বিদ্যুৎ চমক অকল্যাণেরও কারণ হয়। সুতরাং আপনি দৃষ্টিকে অবনমিত রাখুন। তাকে সংরক্ষণ করুন। আনুগত্য ও বাধ্যতার কাপড় পরিয়ে রাখুন। কেননা নফসের বাসনা অনুপাতে চলাই আমাদের বিপদের কারণ। চোখের কামনা থেকেই প্রবৃত্তির তাড়নার সূচনা এবং তা নানান অশ্লীলতার দরজা উন্মুক্ত করে দেয়। এজন্য কবি বলেছেন,
অর্থাৎ ‘সমস্ত দুর্ঘটনার সূত্রপাত দৃষ্টি দেওয়া থেকেই হয়। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটে ক্ষুদ্র অগ্নি থেকেই। কত দৃষ্টি তার কর্তার হৃদয়কে ধ্বংস করেছে ধনুক ও তারহীন তিরের মতো। চোখওয়ালা মানুষ যতক্ষণ কামিনীদের চোখে চোখ রেখে বারবার দৃষ্টিপাত করে, ততক্ষণ সে বিপদের উপর দণ্ডায়মান থাকে। যে জিনিস তার আত্মার জন্য ক্ষতিকর, তা দিয়ে সে নিজের চক্ষুকে খোশ করে। অথচ সেই খুশিকে কোনো স্বাগত নয়, যার পরিণাম হলো ক্ষতি’।[4]
এজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে লক্ষ্য করে বলেন, ‘(হে আলী) তুমি একবার দৃষ্টি দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দিয়ো না। কেননা প্রথম দৃষ্টি তোমার (জন্য অনিন্দনীয়)। তবে দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দেওয়ার অধিকার নেই’।[5] আলোচ্য হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ দৃষ্টি পড়ার পর দ্বিতীয়বার তাকাতে নিষেধ করেছেন। এমনকি নিশ্চিত হওয়ার প্রয়াসে অর্থাৎ প্রথম দৃষ্টিতে সৃষ্ট আকর্ষণ দ্বিতীয়বার তাকানোর ফলে অবশিষ্ট থাকবে না, এমন ভাবনার কোনো অবকাশ নেই।
কেননা পরপর দৃষ্টিপাতের ফলে মনের মাঝে অনুরাগের সৃষ্টি হয়। যেন সে কিনা কি করে ফেলবে। দৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেওয়ার ফলে, সেই দর্শনকৃত সৌন্দর্য অন্তরে ক্রমান্বয়ে স্থায়িত্ব লাভ করে। ফলে অন্তরে কামনার সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ— মনে করুন, আপনি একটা নতুন ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছেন। ঘোড়াটা আপনাকে নিয়ে এমন সরু ও জটিল পথে ছুটছে, যেখান থেকে ঘুরে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। যখনই সে এমন পথে পা বাড়াবে, তখনই আপনি তার লাগাম টেনে ধরবেন। যাতে সে এমন ভয়াবহ পথে ঢুকতে না পারে। আর যদি কয় কদম ঢুকেও যায়, দ্রুত তাকে থামাবেন। তাহলে বিষয়টা সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আপনি তার লাগাম ছেড়ে দেন, তাহলে সে আপনাকে নিয়ে ওই পথে প্রবেশ করে গভীরে চলে যায়, এরপর আপনি লাগাম টেনে ধরেন। পেছনে ফিরে আসার চেষ্টা করেন। সেখান থেকে ফিরে আসা আপনার জন্য একরকম জটিল বা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এমতাবস্থায় কোনো বুদ্ধিমান লোক কি বলতে পারে, আর একটু ভিতরে গেলেই ঘোড়াটা বেরিয়ে আসবে? মুক্তি পাবে?
