কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ছালাত শেষে আল্লাহু আকবার বলতে হবে, না-কি আসতাগফিরুল্লাহ?

post title will place here

ফরয ছালাত শেষে ‘আল্লাহু আকবার’ বলতে হবে, না-কি ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলতে হবে? একদল আলেম ‘আল্লাহু আকবার’ বলাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নাকচ করেছেন এবং আমলটিকে ভারতবর্ষের সাথে যেন খাছ করে দিয়েছেন। আমরা বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে কুরআন, হাদীছ ও সালাফ-ইমামদের বক্তব্যের আলোকে দেখার চেষ্টা করব, আল্লাহু আকবার বলা যাবে কি-না এবং কোনটি বেশি শক্তিশালী মত।

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আমল:

বিখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,كُنْتُ أَعْرِفُ انْقِضَاءَ صَلاَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالتَّكْبِيرِ ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছালাতের শেষ জানতে পারতাম ‘আল্লাহু আকবার’-এর মাধ্যমে’।[1]

রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বীকৃতি:

বিখ্যাত ছাহাবী ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,«أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ بِالتَّكْبِيرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنَ الْمَكْتُوبَةِ كَانَ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ » وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: كُنْتُ أَعْلَمُ إِذَا انْصَرَفُوا بِذَلِكَ إِذَا سَمِعْتُهُ. ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মানুষেরা যখন ফরয ছালাত শেষে ফিরতেন, তখন জোরে আল্লাহু আকবার বলা হতো’। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘আমি তাদের আওয়াজ শুনে জানতে পারতাম যে, তারা ছালাত শেষে ফিরেছেন’।[2]

ছাহাবীদের আমল:

(ক) বিখ্যাত ছাহাবী ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মানুষেরা যখন ফরয ছালাত শেষে ফিরতেন, তখন জোরে আল্লাহু আকবার বলা হতো’। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘আমি তাদের আওয়াজ শুনে জানতে পারতাম যে, তারা ছালাত শেষে ফিরেছেন’।[3]

(খ) তাবেঈ আমর ইবনু দীনার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, إِنَّ النَّاسَ كَانُوا إِذَا سَلَّمَ الإِمَامُ مِنْ صَلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ كَبَّرُوا ثَلاثَ تَكْبِيرَاتٍ ‘যখন ইমাম ফরয ছালাতে সালাম ফেরাতেন, তখন মানুষেরা তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন’।[4]

(গ) ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু সালাম শেষে তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন।[5]

তাবেঈদের আমল:

(ক) বিখ্যাত ছাহাবী ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর সন্তান আলী রাহিমাহুল্লাহ ছালাত শেষে তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন।[6]

(খ) বিখ্যাত তাবেঈ উমার ইবনু আব্দিল আযীয ছালাত শেষে তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন।[7]

ইমামদের বক্তব্য:

আমরা জানি মুহাদ্দিছগণ তাদের মতামত পেশ করে থাকেন হাদীছগ্রন্থের শিরোনামের মাধ্যমে। আমরা এখন এমন কিছু মুহাদ্দিছের নাম উল্লেখ করব, যারা ছালাত শেষে আল্লাহু আকবার বলার ব্যাপারে শিরোনাম রচনা করেছেন।

১. ইমাম আবূ দাঊদ রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম রচনা করেছেন, بَابُ التَّکْبِیْرِ بَعْدَ الصَّلَاۃِ তথা- ‘ছালাত শেষে আল্লাহু আকবার বলার অনুচ্ছেদ’।

২. ইমাম নাসাঈ রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম দিয়েছেন,التَکْبِیْرُ بَعْدَ تَسْلِیْمِ الِّإمَامِ তথা- ‘ইমামের সালাম ফেরানোর পর আল্লাহু আকবার বলা’।

৩. ইমাম ইবনু খুযায়মা রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম রচনা করেছেন, بَابُ رَفْعِ الصَّوْتِ بِالتَّكْبِيرِ وَالذِّكْرِ عِنْدَ قَضَاءِ الْإِمَامِ الصَّلَاةَ তথা- ‘ইমামের ছালাত শেষ করার পর উঁচু আওয়াজে আল্লাহু আকবার বলা এবং যিকির করা’।

