কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

ইসকনের আদ্যোপান্ত

post title will place here

ইসকন (ISCKON) শব্দটির পূর্ণরূপ হলো ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (International Society for Krishna Consciousness)। যাকে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘ইসকন’ আর এর বাংলা হলো আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ। অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ (১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬ – ১৪ নভেম্বর, ১৯৭৭) নামে এক ব্যক্তি ১৯৬৬ সালের ১৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, ইসকনের আধ্যাত্মিক ও প্রশাসনিক সদরদপ্তর ভারতের নদীয়া জেলার মায়াপুরে অবস্থিত।

আদর্শ:

ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ শ্রী কৃষ্ণের প্রতি ভক্তির প্রসার ঘটানোর জন্য এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।[1] এজন্য আধ্যাত্মিক সমাজে ইসকনকে ‘হরে কৃষ্ণ আন্দোলন’ বলা হয়ে থাকে। হিন্দুধর্ম মতে, কৃষ্ণকে বলা হয় বিষ্ণুর অবতার। তাই ইসকন মূলত গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতবাদের অনুসারীদের একটি হিন্দুধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। গৌড়ীয় বৈষ্ণব বলতে বুঝায় প্রাচীন বাংলার গৌড় অঞ্চলে বিষ্ণুর উপাসকদের মতো প্রচলিত হিন্দুধর্মের একটি রীতি। ইসকনের মূল ধর্মবিশ্বাসটি শ্রীমদ্ভাগবত (SRIMAD BHAGAVATAM), ভগবৎ গীতা ও অন্যান্য বৈদিক শাস্ত্রসমূহের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ভগবৎ গীতা ও শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের উপর ভিত্তি করে ইসকনের শিক্ষা প্রচার করা হয়। হিন্দু ধর্মমতে, মানুষের আত্মার মুক্তির তিনটি শাস্ত্রীয় পথ রয়েছে— ১. ভক্তিযোগ ২. জ্ঞানযোগ ও ৩. কর্মযোগ।

ইসকন মূলত ভক্তিযোগ চর্চা করে। ভক্তিযোগ হলো ব্যক্তিগত দেবতাকে ভালোবাসার আধ্যাত্মিক পথ। ইসকন যেহেতু গড়ে উঠেছে কৃষ্ণকে ঘিরে, তাই ইসকনের কাজ হচ্ছে কৃষ্ণের উপাসনা করা আর হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করাই ইসকনের আদর্শ।[2]

উপরে উল্লিখিত আদর্শই ইসকনের আদর্শ। ঠিক এমনটি ইসকন সারা বিশ্বে প্রচারণা চালায়। ভুল হবে না যদি বলি, ইসকন আদর্শবিচ্যুত একটি সংগঠন। ইসকন প্রথমে ধর্মীয় চেতনায় প্রতিষ্ঠা হলেও একটা সময় তারা আদর্শবিচ্যুত হয়। উল্লেখ্য, ইসকনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ইসকনের স্লোগান হওয়ার কথা, হরে কৃষ্ণ; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলেও সত্য যে, এখন ইসকনের স্লোগান হচ্ছে ‘জয় শ্রী রাম’৷ সনাতনী সমাজ এ স্লোগানকে ঘৃণা করে। কেননা এ স্লোগান নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদের স্লোগান।[3] এম এ জাকারিয়া নামক এক ব্লগার ইসকন নিয়ে বলেন, এ সংগঠনটির বেসিক কনসেপ্ট মধ্যযুগের চৈতন্য’র থেকে আগত। চৈতন্য’র অনতম থিউরি হচ্ছে, ‘নির্যবন করোঁ আজি সকল ভুবন’ যার অর্থ হলো ‘সারা পৃথিবীকে যবন তথা মুসলিম মুক্ত করো’।[4]

এক কথায় ইসকন তার মূল আদর্শ থেকে বেরিয়ে গেছে আর এখন ইসকনের আদর্শ হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে মুসলিম নিধন করা। ঠিক এভাবেই ইসকন হয়ে উঠে বিশ্বময় মুসলিম নিধনের ট্রাম্পকার্ড।

হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদ কি এক?

