উত্তর: ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীছের কোনো রাবীকে কাযযাব বা মিথ্যুক বললে মূলত তা সংশ্লিষ্ট হাদীছের রাবীসহ ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর মতো একজন সম্মানিত মুহাদ্দিছকে অপমান করা হবে। কেননা তিনি প্রত্যেকটি হাদীছের সনদ, মতন, রাবী ইত্যাদির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আল্লাহর তরফ থেকে নিশ্চয়তা লাভ করার পরে সেটাকে তার কিতাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ মর্মে তিনি বলেন, আমি আমার এই কিতাব মসজিদুল হারামে বসে সংকলন করেছি এবং আমি সেখানে কোনো হাদীছ প্রবেশ করাইনি যতক্ষণ না আমি ইস্তিখারার দু’রাকআত নফল ছালাত আদায় করেছি এবং হাদীছটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করেছি (ফাতহুল বারীর ‘ভূমিকা’ খণ্ড, কায়রো : দারুর রাইয়ান ২য় সংস্করণ ১৪০৭/১৯৮৭, পৃ. ৫১৩-১৪)। তবে প্রথম যুগের বেশ কিছু মুহাদ্দিছ ছহীহ বুখারীর কতিপয় হাদীছ সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বাধিক ইমাম দারাকুত্বনী (৩০৬-৩৮৫ হি.) ছহীহ বুখারীর ৭৮টি এবং বুখারী ও মুসলিমের মিলিতভাবে ৩২টি হাদীছের উপর সমালোচনা করেছেন। এসব সমালোচনার উত্তরে বিভিন্ন গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয়েছে। ছহীহ বুখারীর ভাষ্যকারগণের প্রত্যেকেই সংক্ষেপে বা বিস্তারিতভাবে এসব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। তবে সর্বশেষ ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হি.) ফাতহুল বারীর ভূমিকা ‘হাদীয়ুস সারী’-তে এসব সমালোচনার একটি একটি করে বিস্তারিতভাবে জবাব দিয়েছেন (হাদীয়ুস সারী মুক্বাদ্দামা ফাতহুল বারী, ৮ম অনুচ্ছেদ, পৃ. ৩৬৪-৪০২)।
আলোচনার শেষে উপসংহারে তিনি বলেন, সমালোচিত প্রত্যেকটি হাদীছই দোষযুক্ত নয়। বরং অধিকাংশের জওয়াব পরিষ্কার ও দোষমুক্ত। কোনো কোনোটির জওয়াব গ্রহণযোগ্য এবং খুবই সামান্য কিছু রয়েছে, যা না বুঝে তাঁর উপর চাপানো হয়েছে। আমি প্রত্যেকটি হাদীছের শেষে এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করেছি’ (মুক্বাদ্দামা, পৃ. ৪০২)।
তিরমিযীর ভাষ্যকার শায়খ আহমাদ মুহাম্মাদ শাকের বলেন, ‘ছহীহ বুখারীর যেসব হাদীছ সমালোচিত হয়েছে তার অর্থ হলো সেগুলো ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেনি। তবে হাদীছটি স্বীয় অবস্থানে ছহীহ। তিনি বলেন, মুহাক্কিক্ব ওলামায়ে হাদীছ-এর নিকটে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ছহীহ বুখারী ও মুসলিমের প্রতিটি হাদীছই ছহীহ। এ দু’টি গ্রন্থের কোনো একটি হাদীছ দুর্বলতা বা ত্রুটিযুক্ত নয়। ইমাম দারাকুত্বনীসহ মুহাদ্দিছগণের কেউ কেউ যে সমালোচনা করেছেন তার অর্থ হলো তাঁদের নিকট সমালোচিত হাদীছসমূহ ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধতার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারেনি। তবে সাধারণভাবে হাদীছগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়ে কেউই মতভেদ করেননি (আল-বা‘এছুল হাছীছ, তাহক্বীক্ব : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকের, পৃ. ৩৩-৩৪)।
শায়খ আলবানী রহিমাহুল্লাহও উছূলে হাদীছের আলোকে ছহীহ বুখারীর ১৫টি হাদীছের সমালোচনা করেছেন তাঁর ‘সিলসিলা যঈফা’ গ্রন্থে। উক্ত সমালোচনা হাদীছবিরোধী বা হাদীছে সন্দেহবাদীদের মতো নয়, বরং একজন সূক্ষ্মদর্শী মুহাদ্দিছ বিদ্বান হিসাবে। যেমন ইতোপূর্বে অনেক মুহাদ্দিছ করেছেন। যদি এতে তিনি ভুল করে থাকেন তাহলেও নেকী পাবেন। আর ঠিক করে থাকলে দ্বিগুণ নেকী পাবেন। তবে তিনি যেসব হাদীছকে যঈফ বলেছেন, সে ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। কেননা দুর্বল রাবীদের বর্ণনা গ্রহণ করার ব্যাপারে তাঁর কতগুলো স্পষ্ট নীতি ছিল। যেমন : (১) দুর্বল রাবীদের সকল বর্ণনাই দুর্বল নয়। (২) উক্ত বিষয়ে অন্য কোনো হাদীছ না পাওয়া এবং হাদীছটি বিধানগত ও আক্বীদা বিষয়ক না হওয়া। বরং হৃদয় গলানো ও ফযীলত বিষয়ে হওয়া। (৩) সনদে বা মতনের কোনো ত্রুটি দূর করার জন্য বা কোনো বক্তব্যের অধিক ব্যাখ্যা দানের জন্য কিংবা শ্রুত বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য সহযোগী হিসাবে (من المتابعات) কোনো হাদীছ আনা’ (ড. মুহাম্মাদ হামদী আবু আবদাহ, জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীআ অনুষদ কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনে পেশকৃত গবেষণাপত্র, পৃ. ৩৪)।
আলবানী ও দারাকুত্বনী রহিমাহুমুল্লাহ বুখারী গ্রন্থের যে সকল হাদীছের উপর মন্তব্য করেছেন তা ঠিক নয় জানতে দেখুন- (মিন্নাতুল বারী, আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক, পৃ. ১৮২-২৩১) অতএব, ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীছের কোনো রাবীকে কাযযাব বা মিথ্যুক বলা মূলত তার প্রতি মিথ্যারোপ করা, যা যুলুমের অন্তর্ভুক্ত মহাপাপ এবং তা স্পষ্ট হারাম। আবূ হুরায়রা রযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের (দ্বীনী) ভাই। মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমের উপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্থ করবে না এবং অবজ্ঞা করবে না। আল্লাহভীতি এখানে! এ কথা বলে তিনি ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বক্ষের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করে বললেন, ‘একজন মানুষের জন্য এতটুকু অন্যায়ই যথেষ্ট যে, সে নিজের মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করবে। মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান হারাম (ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৬৪; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৯৫৮; মিশকাত, হা/৪৯৫৯)।
প্রশ্নকারী : চঞ্চল চৌধুরী
নারায়ণগঞ্জ সদর।