৪. ইমাম আবূ আওয়ানাহ রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম দিয়েছেন,ذِكْرِ الْأَخْبَارِ الَّتِي تُبَيِّنُ قَوْلَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى عَقِبِ تَسْلِيمِهِ مِنَ التَّشَهُّدِ وَإِعْلَامِهِ مَنْ خَلْفَهُ انْقِضَاءَ صَلَاتِهِ مِمَّنْ يَخْفَى عَلَيْهِ فَرَاغُهُ مِنَ الصَّلَاةِ بِالتَّكْبِيرِ، وَقَدْرِ قُعُودِهِ بَعْدَ التَّسْلِيمِ فِي مَكَانِهِ তথা- ‘সেসব হাদীছ উল্লেখকরণ, যেসব হাদীছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশাহহুদ থেকে সালাম ফেরানোর পরপর যা বলতেন, তাঁর সালাম ফেরানো যাদের কাছে গোপন থাকত তাদেরকে আল্লাহু আকবার বলার মাধ্যমে অবহিত করতেন এবং সালাম ফেরানোর পর নিজ স্থানে যতক্ষণ বসে থাকতেন’।

৫. ইমাম ইবনু হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম রচনা করেন, ذِكْرُ إِبَاحَةِ تَكْبِيرِ الْمَأْمُومِينَ عِنْدَ فَرَاغِ الْإِمَامِ مِنَ الصَّلَاةِ তথা- ‘ইমাম ছালাত শেষ করলে মুক্তাদীদের আল্লাহু আকবার বলার বৈধতা শীর্ষক আলোচনা’।

৬. ইমাম আবূ নুয়াইম রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম নিয়ে আসেন, بَابُ رَفْعِ الصَّوْتِ بِالتَّكْبِيرِ بَعْدَ التَّسْلِيمِ তথা- ‘সালাম ফেরানোর পর উঁচু আওয়াজে আল্লাহু আকবার বলা’।

৭. ইমাম কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ এভাবে শিরোনাম রচনা করেন, بَابُ التَّكْبِيرِ بَعْدَ انْقِضَاءِ الصَّلَاةِ তথা- ‘ছালাত শেষে আল্লাহু আকবার বলা’।

এছাড়া আরও অনেক ইমাম এমন শিরোনাম রচনা করেছেন। এসব থেকে প্রমাণিত হয় যে, ছাহাবী, তাবেঈ ও পরবর্তী ইমামগণ ‘তাকবীর’ দ্বারা শুধু ‘আল্লাহু আকবার’ বলা বুঝেছেন এবং তা ছালাত শেষে বলার কথা বলেছেন। যেমন ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, فَقَدْ تَبَيَّنَ بِهَذَا أَنَّ مَعْنَى التَّكْبِيرِ الَّذِي كَانَ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَقِبَ الصَّلَاةِ الْمَكْتُوبَةِ: هُوَ ثَلاثُ تَكْبِيرَاتٍ مُتَوَالِيَةٍ ‘এসব আছার ও হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে ফরয ছালাত শেষে প্রদত্ত ‘তাকবীর’ এর অর্থ হলো, ধারাবাহিকভাবে তিনবার আল্লাহু আকবার বলা’।[8]

কিছু আপত্তি এবং তার পর্যালোচনা:

প্রথম আপত্তি: ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদীছে বর্ণিত ‘তাকবীর’ দ্বারা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা উদ্দেশ্য নয়, বরং ‘যিকির’ উদ্দেশ্য। এর প্রমাণ হলো, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা নিজেই অন্য হাদীছে বলেছেন, আমি যিকিরের মাধ্যমে সালাম ফেরানো বুঝতে পারতাম। যেমন- তিনি বলেছেন, «أَنَّ رَفْعَ الصَّوْتِ، بِالذِّكْرِ حِينَ يَنْصَرِفُ النَّاسُ مِنَ المَكْتُوبَةِ كَانَ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: «كُنْتُ أَعْلَمُ إِذَا انْصَرَفُوا بِذَلِكَ إِذَا سَمِعْتُهُ» ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মুছল্লীগণ ফরয ছালাত যখন শেষ করতেন, তখন উচ্চৈঃস্বরে যিকির করতেন’। ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, ‘আমি তা শুনে বুঝতাম যে, তারা ছালাত শেষ করেছেন’।[9]