সাধারণ জনমতে, ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী কোনো ধর্ম অন্য ধর্মকে ছোট করলে সেটা কোনো ধর্ম নয়। যেমন ইসলাম অন্য ধর্ম প্রচার ও প্রসারে বাধা দেওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে। ঠিক তেমনি হিন্দুধর্মও অন্য ধর্ম প্রচার ও প্রসারে বাধা দেওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে।

দৈনিক জনকণ্ঠের এক প্রতিবেদনে হিন্দুধর্ম নিয়ে বলা হয়, হিন্দুধর্মের মূলকথা পরমেশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা পদক্ষেপ হিসেবে আত্মার বিশুদ্ধতা অর্জন এবং সেটা ভক্তি, জ্ঞান ও কর্ম বা সৎ কাজের দ্বারা অর্জিত হতে পারে। হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করতে হলে বেদ, পুরাণ, শাস্ত্র ও শ্লোকে বিশ্বাস করতে হয়। তাই বলে ধর্মীয় আচার মানা বা না মানার ব্যাপারে কঠোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কেউ হয়তো পূজা করে না, মন্দিরে যায় না, এমনকি সে যদি নাস্তিকও হয়, তারপরও সে হিন্দুত্ব থেকে খারিজ হয়ে যায় না। এর জাতিভেদ প্রথা তথা জাতপাতের অভিশাপ ব্যাপারটা ছাড়া ক্ষতিকর দিক তেমনটা নেই।[5] অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ হলো হিন্দু সংস্কৃতি ধারণ করে উগ্রতাকে প্রমোট করে। হিন্দুত্ববাদ মনে করে, সারা বিশ্বে হিন্দু শাসন জারি করা দরকার।[6]

হিন্দুত্ববাদ হলো ভারতীয় বিজেপি (Bharatiya Janata Party)-এর গাইড লাইন। হিন্দুত্ববাদ ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য হুমকি। হিন্দুত্ববাদকে বুকে ধারণ করে ভারত এগিয়ে চলছে। হিন্দুধর্ম বলে, যত মত, তত পথ; কিন্তু হিন্দুত্ববাদ বলে, না, শুধু আমার হিন্দুরা সেরা। কেউ হিন্দু না হলে প্রয়োজনে জোর করে হিন্দু বানানোর নাম হিন্দুত্ববাদ। এক কথায় হিন্দু হলো একটি ধর্ম। আর হিন্দুত্ববাদ হলো হিন্দুধর্মের সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক মতবাদ। সাংঘর্ষিক বলা উচিত এ বলে যে, হিন্দুধর্ম নিয়ে অতিরঞ্জিত করছে হিন্দুত্ববাদ। উল্লেখ্য, হিন্দুত্ববাদের অতিরঞ্জিত আচরণ হিন্দু মতে নিষিদ্ধ। পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলে রাখছি, হিন্দুত্ববাদ শব্দটি প্রথম প্রচলন করেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর (২৮ মে, ১৮৮৩ - ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬)। ১৯২৩ সালে Hindutva: Who is a Hindu? বইয়ে প্রথম হিন্দুত্ববাদের কথা বলা হয়।[7]

ইসকন বনাম হিন্দুধর্ম:

সনাতনী হিন্দুদের মতে, ১২ মাসে ১৩ পূজা। যেমন- হিন্দুদের প্রধান উৎসব হচ্ছে দুর্গাপূজা। অন্য আরেকটি পূজা হচ্ছে কালীপূজা। অবশ্য দুর্গাপূজা ও কালীপূজা ইসকন সমর্থন করে না। বাংলাদেশের সকল হিন্দু ধর্মীয় রীতি মতে, সাধারণত রথযাত্রা করে ১ দিন। ইসকন সমর্থিত বাংলাদেশের প্রধান মন্দির স্বামীবাগে ৭ দিন রথযাত্রা করতে দেখা যায়। ৭ দিন রথযাত্রা নিয়ে অনেক হিন্দু ও বিশেষজ্ঞরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসকনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

