ভূমিকা:
মানবজীবনে জ্ঞানার্জন একটি অপরিহার্য বিষয়। আত্মিক পরিশুদ্ধি, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার মাধ্যম হলো প্রকৃত জ্ঞান। তবে বস্তুগত উপকারী জ্ঞানকেও ইসলাম গুরুত্ব দেয়। কুরআন মাজীদ ও হাদীছে জ্ঞানচর্চার গুরুত্বের ব্যাপারে বহুবার আলোকপাত করা হয়েছে এবং জ্ঞানচর্চাকে ‘ইবাদত’ ও ফরয হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কুরআন কারীমের আলোকে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব:
আল-কুরআনুল কারীমে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা জ্ঞানার্জনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। তন্মধ্যে কিছু আয়াত হলো—
১. আল্লাহ তাআলা বলেন, اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَق‘পড়ুন! আপনার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আল-আলাক্ব, ৯৬/১)।
২. আল্লাহ তাআলা বলেন, وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا ‘আর বলুন, হে আমার রব! আপনি আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন’ (ত্ব-হা, ২০/১১৪)।
৩. আল্লাহ তাআলা বলেন,فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُون ‘অতঃপর তোমরা যদি না জানো, তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো’ (আন-নাহল, ১৬/৪৩)।
৪. আল্লাহ তাআলা বলেন,يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَات ‘আল্লাহ তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা বহুগুণ উন্নীত করবেন’ (আল-মুজাদালা, ৫৮/১১)।
৫. আল্লাহ তাআলা বলেন,قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُون ‘আপনি বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে?’ (আয-যুমার, ৩৯/৯)।
৬. তিনি আরও বলেন, وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْم ‘আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার পিছে পড়ো না’ (বনী ইসরাঈল, ১৭/৩৬)।
৭. আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন,فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُون ‘আল্লাহকে স্মরণ করো যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন এমন বিষয়, যা তোমরা জানতে না’ (আল-বাক্বারা, ২/২৩৯)।
৮. আল্লাহ তাআলা বলেন,يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا ‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত (জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) দান করেন। আর যাকে হিকমত দান করা হয়েছে, অবশ্যই তাকে প্রভূত কল্যাণ প্রদান করা হয়েছে’ (আল-বাক্বারা, ২/২৬৯)।
৯. আল্লাহ তাআলা বলেন,كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُون ‘যেমনিভাবে আমি তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যিনি তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তোমাদের পরিশুদ্ধ করেন, কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন এবং এমন বিষয় শিক্ষা দেন, যা তোমরা জানতে না’ (আল-বাক্বারা, ২/১৫১)।
হাদীছের আলোকে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসংখ্য হাদীছে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। কিছু হাদীছ নিচে তুলে ধরা হলো—
১. ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّين ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের গভীর জ্ঞান দান করেন’।[1]
২. রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,النَّاسُ مَعَادِنُ كَمَعَادِنِ الذَّهَبِ وَالفِضَّةِ، خِيَارُهُمْ فِي الجَاهِلِيَّةِ خِيَارُهُمْ فِي الإسْلَامِ إِذَا فَقُهُوا ‘মানুষ সোনা-রূপার খনির মতো। যারা জাহেলী যুগে (ইসলাম গ্রহণের পূর্বে) উত্তম, তারা ইসলাম গ্রহণের পরও উত্তম বিবেচিত হবে- যখন তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে’।[2]
আল্লাহ তাআলা বলেছেন,وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا ‘কোনো জাতির প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে ইনছাফ না করতে প্ররোচিত না করে’ (আল-মায়েদা, ৫/৮)।
৩. জ্ঞানের মর্যাদা ইবাদতের চাইতেও বেশি। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ قَالَ ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلاَنِ أَحَدُهُمَا عَابِدٌ وَالآخَرُ عَالِمٌ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ اللَّهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسِ الْخَيْرَ.