অতএব, এখানে ‘তাকবীর’ অর্থ ‘যিকির’। আর অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলতেন। তাই ‘তাকবীর’ ও ‘যিকির’ দ্বারা ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ উদ্দেশ্য। কারণ ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ একটি যিকির।

পর্যালোচনা:

১. অনেক মুহাদ্দিছ ‘তাকবীর’ দ্বারা আল্লাহু আকবার বুঝেছেন, যেমনটি ওপরে আমরা সাতজন মুহাদ্দিছ ও ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ-এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছি। তাছাড়া প্রচলিতভাবে ‘তাকবীর’ দ্বারা আল্লাহু আকবার বুঝায়। আর প্রচলিত অর্থ ছাড়া ভিন্ন অর্থ তখন নেওয়া যাবে, যখন প্রচলিত অর্থ নেওয়া সম্ভব নয়। অথচ এখানে এমন কিছু নেই, যার কারণে প্রচলিত অর্থ নেওয়া সম্ভব নয়।

২. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মূলনীতি হচ্ছে, নুছূছ তথা স্পষ্ট দলীলের শব্দকে বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। বাহ্যিক অর্থ ছাড়া ভিন্ন কোনো অর্থে গ্রহণ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নীতি নয়। আশআরী, মাতুরীদী ও অন্যান্য কালামপন্থি ফেরক্বাগুলোকে আমরা বিভ্রান্ত বলি। কারণ তারা ছিফাতের শব্দগুলোর বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে না। আর আমরা সবাই জানি ‘তাকবীর’ শব্দের বাহ্যিক অর্থ ‘আল্লাহু আকবার’ বলা। তাই এখানে কোনোরকম ছরিফ ছাড়া বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করা মানে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মূলনীতির খেলাফ করা। তাছাড়া ফিক্বহী মূলনীতি হলো, لَا عِبْرَةَ بِالدَّلَالَةِ فِي مُقَابَلَةِ التَّصْرِيحِ অর্থাৎ ‘স্পষ্ট দলীলের বিপরীতে দালালতের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই’। তাকবীর শব্দের হাক্বীক্বী, শারঈ, উরফী ও আক্বলী অর্থ আল্লাহু আকবার বলা। আর যারা এমন হাক্বীক্বী, শারঈ, উরফী ও আক্বলী শব্দকে ভিন্ন অর্থে নিয়ে যাচ্ছেন, তারা কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়াই নিয়ে যাচ্ছেন, যা গ্রহণযোগ্য নয়।

৩. যে হাদীছে ‘যিকির’-এর কথা এসেছে, তা মুজমাল অর্থাৎ স্পষ্টভাবে বলা হয়নি—কোন যিকির করতেন। আর যে হাদীছে তাকবীরের কথা এসেছে, তা প্রথম হাদীছের মুফাসসার অর্থাৎ বলে দেওয়া হয়েছে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার মাধ্যমে যিকির করতেন। আর সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি হচ্ছে, মুজমাল ও মুফাসসারের মাঝে কোনো বিরোধ থাকে না; বরং যে নাছ মুজমাল নাছের তাফসীর করে, সে মুফাসসার নাছ গ্রহণ করতে হয়। কারণ এর মাধ্যমে একসাথে দুই দলীলের ওপর আমল করা হয়ে যায়। তাই এখানে ‘আল্লাহু আকবার’ এর হাদীছকে গ্রহণ করতে হবে। তাহলে উভয় দলীলের ওপর আমল হয়ে যাবে।

৪. যে হাদীছে ‘যিকির’ এর কথা এসেছে, তা ‘আম বা ব্যাপক অর্থবোধক হাদীছ। এ যিকিরের মাঝে যেকোনো যিকির প্রবেশ করতে পারে। আর যে হাদীছে তাকবীরের কথা এসেছে, সে হাদীছ যিকির শব্দকে এভাবে খাছ বা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে, যিকির বলতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা। আর সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতি হচ্ছে, ‘আম ও খাছের মাঝে কোনো বিরোধ থাকে না; বরং ‘আম নাছকে যে নাছ খাছ করে দেয়, সে খাছ নাছ গ্রহণ করতে হয়। কারণ এর মাধ্যমে একসাথে দুই দলীলের ওপর আমল করা হয়ে যায়। তাই এখানে ‘আল্লাহু আকবার’-এর হাদীছকে গ্রহণ করতে হবে।