হিন্দুধর্ম মতে, হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবতা হলো— ১. ব্রহ্মা ২. বিষ্ণু ও ৩. শিব। হিন্দুরা সকল দেবতার প্রধান মানে শিবকে। অন্যদিকে ইসকন বলছে ভিন্ন কথা। ইসকনের মতে, ৩৩ কোটি দেবতার প্রধান হচ্ছে কৃষ্ণ। এক কথায় ইসকন হলো শ্রী কৃষ্ণ নির্ভর। হিন্দুধর্ম মতে, জন্মের পরই বর্ণ অনুযায়ী হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় প্রতিটি সনাতনী সন্তান। হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার নিয়ম নেই। অন্যদিকে ইসকন অ-হিন্দু তথা খ্রিষ্টানদের হিন্দু বানাচ্ছে, যা হিন্দুধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক।

সনাতনী মন্দিরের পুরোহিতরা সাধারণ মানুষের মতো বিবাহ ও সংসার করেন। অন্যদিকে ইসকন সমর্থিত মন্দিরের বৈষ্ণবরা বিবাহ কিংবা সংসার করেন না। এখানে ইসকনকে খ্রিষ্টধর্মের সাথে মিল থাকায় অনেকে ইসকনকে খ্রিষ্টানদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

ইসকন সমর্থিত হিন্দুরা সনাতনী হিন্দুদের রান্না খায় না। সেই সনাতনী হিন্দু যদি নিজের মা-ও হয়, তবুও তার রান্না খায় না। ইসকন সমর্থিত হিন্দুরা নিজেরা নিজেদের হাতের রান্না খায়, যা হিন্দুধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসকন সমর্থিত হিন্দুরা সনাতনী হিন্দুদের হিন্দু মনে করে না।[8]

বিকৃত মস্তিষ্কের অভয়চরণারবিন্দের অজানা অধ্যায়:

ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কলকাতার সুবর্ণবণিক পরিবারে ১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পারিবারিক নাম ছিল অভয়চরণ দে। তিনি খ্রিষ্টান মিশনারি দ্বারা পরিচালিত কলকাতার স্কটিশ কলেজে পড়াশুনা করেন। কেউ কেউ বলছেন, অভয়চরণ দে আমেরিকার নিউইয়র্কে খ্রিষ্টান চার্চে পড়াশুনা করেছেন। অভয়চরণ দে পেশায় ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে কলকাতা ছেড়ে শূন্য হাতে আমেরিকায় পাড়ি জমান। ১৯৬৬ সালে আমেরিকায় ইসকনের হাতেখড়ি এই বিতর্কিত ব্যক্তির হাত ধরেই হয়।

বিতর্কিত বলার অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উদ্ভট মন্তব্য করেন। ১১ মে ১৯৭১ সালে মর্নিং ওয়াকে চাঁদ আর সূর্যের অবস্থান নিয়ে হাস্যকর মন্তব্য করে নিজের অবস্থান হারান। ওয়াশিংটন ডিসিতে ২ জুলাই ১৯৭৬ সালে এই বিতর্কিত ব্যক্তি বলেন, যেই মাত্র কোনো পুরুষ যুবতির স্তন এবং বাহুমূলে নেত্রপাত করে, তখনি সে শেষ। আর যতদিন সে এসবের দ্বারা আকৃষ্ট হবে, তাকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হবে।

আশা করি, এমন অশালীন কথামালা পাঠকের বোধগম্য হবে। অভয়চরণ দে ১৯৭৭ সালে মুম্বাইয়ে নারী স্বাধীনতা প্রসঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীকে পতিতা বলে সমালোচনার জন্ম দেন। ১৯৭৫ সালের ৯ নভেম্বর ধনঞ্জয়কে লেখা এক চিঠিতে ফুঠে উঠে অভয়চরণ দের নারীবিদ্বেষী চরিত্র।

২৬ অক্টোবর ১৯৭২ সালে শ্রীমদ্ভাগবত লেকচারে নারীদের বুদ্ধিমত্তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে বক্তব্য দেন অভয়চরণ দে।[9]

