আল্লাহ তাআলার এই সৃষ্টিজগতে বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষ সৃষ্টি করে নারীদেরকে পুরুষের অধীন করে দিয়েছেন।
যাহোক, আমি আজ অন্য একটা বিষয় নিয়ে কিছু কথা লিখার চেষ্টা করব, যে বিষয়টা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে।
সমাজে যে কত প্রকার মানুষ আছে, সেটা গণনা করা সম্ভব নয়। কেননা একেক মানুষ একেক রকমের। কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ শ্যামলা, কেউ ভালো, আবার কেউ খারাপ ইত্যাদি। সমাজে ছেলেদের গায়ের রং তথা কালো বা ফরসা ধরা হয় না, তাহলে মেয়েরা কালো হলে কেন তাদের এত কথা শুনতে হয়? কেন তাদের বাবা-মায়েদের অপমানিত হতে হয় সমাজে? সে কি নিজে নিজে কালো হয়েছে? নাকি তার প্রতিপালক অনেক যত্ন করে তাকে এই রং দিয়ে বানিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে একটি করে বিশেষ গুণ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। হ্যাঁ, সবাইকেই একটি করে বিশেষ গুণ দিয়েছেন।
আচ্ছা, এই কালো মেয়েরা কী অপরাধ করেছে, বলুন তো? একটি মেয়েকে একটা ভালো পরিবারে বিয়ে দিতে হলে তার চেহারা সুন্দর হতে হবে, গায়ের রং ফরসা হতে হবে, মোটাও হওয়া যাবে না, আবার চিকনও হওয়া যাবে না, মিডিয়াম থাকতে হবে, খুব বেশি লম্বাও হওয়া যাবে না, আবার খাটোও হওয়া যাবে না, চুল সুন্দর লম্বা হতে হবে, বাবার অঢেল ধনসম্পদ থাকতে হবে; তাহলে সবাই ভালোবাসবে, সমাজের লোকেরা তাকে ভালো বলবে, ভালো চোখে দেখবে, ভালো পরিবারে বিয়ে হবে।
কিন্তু কালো মেয়েরাও ভালো মনের অধিকারী হয়। তাদের আপনারা অবহেলা করবেন না। কারণ তারা তাদের রূপ নিয়ে কখনো অহংকার করে না, তারা মানুষকে কিছু বলার আগে কয়েক বার ভেবে দেখে। কেন জানেন? কারণ তারা কালো বলে সমাজের মানুষের অনেক অপমান, লাঞ্ছনা তাদেরকে সহ্য করতে হয়। তারা জানে এগুলো ভোগ করতে তাদের কতটা কষ্ট সহ্য করতে হয়। কত পরিবার আছে, মেয়েকে দেখতে এসে কালো বলে উঠে চলে যায়। তাদেরকে বলি, আরে! তাদের গায়ের রংটাই শুধু দেখলেন! তাদের অন্য গুণগুলো তো আগে জানার চেষ্টা করুন। নাহ, কোনো কথাই নেই, ওই যে মেয়ে কালো। যখন বারবার দেখতে এসে এভাবে উঠে চলে যায়, তখন বাবা-মায়ের মনটাও এক পর্যায়ে ভেঙে যায়। কতশত পরিবার আছে, এই অপমানগুলো সহ্য করতে না পেরে বাবা তার নিজের মেয়ের সাথে কথা বলতে চায় না। সবার সামনে মেয়ে বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। কী এরকম হয় না? হ্যাঁ, অবশ্যই হয়। এজন্য আজ এগুলো আপনাদের নিকটে তুলে ধরছি। আর মা, মায়ের কথা আর কী বলব? বাবার রোজ নানা ধরনের কথা তাকে শুনতে হয়। আর প্রতিবেশীদের তো কানাঘুষা চলতেই থাকে যে, এবার এসেও কেউ পছন্দ করেনি?