৫. তাকবীর শব্দের অর্থ যদি যিকির ও আসতাগফিরুল্লাহ নেওয়া হয়, তাহলে তা যিকির ও ইসতিগফারের তাকীদ হচ্ছে, তখন তাকবীরের ভিন্ন কোনো অর্থ থাকে না; কিন্তু তাকবীর শব্দের অর্থ যদি আল্লাহু আকবার নেওয়া হয়, তাহলে তা থেকে তাসীস বা নতুন এক অর্থ ও বিধান সাব্যস্ত করা হচ্ছে। আর মূলনীতি হচ্ছে,حَمْلُ الكَلَامِ عَلَى التَّأْسِيسِ أَوْلَى مِنَ التَّأْكِيدِ অর্থাৎ ‘বাক্যকে তাকীদের অর্থে প্রয়োগ করার চেয়ে তাসীসের অর্থে প্রয়োগ করা উত্তম’। এর কারণ হচ্ছে, তাকীদ অর্থ গ্রহণ করলে ঐ শব্দ থেকে তেমন কোনো উপকার পাওয়া যায় না; অথচ তাসীস অর্থ গ্রহণ করলে তা থেকে নতুন একটি বিধান ও অর্থ পাওয়া যায়। তাই তাসীসের মূলনীতি অনুযায়ী এখানে তাকবীর দ্বারা আল্লাহু আকবার অর্থ গ্রহণ করতে হবে।

৬. ‘যিকির’ শব্দ দ্বারা ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ অর্থ নেওয়া থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ অর্থ নেওয়া বেশি যুক্তিযুক্ত। এর কারণ দুটি—

(ক) স্বয়ং বর্ণনাকারী ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা মুজমাল বা ‘আম যিকিরকে অন্য বর্ণনায় তাফসীর বা খাছ করে বলে দিয়েছেন যে, যিকির দ্বারা তাকবীর বা আল্লাহু আকবার উদ্দেশ্য। আর মূলনীতি হচ্ছে, স্বয়ং বর্ণনাকারী যদি কোনো হাদীছের তাফসীর করে দেন, তাহলে তার তাফসীর অন্য যে কারো তাফসীরের ওপর প্রাধান্য পাবে। অতএব, এখানে অন্য বর্ণনার ‘আসতাগফিরুল্লাহ’-এর ওপর আল্লাহু আকবার তাফসীর প্রাধান্য পাবে।

(খ) যিকির শব্দটি যদিও ব্যাপক অর্থবোধক, কিন্তু সবচেয়ে উত্তম যিকির সেটাই, যাতে কেবল আল্লাহর বড়ত্ব ও গুণকীর্তন বর্ণনা করা হয়। এ কারণে হাদীছে বলা হয়েছে, উত্তম যিকির হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কারণ এখানে নিরেট আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। আর ‘আসতাগফিরুল্লাহ’-এর তুলনায় ‘আল্লাহু আকবার’ উত্তম যিকির। কারণ ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ বলার মাধ্যমে বান্দা নিজের চাহিদা ও দাবিদাওয়া আল্লাহর কাছে পেশ করে, এর মাধ্যমে নিরেটভাবে আল্লাহর বড়ত্ব ও গুণকীর্তন করা হয় না। অপরপক্ষে ‘আল্লাহু আকবার’-এর মাধ্যমে বান্দা নিরেটভাবে আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা করে। তাই যিকির দ্বারা তাকবীর তথা আল্লাহু আকবার অর্থ নেওয়া বেশি যৌক্তিক।

৭. আমরা যদি তাকবীর দ্বারা আসতাগফিরুল্লাহ অর্থ গ্রহণ করি, তাহলে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা হাদীছের প্রতি আমল করা হলো না; বরং আল্লাহু আকবার বলা হাদীছের প্রতি আমল বর্জন করা হলো। অপরপক্ষে আমরা যদি আল্লাহু আকবার ও আসতাগফিরুল্লাহ উভয় হাদীছের প্রতি আমল করি, তাহলে উভয় হাদীছের প্রতি আমল করা হয়। আর মূলনীতি হচ্ছে, إِعْمَالُ الدَّلِيلَيْنِ أَوْلَى مِنْ إِهْمَالِهِمَا অর্থাৎ ‘এক দলীলের প্রতি আমল বাদ দেওয়ার চেয়ে দুই দলীলের প্রতি আমল করা উত্তম’।