প্রিয় পাঠক! এই বিতর্কিত ব্যক্তির সকল বক্তব্য ছোট্ট প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। উল্লেখ না করার আরও কারণ হলো এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ শুনতে পারবে না। অভয়চরণ দে ধর্ষণ নিয়ে তার বই শ্রী ভাগবতমে বলেছেন, Although rape is not legally allowed, it is a fact that a woman likes a man who is very expert at rape. অর্থাৎ যদিও ধর্ষণ আইনত অনুমোদিত নয়, তবে বাস্তবতা হলো একজন মহিলা ধর্ষণে খুব পটু এমন পুরুষকে পছন্দ করেন।

প্রিয় পাঠক! এমন নানা কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের অভিযোগ আছে এই মস্তিষ্কবিকৃত অভয়চরণের ব্যাপারে। তাছাড়াও হিন্দুধর্মের স্বামী বিবেকানন্দকে তিনি রাস্কেল বলেছেন। হিন্দুধর্মের পণ্ডিত ঋষি অরবিন্দকে লক্ষ্য করে ঘৃণ্য কথা বলেছেন। নিজের গুরু রামকৃষ্ণ ও সারদাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেন অভয়চরণ দে।[10] সর্বোপরি এমন মস্তিষ্কবিকৃত মানুষের তৈরি ইসকন কেমন হতে পারে? প্রশ্নের উত্তরটি পুরো প্রবন্ধটি পড়ার পর পেয়ে যাবেন, ইন-শা-আল্লাহ!

ইসকন যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে:

১৯৬৬ সালে যখন ইসকন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন ইসকনকে কেউ চিনত না। প্রশ্ন আসতে পারে, ইসকন কীভাবে প্রথমে জনপ্রিয় হয়ে উঠে? সোজা উত্তরটা হলো ভারতীয় ধ্রুপদী সুরের সাথে পশ্চিমা সুরের তাল-লয় দিয়ে ভারতীয় কীর্তনকে শ্রুতিমধুর করা হয়। ষাটের দশকে পশ্চিমা শিল্পী জর্জ হ্যারিসন ও জন লেননের কণ্ঠে কয়েকটি কীর্তন বেজে উঠে। অবশ্য অভয়চরণ দের অনুরোধে তারা কীর্তনগুলো গায়। জর্জ হ্যারিসনের সুপারহিট অ্যালবাম ‘মাই সুইট লর্ড’ ও জন লেননের ‘গিভ পিস অ্যা চান্স’ অ্যালবামের সাথে হরে কৃষ্ণ লিরিক্স যোগ করা হয়। যার ফলে এই হরে কৃষ্ণ আমেরিকা ও ইউরোপে মুখে মুখে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তারপর ইসকনকে অনেকে হরে কৃষ্ণ মুভমেন্ট বলে।[11]

বিশ্বব্যাপী ইসকন:

উইকিপিডিয়ার ২০০৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ইসকনের ৫০,০০০টিরও বেশি মন্দির ও কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি খামার সংগঠন (কয়েকটি স্বনিযুক্তি প্রকল্পসহ), ৫৪টি বিদ্যালয় ও ৯০টি ভোজনালয় রয়েছে। বর্তমানে পূর্ব ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্য এশিয়া ও ভারত উপমহাদেশে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমি যদি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করি, তাহলে এভাবে বলা যায় যে, নেপালের কাঠমান্ডুতে ইসকন মন্দিরসহ সারা দেশে ৩৫টিরও অধিক বড় মন্দির রয়েছে। ইউরোপে ১৩৫টিরও বেশি মন্দির ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৫৬টি, দক্ষিণ আমেরিকায় ৬০টি, কানাডায় ১২টি, এশিয়া মহাদেশে ৮০টি, রাশিয়ায় ৩১টি, আফ্রিকায় ৬৯টি, অস্ট্রেলিয়ায় ৬টি, নিউজিল্যান্ডে ৪টি ও ভারতে ১৫৯টি মন্দির রয়েছে।