এভাবে দেখা যায় যে, বারবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার কারণে মেয়ের বয়স অনেক বেড়ে যায়। তারপরও মা যেহেতু ওই কালো মেয়েকে গর্ভে ধরেছিলেন, তাই তিনি সবকিছুকে ধৈর্য ধরে মেনে নিতে পারেন। শেষে যদি বিয়েও হয় তাহলে দেখা যায় যে, ছেলে ভালো নয় অথবা ছেলে বেকার অথবা পরিবার ভালো নয় কিংবা অনেক টাকা যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হয়। তারপরও শান্তির কথা এই যে, এখন মা-বাবাকে আর সমাজের মানুষের কাছ থেকে কটু কথা শুনতে হবে না আর এটা ভেবে ওই মেয়েগুলো বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। ওই মেয়েরা তো কিছুই বলতে পারবে না। কারণ তারা যে কালো, এটাই তাদের দোষ। এত অবহেলা, এত কথা শোনার পরে কি তারা সুখী হতে পারে? কী ভাবছেন? না, তারা সুখী নয়। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শ্বশুর-শাশুড়ির খোঁটা দেওয়া কথা শুরু হয়। এমনিতেই কালো বউ, তারপরও বউয়ের বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা দেওয়ার কথা ছিল, সে যৌতুকের টাকাটা তো ওখানেই পড়ে আছে, এরকম নানান কথা শুরু হয়ে যায়।
মেয়েগুলোকে সারাদিন এই কথাগুলো শুনতে হয় কেন? ওই যে কালো তাই। এই কথাগুলো শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে তার স্বামীও বিরক্তির স্বরে বলে, যাও গিয়ে বাপের বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা নিয়ে এসো, না হলে আমি তোমার মতো মেয়েকে ভাত দিতে পারব না, তুমি তো কালো। আরও বলে, তোমাকে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না, আমার মতো মানুষ তোমাকে নিয়ে আর সংসার করতে পারবে না ইত্যাদি। এমন হাজারো অপমানজনক কথা তাকে হজম করতে হয়।
প্রতিদিনের এই হাজারো অপমান একটা সময় তার অসহ্য মনে হয় আর তখনই তার নিজেকে এই জগৎ সংসারে অতি তুচ্ছ কীট মনে হতে থাকে। ঠিক এমনি একটা মুহূর্তে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।
কেন এই অবহেলা তাদের প্রতি? কেন এত অপমান? কিছুই নয়, ওই যে তারা কালো, এটাই তাদের দোষ। তারা যাবে কোথায়? তারা কি মানুষ নয়? আসলে তারা কালো বলে তাদের সুন্দরভাবে সম্মান নিয়ে বাঁচার কোনো অধিকার নেই।
হে আমার ভাই! আমি আপনাদেরকেই বলছি, আপনারা তাদের গুণ দেখে বিয়ে করুন; রূপ দেখে নয়। কারণ এই রূপ একদিন থাকবে না। কিন্তু যখনই কোনো কালো মেয়েকে বিয়ে করতে যাবেন, তখনই মানুষ আপনাকে বারবার সতর্ক করে বলবে, ভুল করো না, মেয়ে কিন্তু কালো, দশটা মানুষের সামনে যাবে, মানুষ কী বলবে! একটু ফরসা হলে ভালো হতো, তখন আপনার মন ভেঙে যাবে। কিন্তু হে আমার ভাই! আপনি মনোবল হারাবেন না। কেননা ধৈর্যের ফল সর্বদা সুমিষ্ট হয়।
তাদের গায়ের রং কালো হতে পারে, তবে সবার চেহারা তো আর খারাপ নয়। আমার দেখা মতে, অধিকাংশ কালো মেয়েদের চেহারা অনেক আকর্ষণীয়। তাদের আচার-আচরণও খুব ভালো লাগে। এটা কিন্তু সত্য যে, ফরসা মেয়েদের চেয়ে কালো বা শ্যামলা মেয়েদের চেহারা যথেষ্ট সুন্দর হয়।
হে আমার মায়েরা! এবার আমি আপনাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপনাদের সকলেরই কি ধবধবে ফরসা মেয়ে আছে? কালো মেয়ে কি নেই আপনাদের? অবশ্যই আছে। আমার দেখা অনেক মায়েরা তাদের ছেলের জন্য ফরসা বউ খোঁজে, অথচ তার নিজের ছেলেই তো কালো। আপনি কি আপনার মেয়ের কথা ভাবেন না? যদি আপনার মেয়েকে দেখতে এসে কালো বলে ওঠে চলে যায়, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? খুব ভালো লাগবে কি? না, লাগবে না। কারণ সে আপনার মেয়ে। ঠিক তেমনি যে মেয়েকে আপনি কালো বলে ওঠে চলে এলেন, সেও তো অন্য এক লোকের মেয়ে। আপনি নিজে একটি মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়েকে কীভাবে এত অপমান করেন? কেন আজ কালো মেয়েদের সমাজে এত নিচু করে দেখা হয়? কেন? কী অপরাধ করেছে তারা? না, তারা কিছুই করেনি, তারা নির্দোষ, তারা নিরুপায়। তাদের একটাই দোষ যে, তাদের গায়ের রং কালো।