৮. তাকবীর দ্বারা প্রথমে যিকির, তারপর আসতাগফিরুল্লাহ অর্থ নেওয়া মুহমাল ও মুহতামাল। পক্ষান্তরে তাকবীর দ্বারা আল্লাহু আকবার অর্থ নেওয়া মুহকাম ও মুফাসসাল। আর মুহমাল-মুহতামালের ওপর মুহকাম-মুফাসসাল প্রাধান্য পায়। তাই এখানে তাকবীর দ্বারা ‘আল্লাহু আকবার’ অর্থ প্রাধান্য পাবে।

৯. আমরা দেখেছি, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর সন্তান আলী রাহিমাহুল্লাহ ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন। এখান থেকে অনুমান করা যায় যে, তিনি তা তার পিতা থেকে শুনেছেন। আর এভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা তাকবীর ও যিকির দ্বারা আল্লাহু আকবার বলা তার সন্তানকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন।

১০. ছাহাবী ও তাবেঈগণ যিকির দ্বারা আসতাগফিরুল্লাহ অর্থ বুঝেননি; বরং আল্লাহু আকবার বুঝেছেন। তাই তারা আল্লাহু আকবার বলতেন।

উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ‘যিকির’ ও ‘তাকবীর’ দ্বারা আল্লাহু আকবার বলা উদ্দেশ্য; ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নয়।

দ্বিতীয় আপত্তি: ‘আল্লাহু আকবার’ বলা দ্বারা ছালাতের পর যে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলা হয়, সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা উদ্দেশ্য।

পর্যালোচনা: তাদের এ কথা সঠিক নয়। এর কারণ হলো—

১. আমরা দেখতে পাই, তিনটি বাক্য হাদীছে ৩৩ বার ও ১০ বার করে বলার কথা এসেছে। অথচ আমরা দেখলাম, ছাহাবী ও তাবেঈগণ আলোচিত আল্লাহু আকবার তিনবার করে বলতেন। তাই আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, তা দ্বারা ছালাতের পরের যে সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলা হয়, সে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা উদ্দেশ্য নয়।

২. মুতাওয়াররাছ বা সালাফদের যুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা আমল হচ্ছে, মনে মনে এ তিন শব্দের যিকির করা। কেউ এসব যিকির সরবে করে না, যা প্রমাণ করে যে, আলোচিত তাকবীর এ তিন শব্দের যিকির নয়। তাছাড়া আমরা দেখলাম, ছাহাবী ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, মুক্তাদীরা সবাই ‘তাকবীর’ সরবে বলতেন। আর তারা যদি সবাই সরবে যিকিরগুলো করতেন, তাহলে মসজিদ শব্দে পরিপূর্ণ হয়ে যেত; অথচ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীদের মসজিদে নিচু স্বরে যিকির করতে আদেশ দিয়েছেন।

তৃতীয় আপত্তি: অন্য হাদীছে এসেছে,إِذَا انْصَرَفَ مِنْ صَلَاتِهِ اسْتَغْفَرَ ثَلَاثًا ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ছালাত শেষ করতেন, তখন তিনবার ইসতিগফার করতেন তথা আসতাগফিরুল্লাহ বলতেন’।

এ হাদীছে বলা হচ্ছে যে, ছালাত শেষ করলে তিনবার আসতাগফিরুল্লাহ বলতেন। অতএব, এ হাদীছ থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি আসতাগফিরুল্লাহ বলতেন; আল্লাহু আকবার নয়।

পর্যালোচনা: তাদের এ আপত্তি কয়েকটি কারণে সঠিক নয়—

১. আমরা পূর্বে মূলনীতি দেখেছি যে,إِعْمَالُ الدَّلِيلَيْنِ أَوْلَى مِنْ إِهْمَالِهِمَا অর্থাৎ ‘এক দলীলের প্রতি আমল বাদ দেওয়ার চেয়ে দুই দলীলের প্রতি আমল করা উত্তম’। অতএব, যদি ইসতিগফারের হাদীছের মাধ্যমে তাকবীরের হাদীছ বাদ দেওয়া হয়, তাহলে একটি দলীলকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা উভয় দলীলের প্রতি এভাবে আমল করতে পারি যে, প্রথমে তিনি আল্লাহু আকবার বলতেন, তারপর আসতাগফিরুল্লাহ বলতেন।