বস্তুত হারাম দৃষ্টিপাত প্রবৃত্তির চাহিদাপ্রসূত। এখান থেকে প্রচণ্ড উত্তেজনা প্রকাশ পায়। এর সাথে রয়েছে যত দহন যন্ত্রণা এবং চিন্তাভাবনা। ফলশ্রুতিতে দৃষ্টি প্রদানকারী অন্তর্জ্বালার শিকার হয়। সুফিয়ান ছাওরী রাহিমাহুল্লাহ وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفًا ‘মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে’ (আন-নিসা, ৪/২৮) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘একজন নারী পুরুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছে। পুরুষ লোকটি ওই নারীর দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকতে অক্ষম হয় এবং কুদৃষ্টি দেয়। অথচ সে ওই নারীর মাধ্যমে নিজের ফায়দা হাছিল করতে পারে না। এর চেয়ে দুর্বলতা আর অক্ষমতা কি হতে পারে?’[6]
প্রকৃতপক্ষে পুরুষ বড় কোনো দুর্ঘটনায়ও আত্মসমর্পণ করে না অথচ নারীর এক চাহনিতে জ্ঞান লোপ পায় এবং হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সূচনা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا ‘তোমরা যেনার ধারেকাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কর্ম এবং মন্দ পথ’ (বানী ইসরাঈল, ১৭/৩২)। এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সরাসরি যেনা করতে নিষেধ না করে যেসব উপকরণ মানুষকে ব্যভিচার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, সেসব থেকে নিষেধ করে ব্যভিচারের সব চোরাগুপ্ত দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। কেননা কোনো ব্যক্তি প্রথম ধাপে সরাসরি ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। বরং এর সূচনা হয় চাহনি, হাসি, মোহনীয় কথা ইত্যাদির মাধ্যমে। হারাম দৃষ্টিপাতের যে বিপত্তি সৃষ্টি হয়, তার বিভিন্ন পর্যায় বর্ণনা করে কবি বলেছেন,
نَظرَةٌ فَابتِسامَةٌ فَسَلامٌ فَكَلامٌ فَمَوعِدٌ فَلِقاءُ
‘প্রথমে দৃষ্টি, তারপর মুচকি হাসি, তারপর সালাম, তারপর বাক্যালাপ, তারপর ওয়াদা, তারপর মিলন’।[7]
সুতরাং হে জ্ঞানী ব্যক্তি! স্বীয় নফসকে প্রশান্ত করুন। কেননা মুহূর্তের ধৈর্যধারণই প্রকৃত বীরত্ব। আর প্রকৃত মহাবীর সেই ব্যক্তি, যে নিজেকে সংবরণ করতে পারে।
দৃষ্টিকে অবনমিত রাখার উপকারিতা:
দৃষ্টিকে অবনমিত করার অনেক উপকারিতা রয়েছে—
প্রথমত, অনুতাপের যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়: কেননা যে ব্যক্তি যত্রতত্র দৃষ্টিপাত করে, তার আফসোস ও আত্মদংশন বাড়তেই থাকে। কেননা দৃষ্টি আপনাকে এমন জিনিস দেখাবে, যার প্রতি আপনার আকর্ষণ ও আগ্রহ বাড়াতেই থাকবে। কিন্তু আপনি সেই চাহিদা না নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, আর না পছন্দের বিষয়টা নাগালে পাবেন। আর এটা নিশ্চয়ই চূড়ান্ত রকম পীড়াদায়ক! আছমাঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তাওয়াফের মধ্যে এক বাঁদিকে দেখলাম বন্য গাভীর মতোই হৃষ্টপুষ্ট। আমি বারবার তার দিকে তাকাচ্ছিলাম, আর তার সৌন্দর্য দুচোখ ভরে দেখছিলাম। বাঁদিটি আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হে অমুক, আপনার কী হয়েছে?’ বললাম, ‘তাকালে তোমার সমস্যা কী?’ সে বলতে শুরু করল, ‘যখন তুমি তোমার দৃষ্টিকে আত্মনিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে ছেড়ে দিবে, একদিন অবলোকনকৃত দৃশ্যসমূহ তোমাকে ক্লান্ত করে তুলবে! তুমি যা দেখেছ, না তুমি তার সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান আর না তুমি তার কিছু বিষয় থেকে নিজেকে সংবরণ করতে পারবে!’[8]
লাগামহীন দৃষ্টি আত্মাকে ঠিক সেভাবে ছেদন করে, যেভাবে তির শিকারকে বধ করে। কখনো যদি তা আত্মাকে পুরোপুরি বধ নাও করে, তবু কিছুটা ক্ষত তো অবশ্যই তৈরি করে। কেননা অন্যায় দৃষ্টিপাত শুকনো ঘাসে আগুনের ফুলকি ছোড়ার মতো। তা সম্পূর্ণ ঘাসের স্তূপকে ভস্ম না করতে পারলেও কিয়দাংশ তো অবশ্যই জ্বালিয়ে দেয়। বস্তুত অন্যায় দৃষ্টিপাত বিষাক্ত তিরের মতো। প্রতিবার দৃষ্টিপাতের মধ্য দিয়ে মানুষ অবচেতনভাবে সেই বিষাক্ত তির দ্বারা তার চিন্তা-চেতনা ও অন্তরাত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে।
দ্বিতীয়ত, লজ্জাস্থানের হেফাযত: দৃষ্টিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়ার ফলে অন্তরে কামনার উৎপত্তি ঘটে। তখনই হালাল-হারামের গণ্ডি ভেদ করে দৃষ্টিপাত করে অপাত্রে এবং জড়িয়ে পড়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়ে, যা ব্যক্তিকে পরকালের ভাবনা থেকে গাফেল রাখে। ক্রমেই বেড়ে চলে হতাশা আর দুশ্চিন্তা। সাথে লজ্জাস্থানের হেফাযত না করতে পারার নিঃশব্দ হাহাকার। এসব হতাশা, দুশ্চিন্তা আর হাহাকার নিরসনের প্রয়াসে দয়াময় প্রভু নারী-পুরুষ উভয়কে বলেন, قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ - وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ ‘(হে মুহাম্মাদ) মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয় তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে’ (আন-নূর, ২৪/৩০-৩১)।