অনেক ফরসা মেয়েদের দেখি, তারা কালো মেয়েদের পাশে বসতে চায় না, মিশতে চায় না, কালো মেয়েদের দেখলেই কেন জানি দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে।
হে আমার বোনেরা! কেন এত অহংকার? আপনার এই সুন্দর ফরসা চেহারা কি থাকবে চিরদিন? ধরে নিন, কোনো এক দুর্ঘটনায় আপনার চেহারা নষ্ট হয়ে গেল, তখন কি করবেন আপনি? অন্যদের কিছু বলার আগে সেখানে নিজেকে একবার বসিয়ে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন সবকিছু।
যাহোক, অনেকে মেয়ে দেখতে গিয়ে বলে, মেয়ে তো কিছু মেখে ফরসা হয়নি? যে সময় এসেছে, বলা তো যায় না। ওসব ক্রিম-ট্রিম মেখে ফরসা হওয়া মেয়ে কিন্তু নেওয়া যাবে না। দুদিন পর আবার যেই ছিল, সেই হবে। কেন এ কথা বলেন আপনারা? আমি তো বলব, দোষটা আপনাদের। আজ আপনাদের মতো মানুষদের কথা থেকে বাঁচার জন্য ওই কালো মেয়েদের এই পথটা বেছে নিতে হয়েছে, শুধু আপনাদের জন্য। কতশত মেয়েদের চোখের পানি ঝরে, তার মূল্য কি দিতে পারবেন আপনারা? মনে রাখবেন! সাদা কিছুতে দাগ লাগে তাড়াতাড়ি, তা বুঝাও যায় খুব দ্রুত; কিন্তু কালোতে দাগ লাগলেও তা সহজে বুঝা যায় না।
সমাজে ওই মেয়েদের কিছু বলার থাকে না। কী বলবে তারা? পদে পদে শুধু অপমান শুধু তারা কালো বলে। তাদের দোষটাই হলো এটা। আপনারা কি জানেন, আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন মাটি নিয়ে বিভিন্ন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন? তাই কেউ কালো, কেউ ফরসা, কেউ শ্যামলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে কারা কালো, ফরসা বা শ্যামলা সেটা দেখবেন না; বরং তিনি দেখবেন তার অন্তর ও তাক্বওয়া। একবার ভেবে দেখুন তো! আল্লাহ তাদেরকে নিজে সৃষ্টি করার পরেও তাদের মধ্যে কারা কালো, কারা ফরসা তা বাছাই করলেন না। অথচ আপনারা তাঁরই বান্দা হয়ে কালো-ফরসা বাছাই করেন। আপনারা যদি এই রকম বর্ণবৈষম্য করে থাকেন, তবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
পরিশেষে আমি সেসব মেয়েদের বলবো, যাদের মহান আল্লাহ গায়ের রং কালো দিয়েছেন— আপনারা মানুষের এসব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় প্রভাবিত হয়ে মন খারাপ করে জীবনকে বিষিয়ে তুলবেন না বা নিজেকে তুচ্ছ বা বোঝা জ্ঞান করবেন না; বরং এটাকে মহান আল্লাহ প্রদত্ত পরীক্ষা বিবেচনা করে ধৈর্য ধারণ করুন, আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান আশা করুন, নিজেকে ইলম ও আমলে সুসজ্জিত করুন। মনে রাখবেন, আল্লাহর কাছে গায়ের রং কোনো সম্মান বা মর্যাদার মাপকাঠি নয়; বরং তাক্বওয়াই হলো তাঁর কাছে সম্মানের মাপকাঠি।[1] কাজেই জীবনের প্রতিটি ঘটনাপ্রবাহে আল্লাহর উপর আস্থা রাখুন, তাঁর কাছেই সব কিছু শেয়ার করুন এবং তাঁর কাছেই নিজের দুর্বলতার অভিযোগ করুন এবং সাহায্য চান। মনে রাখবেন, মানুষের কাছে বর্ণ বিচারে মর্যাদা বা অমর্যাদা হতে পারে; আল্লাহর কাছে নয়। তিনি বলেছেন, ‘আর যে আল্লাহকে ভয় করে চলবে, তিনি তার জন্য (সমস্ত কঠিন অবস্থা থেকে উত্তরণের) পথ সৃষ্টি করবেন’ (আত-তালাক, ৬৫/২)। মহান আল্লাহ এখানে জীবনের নানান জটিলতা থেকে উত্তরণের পথ তৈরি করার জন্য কোনো বর্ণের শর্ত করেননি; করেছেন তাকে নিরষ্কুষভাবে ভয় করার কথা। তিনি আরও বলেছেন, ‘আর যে আল্লাহর প্রতি ভরসা করে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট’ (আত-তালাক, ৬৫/৩)। কাজেই জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, নিজেকে শুদ্ধ রাখুন, আমল দুরস্ত করুন আর আল্লাহর উপর সর্বাবস্থায় ভরসা রাখুন। নিশ্চয়ই তিনি সৎকর্মশীল বান্দার কর্মফল বিনষ্ট করবেন না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন- আমীন!
মোছা. সুমাইয়া শোভা
শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ (বালিকা শাখা), ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. দ্রষ্টব্য: সূরা আল-হুজুরাত, ৪৯/১৩।