২. মূলনীতি হচ্ছে, যদি উভয় দলীলের মাঝে বিরোধ দেখা দেয়, তাহলে উভয় হাদীছের মাঝে সমন্বয় করে উভয় হাদীছের ওপর আমল করতে হবে। সমন্বয় করা সম্ভব হলে উভয়ের একটি হাদীছকে আমলহীন করা যাবে না। আর আমরা এখানে উভয় হাদীছের প্রতি এভাবে আমল করতে পারি যে, প্রথমে তিনি আল্লাহু আকবার বলতেন, তারপর আসতাগফিরুল্লাহ বলতেন।

৩. যে হাদীছে ইসতিগফারের কথা বলা হয়েছে, সে হাদীছে আল্লাহু আকবার বলাকে নাকচ করা হয়নি; বরং শুধু বলা হয়েছে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার ইসতিগফার করতেন। আর এক জিনিস সাব্যস্ত হলে অন্য জিনিস নাকচ হয়ে যায় না। তাই এ হাদীছ আল্লাহু আকবার বলাকে নাকচ করার দলীল হিসেবে উপযুক্ত নয়।

৪. ইসতিগফারের হাদীছে বর্ণিত ‘ইনছারাফা বা ছালাত শেষ করার সময়’ শব্দ দ্বারা যদি আল্লাহু আকবার বলা নাকচ করা হয়, তাহলে অন্যান্য হাদীছ দ্বারা আসতাগফিরুল্লাহ বলাও নাকচ হয়ে যাবে। যেমন—

ক. মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِذَا انْصَرَفَ مِنْ الصَّلَاةِ اللَّهُمَّ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ ‘আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি যখন ছালাত শেষ করতেন, তখন আল্লাহুম্মা লা মানিআ লিমা… পড়তেন’।[10]

খ. আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়র রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا انْصَرَفَ مِنَ الصَّلاَةِ يَقُولُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ أَهْلُ النِّعْمَةِ وَالْفَضْلِ وَالثَّنَاءِ الْحَسَنِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ ‘নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ছালাত শেষ করতেন, তখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু… বলতেন’।[11]

গ. মুগীরা ইবনু শু‘বা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ إِذَا انْصَرَفَ مِنْ الصَّلَاةِ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ اللَّهُمَّ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ ‘আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি যখন ছালাত শেষ করতেন, তখন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু… বলতেন’।[12]

এ ধরনের আরও অনেক হাদীছ রয়েছে। অতএব, যারা ‘ইনছারাফা’ দ্বারা আল্লাহু আকবার বলাকে নাকচ করেন, জানি না তারা আসতাগফিরুল্লাহ-সহ সবগুলো দু‘আকে নাকচ করে ফেলবেন কি-না! এখন প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আল্লাহু আকবার প্রথমে বলার দলীল কী?

প্রথমে আল্লাহু আকবার বলার কয়েকভাবে দলীল রয়েছে—

১. ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলছেন, তিনি আল্লাহু আকবার শোনার মাধ্যমে সালাম ফেরানোর কথা বুঝতে পারতেন। তার একথা প্রমাণ করে যে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমেই আল্লাহু আকবার বলতেন, তারপর অন্যান্য দু‘আ বলতেন। কারণ তিনি যদি পরে আল্লাহু আকবার বলতেন এবং আগে অন্যান্য যিকির করতেন, তাহলে অন্যান্য যিকিরের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পারতেন যে, তিনি এখন সালাম ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া অন্যান্য যিকিরের পর আল্লাহু আকবার বললে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাম ফেরানো দেখে আশেপাশের ছাহাবীগণ অবশ্যই সালাম ফিরিয়ে দিতেন এবং তাদের দেখাদেখি ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমাও সালাম ফিরিয়ে দিতেন আল্লাহু আকবার-এর আওয়াজ শোনার পূর্বে। কারণ পরে আল্লাহু আকবার বললে দীর্ঘক্ষণ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-কে সালাম না ফিরিয়ে বসে থাকতে হতো। আর এমনটা হওয়া দূরবর্তী বিষয়।

২. ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদীছে বর্ণিত, ‘انقضاء الصلاة বা ছালাতের শেষ’ বাক্য দ্বারা পরপরই বুঝায়। এটা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তিনি আল্লাহু আকবার সালাম ফেরানোর পরপরই বলতেন আর ইসতিগফারের হাদীছে বর্ণিত ‘ইনছারাফা’ শব্দের অর্থ ঘোরা বা প্রস্থান করা। আর প্রস্থান করা বা ঘোরা সালাম ফেরানোর পরপরই হয় না, বরং সালাম ফেরানোর কিছুক্ষণ পর হয়। অতএব, প্রমাণিত হয় যে, তিনি আসতাগফিরুল্লাহ কিছুক্ষণ পর বলতেন। ইসতিগফার কিছুক্ষণ পর বলার আরও প্রমাণ হচ্ছে, আমরা দেখলাম, বিভিন্ন হাদীছে ইনছারাফা শব্দ দ্বারা সালাম পরবর্তী পঠিত অনেকগুলো বড় বড় যিকির করার কথা বলা হয়েছে। আর আমরা যদি ইনছারাফা শব্দ দ্বারা সালাম ফেরানোর পরপরই অর্থ গ্রহণ করি, তাহলে প্রশ্ন হবে, তিনি কোন যিকিরটি আগে বলেছেন? যদি ইসতিগফার ধরি, তাহলে অন্যান্য যিকির বাদ হয়ে যাবে আর অন্যগুলো ধরলে, ইসতিগফার বাদ হয়ে যাবে। অতএব, হাদীছে ইনছারাফা শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, ছাহাবীদের দিকে ঘোরার পরের লম্বা সময়কে অর্থাৎ তিনি ছাহাবীদের দিকে ঘোরার পর লম্বা সময়ে যিকিরগুলো পাঠ করতেন।

চতুর্থ আপত্তি: আমরা জানি কুরআন, হাদীছ ও ইজমা দ্বারা এটা প্রমাণিত যে, ছালাত শেষ করতে হয় সালামের মাধ্যমে। আর ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলছেন, তিনি ছালাত শেষ করা জানতে পারতেন তাকবীর দ্বারা। অতএব, এ হাদীছ দ্বারা আল্লাহু আকবার বলা প্রমাণ করলে কুরআন, হাদীছ ও ইজমা পরিপন্থী হবে। অতএব, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদীছ তাবীলযোগ্য এবং তা দ্বারা অন্য কোনো অর্থ প্রমাণ করে।

পর্যালোচনা: যারা এ আপত্তি তোলেন, তাদেরকে বলব, আপনাদের দাবি অনুযায়ী কুরআন, হাদীছ ও ইজমা পরিপন্থী হওয়ার দোহাই দিয়ে আপনারা তো হাদীছটিকে অস্বীকার করেন না। আমরাও ঠিক আপনাদের মতোই হাদীছটিকে অস্বীকার করি না। এরপর বলব, আপনারা বলেন, এখানে তাকবীর দ্বারা সালাম ফেরানো উদ্দেশ্য নয়। আমরাও আপনাদের মতো বলি, এখানে তাকবীর দ্বারা সালাম ফেরানো উদ্দেশ্য নয়। এরপর আবার বলব, আপনারা বলেন, ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর তাকবীর দ্বারা অমুক অমুক উদ্দেশ্য। আমরা বলব, আপনারা ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদীছের তাকবীরের বিভিন্ন তাবীল-ব্যাখ্যা ও সম্ভাবনা উল্লেখ করেন; কিন্তু আমরা আপনাদের মতো বিভিন্ন তাবীল-ব্যাখ্যা ও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ না করে আহলুস সুন্নাহ ও ফিক্বহের মূলনীতি অনুযায়ী বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করি। পক্ষান্তরে আপনাদের তাবীল ও সম্ভাবনার দুর্বলতা আমরা জানিয়েও দিয়েছি।

পঞ্চম আপত্তি: ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা তখন ছোট ছাহাবী ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে হয়তো ছালাতে উপস্থিত হতেন অথবা ছোট বাচ্চা হওয়ার কারণে কোনো অসঙ্গতিও হতে পারে।