তৃতীয়ত, ঈমান বৃদ্ধি এবং ইবাদতে তৃপ্তি অনুভব: যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে স্বীয় দৃষ্টির হেফাযত করবে, আল্লাহ তাকে দৃঢ় ঈমান দান করবেন। মূলত দৃষ্টিকে অবনমিত রাখার দরুন ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা যায়। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমাবলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রথম দৃষ্টি ভুলবশত। দ্বিতীয় দৃষ্টি ইচ্ছাকৃত। আর তৃতীয় দৃষ্টি ধ্বংস সাধন করে। একজন মুমিন ব্যক্তির কোনো নারীর সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টিদান শয়তানের তিরসমূহ থেকে একটি বিষমিশ্রিত তির। যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে এবং আল্লাহর কাছে যে পুরস্কার রয়েছে, তা প্রাপ্তির আশায় হারাম দৃষ্টিপাত পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে প্রতিদান হিসেবে এমন ইবাদত দান করবেন, যার স্বাদ তার কাছে পৌঁছবে’।[9]
প্রতিকার:
একজন পুরুষের মাঝে যেমন নারীর প্রতি আকর্ষণ থাকে, অনুরূপ একজন নারীরও পুরুষের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ থাকে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি এই আকর্ষণ স্বাভাবিক বিষয়। তবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে স্বাদ গ্রহণ ও কামনা-বাসনা করাটা হলো অন্যায়। বারবার দেখতে থাকাটাও দূষণীয়। তাই একজন নারী যেমন চলার পথে নিজের শালীনতা বজায় রাখবে, তেমনি একজন পুরুষও নিজের দৃষ্টিকে সর্বাত্মক হেফাযত করার চেষ্টা করবে। নযর হেফাযত করা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য আবশ্যক। পর্দা সকলের জন্য প্রযোজ্য। কুদৃষ্টির গুনাহ সকলের জন্য ক্ষতিকর। একজন পুরুষ যেমন হারাম দৃষ্টিপাত করতে পারে, তেমনই একজন নারীও হারাম দৃষ্টিপাত করতে পারে। কোনো কারণে আকস্মিক দৃষ্টিপাত নিজের মনের মাঝে কামনা-বাসনা সৃষ্টি করলে সত্বর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ইস্তেগফার পাঠ করা বাঞ্ছনীয়।
এক্ষেত্রে যদি বিবাহিত ব্যক্তি হারাম দৃষ্টিপাতে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার অন্যতম একটি বাহ্যিক চিকিৎসা হলো, সে নিজ স্বামী কিংবা স্ত্রীর সাথে বেশি বেশি দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং তার সাথে শারীরিক মেলবন্ধন ঘটাবে। যদিও মনে না চায়, তবুও হালাল পন্থায় মুড তৈরি করার চেষ্টা করবে। কেননা দাম্পত্য সম্পর্ক ও শারীরিক মেলবন্ধন শরীর থেকে উষ্ণ ভাব কমিয়ে দেয়। যদি প্রচণ্ড উষ্ণতা শরীর থেকে কমিয়ে আনা যায়, তাহলে এমন ব্যক্তির মাঝে দুর্বলতা সৃষ্টি হবে। অন্তর ঠাণ্ডা ও স্থির থাকবে। আর এভাবেই হারাম দৃষ্টিপাতের আগুন নিভে যাবে।
জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘একবার হঠাৎ জনৈকা নারীর প্রতি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টি পড়ে, অতঃপর তিনি স্বীয় স্ত্রী যায়নাব রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর নিকট আসলেন। তখন যায়নাব রাযিয়াল্লাহু আনহা চামড়া পাকা করছিলেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনে তারা প্রত্যাগমন করলে, তিনি স্বীয় প্রয়োজন পূরণ (সহবাস) করলেন। অতঃপর তিনি বের হয়ে ছাহাবীদের লক্ষ্য করে বলেন, ‘নারীরা সামনে আসে শয়তান বেশে এবং ফিরে যায় শয়তান বেশে। অতএব তোমাদের কেউ কোনো নারীকে দেখতে পেলে (আকৃষ্ট হলে বা মনের মাঝে চাহিদা তৈরি হলে) সে যেন স্বীয় স্ত্রীর নিকট গমন করে। কারণ এটি তার মনের ভিতর যা আছে, তা দূর করবে’।[10]
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যথাযথভাবে দৃষ্টি হেফাযত করার তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!
শিক্ষার্থী, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ (বালিকা শাখা), ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪৩।
[2]. আব্দুল হামিদ ফাইযী, পাপ তার শাস্তি ও মুক্তির উপায়, পৃ. ১৩৬; তালবীসে ইবলীস, পৃ. ৩১০।
[3]. আবূ নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৫/৯৫।
[4]. আব্দুল হামিদ ফাইযী, পাপ তার শাস্তি ও মুক্তির উপায়, পৃ. ৪০।
[5]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৯৭৪, ২২৯৯১।
[6]. যাদুল মাসির, ২/৬০।
[7]. আব্দুল হামিদ ফাইযী, পাপ তার শাস্তি ও মুক্তির উপায়, পৃ. ৪১।
[8]. রওযাতুল মুহিব্বিন ওয়া নুযহাতুল মুশতাকিন, পৃ. ৯৭।
[9]. আবূ নুআইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৬/১০১।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/৩২৯৮।