اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ وَحْدَهُ وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلٰى مَنْ لَّا نَبِيَّ بَعْدَهُ
করোনা ভাইরাসের মাধ্যমে এই শতাব্দীর বড় বড় পরিবর্তনগুলো শুরু হয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয়, সিরিয়াতে বাশার আল-আসাদের পতন, বাংলাদেশে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদের অবসান ও হামাস-ইসরাঈল যুদ্ধে গত কয়েকবছর থেকে সমগ্র পৃথিবীর রাজনীতি অস্থির। যে সমস্ত দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কথা নয়; তারাও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে। যেমন- পাকিস্তান-আফগানিস্তান যুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ, সুদানে গৃহযুদ্ধ, মালিতে গৃহযুদ্ধ। তন্মধ্যে গত কয়েক মাসে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সুদান ও ভারত উপমহাদেশের যুদ্ধ। বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পতন ও আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। একসময় যেখানে বাংলাদেশ ভারতের বলয়ে ছিল, বর্তমানে সেটি নেই। অর্ন্তবর্তী সরকারের সময়ে পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা লক্ষণীয়। ফলত পাক-বাংলা সম্পর্কে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে জাহাজ পরিচালনা, ভিসানীতি শিথিল করা, সেনাবাহিনীর মধ্যে আন্তঃসহযোগিতা ও যৌথ মহড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিষয়গুলো ভারত ভালোভাবে গ্রহণ করছে না। ভারতের অস্থিরতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে— ডা. যাকির নায়েক হাফিযাহুল্লাহ-এর বাংলাদেশে সম্ভাব্য সফর ও আল্লামা ইবতিসাম ইলাহী যহীর হাফিযাহুল্লাহ-এর সদ্য সমাপ্ত হওয়া বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে ভারত সরকার ও ভারতীয় মিডিয়ার বিভিন্ন মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে। সমগ্র বিশ্ব জানে, ডা. যাকির নায়েক বা আল্লামা ইবতিসাম ইলাহী যহীর হাফিযাহুমাল্লাহ কেউ-ই কোনো সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীর সাথে ন্যূনতম সম্পৃক্ত নয়। তাদের সকল কাজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও জনগণের সামনে উন্মুক্ত। অথচ তাদের বাংলাদেশ সফর বিষয়ে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয়।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অস্থিরতা থাকলেও অন্যদিকে আফগানিস্তান নিয়ে তারা স্বস্তিতে রয়েছে। দারুল উলূম দেওবান্দকে কাজে লাগিয়ে তালেবান সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মতো। আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমীর খান মুত্তাকীর ভারত ও দেওবান্দ সফর দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অন্যতম একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ভারতের সাথে তালেবান সরকারের এই দহরম-মহরমের মূল কারণ পাকিস্তানের সাথে তালেবানের বৈরিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন-বিরোধী যুদ্ধে তালেবানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আমেরিকা-বিরোধী যুদ্ধেও পাকিস্তান তালেবানদের বিভিন্ন গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে মর্মে বিশ্লেষক মহলের ধারণা। ইমরান খানের সময়ে নব্যগঠিত তালেবান সরকারের সাথে পাকিস্তানের সবচেয়ে সুসম্পর্ক ছিল। সেই সুসম্পর্ক থেকে বর্তমান পাক-আফগান যুদ্ধ খুবই আশ্চর্য একটি ঘটনা। পাকিস্তানের খায়বার পাখতুনখোয়া প্রদেশের পাঠান ও আফগানিস্তানের পাঠান একই ভাষা ও একই সংস্কৃতির জাতি। অথচ তারা বর্তমানে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে, যা খুবই হৃদয়বিদারক। পাকিস্তানের অভিযোগ তাহরীকে তালেবান পাকিস্তানকে আফগান সরকার আশ্রয় দিয়েছে। আফগান সরকারের সহায়তায় টিটিপি পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে আফগান সরকারের দাবি, পাকিস্তান মূলত আমেরিকার ইশারায় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আফগানিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে কোনো দেশে হামলা তারা অনুমোদন করে না—মর্মে তারা বারবার বিবৃতি দিয়েছে। এভাবে পালটাপালটি অভিযোগ ও যুদ্ধের মধ্যে তুরস্ক ও কাতারের সহায়তায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি হলেও তা এখনো স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। যেকোনো সময় পাক-আফগান ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হতে পারে, যা মুসলিম বিশ্বের জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে সুদানেও মুসলিমদের দুটি গ্রুপ পরস্পরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। উমার আল-বশীরের দীর্ঘ ৩০ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে জনগণ ও সেনাবাহিনী সম্মিলিত বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহের পর ক্ষমতার ভারসাম্য ও ভাগাভাগি নিয়ে সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিরোধ চলতে থাকে। কয়েকবার শাসক পরিবর্তিত হয়। ধীরে ধীরে পূর্ণ সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে সামরিক নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। চলমান গৃহযুদ্ধ মূলত দুই সামরিক নেতার ব্যক্তিস্বার্থের দ্বন্দ্ব।
এক দিকে সুদানের মূল সেনাবাহিনী Sudanese Armed Forces (SAF) ও তার নেতা বুরহান। আরেকদিকে প্যারামিলিটারি Rapid Support Forces (RSF) ও তার নেতা হেমদেতি। আর চলমান গৃহযুদ্ধের মূল নিয়ামক হচ্ছে সুদানের সোনার খনি ও স্বর্ণ বাণিজ্য। যে বাণিজ্যের সাথে দুবাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে। অর্থ ও স্বার্থের এই দ্বন্দ্বে বলি হচ্ছে নিরীহ সাধারণ মুসলিমের প্রাণ।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই— ব্যক্তি ও অর্থের স্বার্থের কারণেই মুসলিম উম্মাহকে এভাবে বিভিন্ন জাতি, দেশ ও এলাকায় ভাগ করে রাখা হয়েছে। ততদিন পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যতদিন না সাদা-কালো, জাতপাত, রং-বর্ণ, গোত্র-জাতি ও ভাষার ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে এক মুসলিম উম্মাহ, এক মুসলিম জাতি গঠিত না হয়েছে। মহান আল্লাহ সকল মুসলিম দেশকে জাতীয়তাবাদের মূর্তি ভেঙে দিয়ে এক মুসলিম দেহে পরিণত করে দিন- আমীন! (প্র. স.)
