মুখবন্ধ:
আল-হামদুলিল্লাহ! আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন মহামহিম আল্লাহ তাআলা। এই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে কারো অবস্থান গগনচুম্বী, আবার কারো পাতাল তলে। তাই তো সেরা জীব হওয়ার পরও কর্মদোষে কেউ হয়ে যায় নিকৃষ্টতম চতুষ্পদ জন্তুর মতো। কীসে তাকে করবে এই মহান মর্যাদার অধিকারী?
কেহ মরিয়া নেতৃত্ব লইয়া কেউ বা খোঁজে অর্থকড়ি,
আসলে সব নিরর্থক রব্বে কারীমের পথ ছাড়ি।
শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা অর্জনের জন্য একটি মহৎ গুণ হচ্ছে, বিনয়-নম্রতা বা শিষ্টাচার। আমরা বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে কুরআন-সুন্নাহ থেকে ‘বিনয়’ সম্পর্কে জানব, ইন-শা-আল্লাহ!
বিনয় বা শিষ্টাচার (اَلتَّوُاضُعُ)-এর পরিচয়:
تواضع অর্থ বিনয়, নম্রতা, হীনতা, নিরহংকার, নিজেকে ছোট মনে করা, অন্যকে সম্মান করা এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি না করা। পারিভাষিক অর্থে,التَّوَاضُعُ هُوَ خَفْضُ الجَنَاحِ لِلنَّاسِ وَتَرْكُ التَّكَبُّرِ عَلَيْهِمْ অর্থাৎ ‘নম্রতা হলো মানুষের প্রতি নিজের ডানা নত করা (অর্থাৎ বিনয় প্রকাশ করা) এবং তাদের ওপর অহংকার ত্যাগ করা’।
বিনয় একটি মহৎ গুণ:
বিনয় বা শিষ্টাচার এক ইলাহী গুণ, যার পরতে পরতে রয়েছে রবের দিশা, কে আছে রুদ্ধ করবে তার পথকে? কেউ বিনয়ী বা নিরহংকারী হলে, সে হবে সবার উপরে সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। যেই সম্মান অন্য কিছু দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়।
তাই তো আমাদের হৃদয়ের স্পন্দন, উম্মতের কাণ্ডারি, সম্মান-মর্যাদার সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী, বিনয়-নম্রতার আদর্শ প্রতীক প্রাণপ্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ وَمَا زَادَ اللَّهُ عَبْدًا بِعَفْوٍ إِلاَّ عِزًّا وَمَا تَوَاضَعَ أَحَدٌ لِلَّهِ إِلاَّ رَفَعَهُ اللَّهُ ‘দান-খয়রাত ধনসম্পদ কমিয়ে দেয় না। বান্দা (অপরকে) ক্ষমা প্রদর্শন করলে আল্লাহ তার সম্মান বর্ধন করেন। আর আল্লাহর ওয়াস্তে যে ব্যক্তি বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেন’।[1]
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: উপরিউক্ত হাদীছে তিনটি মহৎ নৈতিক গুণ শেখানো হয়েছে—
(ক) ছাদাক্বা (দান): মানুষ ভাবে দান দান-ছাদাক্বা করলে সম্পদ কমে, কিন্তু আল্লাহর কাছে তা বাড়ে।
(খ) ক্ষমা: যে মানুষ অন্যকে ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন এবং সম্মানিত করেন। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لاَ يَرْحَمُ اللَّهُ مَنْ لاَ يَرْحَمُ النَّاسَ ‘যারা মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া করবেন না’।[2]
(গ) বিনয় (تواضع): যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজেকে ছোট মনে করে, অহংকার ত্যাগ করে, দম্ভ করে চলে না, বিনয়ী হয়ে চলে, আল্লাহ তাকে সমাজে, মানুষের হৃদয়ে ও আখেরাতে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন।
আল্লাহর জন্য বিনয়:
হাদীছে বলা হয়েছে, ‘لله’ অর্থাৎ এই বিনয় শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। যে বিনয় মানুষকে দেখানোর জন্য, তা আসলে লজ্জাজনক ভণ্ডামি, রিয়া ও সুমআ। কিন্তু যে বিনয় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, সেটা সত্যিকারের ইবাদত। আল্লাহ তাকে সম্মানিত করেন।
এখানে এক আশ্চর্য নীতি আছে, মানুষ সাধারণত ভাবে, বিনয় প্রকাশ করলে মানুষ ছোট, অপমানিত, লজ্জিত ও অপদস্থ হয়; অথচ আল্লাহর নীতিতে বিনয় প্রকাশ করলে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়ান এবং তাকে সম্মানের উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেন।
বিনয়-নম্রতার আদেশ:
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন,وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ‘যে মুমিনেরা তোমার অনুসারী, তাদের প্রতি তুমি তোমার ডানা (বিনয় ও নম্রতা) নত করো’ (আশ-শুআরা, ২৬/২১৫)।
মহান আল্লাহ তাঁর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যেন তিনি নিজের অনুসারীদের প্রতিও বিনয় দেখান। এটা বিনয়ের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। লুক্বমান হাকীম স্বীয় সন্তানকে নছীহত করে বলেন, وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ ‘আর তুমি মানুষের প্রতি অবজ্ঞাভরে তোমার গাল বাঁকা করো না এবং যমীনে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না’ (লুক্বমান, ৩১/১৮)।
বিনয় সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত:
আল্লাহ তাআলা বারবার অহংকারকে ধ্বংসের কারণ বলেছেন এবং বিনয়কে ঈমানদারদের গুণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অহংকার (الكِبْر) ও বিনয় (التواضع) বিষয়ে কুরআনে বহু আয়াত রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَن تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَن تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُولًا ‘তুমি গর্বভরে পৃথিবীতে হেঁটো না। তুমি তো মাটি ফুঁড়ে ফেলতে পারবে না আর পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছতেও পারবে না’ (আল-ইসরা, ১৭/৩৭)।