ইসকন বিশ্বব্যাপী কাজ করছে। এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বমঞ্চে ইসকনের গ্রহণযোগ্যতা কেমন? মাদক ব্যবহার, যৌন নির্যাতন, অর্থ আত্মসাৎ ও ভক্তদের অনুদান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশে ইসকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে। উল্লেখ্য, বিভিন্ন দেশে ইসকনের অঙ্গসংগঠন রয়েছে। যেমন- Food For Life এই সংগঠনটির মাধ্যমে ইসকন গরীব, দুস্থ ও শিশুদের সহযোগিতা করে থাকে।

১৯৭৬ সালে নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টে People Vs Murphy মামলায় ইসকন নিয়ে রায় দেওয়া হয়, হরে কৃষ্ণ মতবাদ একটি ভালো ধর্মীয় বিশ্বাস। মামলার রায় ইসকনের পক্ষে আসলেও মামলার বাদীদের অভিযোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ বলা যায়। ওই মামলায় দুজন মার্কিন নাগরিক আদালতে ইসকনের বিরুদ্ধে এই বলে অভিযোগ দায়ের করেন যে, ইসকনের ধর্মগুরুরা তাদের কোমলমতি শিশু-সন্তানদের ব্রেনওয়াশ করে প্রথমে তাদেরকে পরিবার থেকে আলাদা করেছে এবং পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত করেছে। ১৯৮৭ সালে আরেকটি মামলায় ইসকন নেতা কির্তানন্দের বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতে হত্যা মামলার চার্জ গঠন করা হয় এবং তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামী তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে বিরাট এক অপরাধী গ্যাং গড়ে তুলেছে, যাকে অপরাধবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় র‌্যাকেটারিং (Racketeering)। সত্তর ও আশির দশকে শিশু বলাৎকারের অভিযোগে ইসকনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সে মামলায় ইসকনকে ৯০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশী টাকায় ৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রায়) জরিমানা করা হয়। মামলাটি নিষ্পত্তি হয় ২০০৪ সালে। মামলার জরিমানা দিয়ে ইসকন নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে।[12] অন্যদিকে রাশিয়ার অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা ইসকনের সকল মন্দির ভেঙে ফেলেছে বলেও জানা যায়।[13]

গত ২৭ নভেম্বর ১০ আইনজীবীর পক্ষে আইনজীবী আল-মামুন রাসেল ইসকনকে নিষিদ্ধ সংগঠন করা নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে একটি আইনি নোটিশ প্রেরণ করেন। উক্ত নোটিশে বলা হয়, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সঊদী আরব, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমান রাশিয়া) ইসকনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও সিঙ্গাপুরে এটির কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হয় না। এছাড়া ইসকনের কর্মকাণ্ড তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান ও তুর্কেমেনিস্তানে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয় বলেও আইনি নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।[14]

প্রিয় পাঠক! এখানে মোটা দাগে বলতে হচ্ছে, ইসকন নিজেদের এনজিও দাবি করে বিশ্বের সব দেশে অবস্থান করছে। এখনো ইসকনের দাবি, ইসকন এনজিও টাইপের সংগঠন। যদিও আমরা আদর্শ দেখে ইসকনকে এনজিও সংগঠন বলতে পারছি না।

পঞ্চগব্যের নামে খাবারে গোমূত্র:

পঞ্চগব্য বলতে দুধ, ঘি, মাখন, গোমূত্র ও গোবর। ইসকনের তৈরি করা প্রতিটি খাবারে গোবর ও গোমূত্র থাকে। গরুর গোবর ও গোমূত্র সংরক্ষণের জন্য ইসকনের খামার রয়েছে।[15]