আবূ উমামা আল-বাহেলী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, দুজন লোকের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আলোচনা করা হলো। তাদের একজন আবেদ (অধিক পরিমাণ ইবাদতকারী) এবং অন্যজন আলেম। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের নিম্ন পর্যায়ের ব্যক্তির উপর আমার যতখানি মর্যাদা, ঠিক তেমনি একজন আলেমের মর্যাদা একজন আবিদের উপর’। তারপর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রহমত করেন, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং আসমান-যমীনের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া এবং পানির মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দু‘আ করে, যে মানুষকে কল্যাণকর জ্ঞান শিক্ষা দেয়’।[3]
৪. আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِم ‘জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির উপর ফরয’।[4]
৫. উছমান ইবনে আফফান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ القُرْآنَ وَعَلَّمَه ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো সেই ব্যক্তি, যে কুরআন শিখে এবং (অন্যকে) তা শেখায়’।[5]
৭. আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّة ‘যে জ্ঞান অন্বেষণ করার জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’।[6]
রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণঘটনা:
১. মসজিদে নববীর দুই দল (যিকির ও জ্ঞানচর্চা): রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মসজিদে এসে দেখলেন, একদল লোক যিকির করছেন, আরেক দল জ্ঞান অর্জন করছেন এবং শিক্ষা দিচ্ছেন। তিনি বললেন,
كِلا الطَّائِفَتَيْنِ عَلَى خَيْرٍ، وَهَؤُلاءِ يَدْعُونَ اللهَ، وَهَؤُلاءِ يَتَعَلَّمُونَ وَيُعَلِّمُونَ، وَإِنَّمَا بُعِثْتُ مُعَلِّمًا» فَجَلَسَ مَعَ الْمُعَلِّمِين.
‘উভয় দলই কল্যাণের উপর রয়েছে। এরা আল্লাহকে ডাকছে আর ওরা শিখছে ও শিক্ষা দিচ্ছে। নিশ্চয়ই আমাকে একজন শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে’। অতঃপর তিনি জ্ঞানচর্চাকারীদের সঙ্গে বসে পড়লেন।[7]
২. বদরের যুদ্ধ ও শিক্ষিত বন্দিদের মুক্তি: বদরের যুদ্ধে মুসলিমরা ৭০ জন কুরাইশ কাফেরকে বন্দি করে। তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম শিশুকে লেখাপড়া শেখানোকে বন্দিদের মুক্তিপণ হিসেবে গণ্য করেন’।[8] এ ছিল শিক্ষাভিত্তিক মানবিক বিপ্লবের বাস্তব উদাহরণ।
শেষ কথা:
জ্ঞানই হলো মানবজাতির মূল ভিত্তি। জ্ঞান ছাড়া মানুষ অন্ধকারে, কুসংস্কারে এবং পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। কেবল ধর্মীয় বা আখেরাতের কল্যাণ নয়; বরং দুনিয়ার উন্নতির অন্যতম একটি উপায়ও হলো সঠিক শিক্ষা। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র ২৩ বছরে একটি অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতিকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিলেন শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে।
আজ মুসলিম উম্মাহ আবারও সেই অন্ধকারে ফিরে যাচ্ছে, কারণ তারা জ্ঞানের চর্চা ছেড়ে দিয়েছে। তাই আবারও সেই হারানো গৌরব ফিরে পেতে আমাদেরকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে জ্ঞানচর্চাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আসুন! আমরা কুরআন-হাদীছের আলোকে জ্ঞানার্জনে নিজেদেরকে উৎসর্গ করি এবং আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলি আলোকিত মানুষ হিসেবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!
আব্দুল মোমিন তাজেমুল হক
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭১; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৩৭।
[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫২৬।
[3]. তিরমিযী, হা/২৬৮৫।
[4]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৪, ইমাম আলবানী ছহীহ বলেছেন।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০২৭।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৬৯৯।
[7]. ইবনু মাজাহ, হা/২২৯, আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন; সিলসিলা ছহীহা, ৪৪৭।
[8]. মুসনাদ আহমাদ, ৪/৯২, হাসান।