অহংকার মানুষকে বাস্তবতা ভুলিয়ে দেয়। একজন মানুষের শক্তি যতই থাকুক, কিন্তু তার একটা সীমা আছে। তাই মানুষকে বিনয়ী হতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُسْتَكْبِرِينَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না’ (আন-নাহল, ১৬/২৩)।
অহংকার এমন এক রোগ, যা ইবাদতকে নষ্ট করে দেয়, যেমনটা শয়তান কেবল তার অহংকারের কারণেই ধ্বংস হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَى كُلِّ قَلْبِ مُتَكَبِّرٍ جَبَّارٍ ‘এভাবে আল্লাহ প্রত্যেক অহংকারী ও জবরদস্ত ব্যক্তির হৃদয়ে সিলমোহর করে দেন’ (গাফির, ৪০/৩৫)।
অহংকারের পরিণাম হলো হৃদয়ের কঠোরতা ও হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন,وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা গর্বভরে এবং লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের ঘর থেকে বের হয়েছিল’ (আল-আনফাল, ৮/৪৭)।
উল্লিখিত আয়াতে বদর যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কুরাইশের কাফেররা অহংকার করে যুদ্ধ করতে এসেছিল আর মুসলিমরা বিনয় ও তাওয়াক্কুল নিয়ে। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا ‘রহমানের বান্দারা তারা, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে’ (আল-ফুরক্বান, ২৫/৬৩)।
এটি কুরআনে বিনয়ের সর্বোচ্চ প্রশংসা। ‘هوْنًا’ মানে শান্ত, নম্র ও অহংকারবিহীন জীবনযাপন। আল্লাহ তাদেরই ‘রহমানের বান্দা’ বলে ডাকেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘এই হচ্ছে আখেরাতের নিবাস, যা আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা যমিনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্য’ (আল-ক্বাছাছ, ২৮/৮৩)।
আল্লাহ তাআলা বলেন, فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَوَكِّلِينَ ‘আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের প্রতি কোমল-হৃদয় হয়েছিলেন; যদি আপনি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। কাজেই আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন আর কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, তারপর আপনি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর উপর নির্ভর করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ (তার উপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন’ (আলে ইমরান, ৩/১৫৯)।
সংক্ষেপে বলা যায়, কুরআনে বিনয় ও অহংকার নিয়ে অনেক জায়গায় আলোচনা হয়েছে। আল্লাহর ভালোবাসা সর্বদা বিনয়ীদের জন্য আর ঘৃণা অহংকারীদের জন্য।
বাস্তব জীবনে প্রয়োগ:
এটা একজন মুমিনের অন্তরের পবিত্রতা ও আত্মার স্বচ্ছতার পরিচায়ক, যা সমাজে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে। যেমন—
১. শিক্ষক যদি বিনয়ী হন, তাহলে তার জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে।
২. দাঈ যত বিনয়ী ও নম্র হবেন, তার দাওয়াতে মানুষ তত প্রভাবিত হবে।
৩. নেতা যদি বিনয়ী হন, তাহলে মানুষ তার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে।
৪. আলেম যদি বিনয়ী হন, তাহলে তার জ্ঞান মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে।
৫. মালিক যদি বিনয়ী হন, তাহলে তার কর্মীরা হবে তার উত্তম সহযোগী।
৬. অভিভাবক যত বেশি বিনয়ী হবে, সে তার অধীনদের তত বেশি সহযোগী হিসেবে পাবে।
৭. আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম ও তার ভাই হারূন আলাইহিস সালাম-কে ফেরাউন এর মতো অহংকারী, অবাধ্য ও স্বৈরাচারী শাসককে নরম ও কোমলভাবে দাওয়াত দেওয়ার জন্য আদেশ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى ‘তোমরা তার সাথে নম্রভাবে কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (ত্ব-হা, ২০/৪৪)।
বিনয়ের ফলাফল:
নম্রতা মানুষকে আল্লাহর নিকট সম্মানিত করে এবং মানুষের হৃদয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগায়। পক্ষান্তরে অহংকার মানুষকে ঘৃণিত ও দূরে ঠেলে দেয়। তাই নম্রতা হলো প্রকৃত মর্যাদার পথ এবং এমন এক চরিত্রের অলংকার, যা কখনো মলিন হয় না। এর কয়েকটি ইতিবাচক দিক হলো—
১. কোমল হৃদয় (নম্রতা) দিয়ে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা যায়।
২. মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায়।
৩. আল্লাহর নিকট মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
৪. সমাজে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫. অহংকারমুক্ত থাকা যায়।
৬. অন্যের কল্যাণ কামনা করা যায়।
৭. বিনয় আখেরাতে সফলতার শর্ত।
৮. অধিকন্তু আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবেন।
৯. সৃষ্টিজীবের মানসে স্থান করে নেওয়ার সর্বোচ্চ উপায়।
১০. বিনয়-নম্রতা মর্যাদার সোপান।
পরিশেষে বলা যায়, বিনয়-নম্রতা মানুষের এমন এক গুণ, যা মানুষের অন্তরে শান্তি আনে, সম্পর্ককে দৃঢ় করে এবং সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌহার্দ বৃদ্ধি করে। সুতরাং আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিনয় ও নম্রতাকে ধারণ করা— কথাবার্তা, পোশাক, জ্ঞান ও আচরণে। আল্লাহ আমাদেরকে বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করার তাওফীক্ব দিন- আমীন!
আবু আল-মিনান মো. আল-আমিন
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৮।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩৭৬।