পর্যালোচনা-: আল-‘ইয়াযু বিল্লাহ (আমরা এমন কথা বলা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই)। এমন খোঁড়া অজুহাত দিয়েই কট্টর মাযহাবীরা বিভিন্ন হাদীছের পোস্টমোর্টেম করে থাকে, অথচ আহলুল হাদীছ এসবের কারণে মাযহাবীদের নিন্দা করে থাকে।

পর্যালোচনা-২: ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা ছোটকাল থেকেই রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত জানা ও মানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন, যার ফলে একজন ছোট বাচ্চা হয়েও নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পায়ের দিকে শুয়ে থেকে সারারাত জেগে জেগে তাকিয়ে থাকতেন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখন তাহাজ্জুদ পড়তে উঠেন আর আমি তাঁর তাহাজ্জুদ পড়া নয়নভরে অবলোকন করি। যে ছাহাবী এত ছোট থেকেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের প্রতি এতটা উদগ্রীব ছিলেন, সেই ছাহাবীর ক্ষেত্রে কীভাবে এমন মন্তব্য করা যেতে পারে!

পর্যালোচনা-: বরং বয়স্কদের তুলনায় বাচ্চাদের মস্তিষ্ক বেশি পরিষ্কার থাকে। তারা যা দেখে, তা সবচেয়ে বেশি ও হুবহু মুখস্থ রাখতে পারে। আর ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মতো চরম মেধাবী ও সুন্নাতের প্রতি উদগ্রীব হলে তো আর কোনো কথাই নেই। অতএব, এসব অজুহাতের কোনো অর্থ নেই।

সপ্তম আপত্তি: চার মাযহাব ও কোনো সালাফ ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর হাদীছ দ্বারা আল্লাহু আকবার বুঝেননি।

পর্যালোচনা: তাদের এমন আপত্তির কোনো মূল্য নেই। এর কারণ হলো—

(ক) আহলুল হাদীছের মূলনীতি হলো, কোনো আমল হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হলে সে আমল করতে হবে। এটা দেখা যাবে না যে, কেউ সেই হাদীছের প্রতি আমল করেছে কি-না। এ কারণে আমরা তালাক ও বুকের ওপর হাত বাঁধার হাদীছের প্রতি কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই আমল করি। এছাড়া এমন অনেক মাসআলা রয়েছে।

(খ) আমরা ওপরে ছাহাবী, তাবেঈ ও ইমামদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। দেখেছি তা ছাহাবী ও তাবেঈদের আমল ছিল। অতএব, এমন দাবি সঠিক নয়।

কতবার আল্লাহু আকবার বলতে হবে?

আমরা ওপরে ছাহাবী ও তাবেঈদের আমল দেখেছি যে, তারা তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন। অতএব, তিনবার আল্লাহু আকবার বলতে হবে। তিনবার বলার কথা বলেছেন ইমাম ইবনু রজব হাম্বলী রাহিমাহুল্লাহ।[13] আল্লামা উবায়দুল্লাহ রহমানী মুবারাকপুরী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, একবার বা তিনবার বলা যায়।[14] আল্লাহু আ‘লাম!

আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহ বুঝার এবং গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হওয়ার তাওফীক্ব দিন- আমীন!

আব্দুল্লাহ মাহমুদ

* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, বীরহাটাব-হাটাব, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।


[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৪২।

[2]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/১৭০৭; মুসনাদে আবী আওয়ানাহ, হা/২০৬৫।

[3]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/১৭০৭; মুসনাদে আবী আওয়ানাহ, হা/২০৬৫।

[4]. ইবনু রজব, ফাতহুল বারী, ৫/২৩৪।

[5]. মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩১২১।

[6]. মুছান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩১২১।

[7]. আত্ব-ত্ববাকাতুল কুবরা, ৫/২৮১।

[8]. ফাতহুল বারী, ৫/২৩৪।

[9]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/১২০৫।

[10]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৮৮৯।

[11]. আবূ দাঊদ, হা/১৫০৮।

[12]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮২৩২।

[13]. ফাতহুল বারী, ৫/২৩৪।

[14]. মিরআতুল মাফাতীহ, ৩/৩১৫।

Magazine