ইসকন এর বৃন্দাবন শাখার কয়েকটি ভিডিও ইউটিউবে ভাইরাল হয়। যে ভিডিওগুলোতে দেখা যায় যে, ইসকন ভক্তরা গোমূত্র গ্লাসে নিয়ে পান করছে। রয়টার্সের একটি ভিডিওতে ইসকনের এই বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। অন্য আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, টুথপেষ্ট উৎপাদনেও ইসকন গরুর মূত্র উপাদান হিসেবে ব্যবহার করছে।[16] অবশ্য এটাও বলতে হয়, পৃথিবীতে গরুর মূত্র বিতরণে ইসকন সেরা। ইসকনের ওয়েবসাইটে এই পঞ্চগব্য নিয়ে বলা আছে।[17]

www.goshala.com নামে একটি ওয়েবসাইট আছে। যে ওয়েবসাইট দিয়ে ইসকন গোবর ও গোমূত্র খেতে উৎসাহ দেয়। উৎসাহ দেওয়ার উপকরণ হিসেবে বলা যায়, সেই ওয়েবসাইটের বিভিন্ন গরুময় বিজ্ঞাপন। ইসকনের পঞ্চগব্য নিয়ে আপনার অবিশ্বাস হতে পারে। তাই আপনি চাইলে গুগলে সার্চ দিতে পারেন, Cow Urine ISCKON. তারপর ইসকন থেকে ভেসে ওঠা আর্টিকেল কিংবা যেকোনো আর্টিকেল পড়ুন। ইংরেজি না পড়তে পারলে বাংলা করে পড়ুন। দেখুন, গোবর ও গোমূত্র নিয়ে কেমন উৎসাহ তারা দিচ্ছে! তাই বলা চলে ইসকন যেসব খাবার শিশু ও দুস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দিচ্ছে, সেসব খাবারে পঞ্চগব্য থাকার পর্যাপ্ত সন্দেহ রয়েছে।

বাংলাদেশে ইসকন:

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ইসকনের পদযাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় ইসকনের মন্দির রয়েছে। সাউথ এশিয়া মনিটর নামের একটি গণমাধ্যমে বেশ কয়েক বছর আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ইসকনের স্থায়ী সদস্য ছিল ১৯০০ জন। ২০১৯ সালে আওয়ামী সরকারের আমলে ইসকনের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫০০। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে মন্দির ছিল ৩৫টি। আওয়ামী সরকারের আমলে ইসকনের মন্দির হয় ৭১টি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইসকনকে নিয়ে করা প্রতিবেদনটি সরিয়ে ফেলে সাউথ এশিয়া মনিটর।[18]

১৯৭৫ সালে আয়ারল্যান্ডের একজন নাগরিক ও কানাডার দুজন নাগরিক ইসকনের কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশে আসেন। ঢাকার তেজকুনিয়া পাড়ায় তারা কার্যক্রম শুরু করেন। তৎকালীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য তারা স্থায়ী হতে পারেনি। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে আবারও ইসকনের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে তারা তেজকুনিয়া পাড়ায়, পরে ঢাকার ওয়ারী ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে মন্দির স্থাপন করে। উল্লেখ্য, ইসকনের প্রভাবের ফলে হাটহাজারীতে একটি গ্রামের নাম রাখা হয় ‘ইসকন নগর’।[19] অবশ্য এটাও বলতে হয়, ইসকন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা করে ১৯৯০ সালে।[20]

১৯৭৮ সালের Foreign Donations এবং ১৯৮২ সালের Foreign Contributions আইন বাতিল করে ‘রেজুলেশন অ্যাক্ট-২০১৬ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। সেই আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ইসকনকে বৈধতা দিয়েছে।[21]

খ্রিষ্টান মিশনারিদের মতো সনাতনী হিন্দুদের মন্দির দখল করার পায়তারা করছে ইসকন। বাংলাদেশে সনাতনী হিন্দুদের বিভিন্ন মন্দির জোরপূর্বক দখল করার অভিযোগ উঠে ইসকনের বিরুদ্ধে। চট্রগ্রামে সনাতনী হিন্দুদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন প্রবর্তক সংঘের সাথে ইসকনের হতাহতের ঘটনা ঘটে।

প্রবর্তক সংঘের সাধারণ সম্পাদক তিনকড়ি চক্রবর্তী বলেন, তারা প্রবর্তকের কর্মীদের ওপর যে হামলা করেছে, তা ‘সাধুবেশে সন্ত্রাসী’ কার্যক্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। শুধু সনাতনীরা নয়, বরং কোনো ধর্মের মানুষ এমন উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড সমর্থন করতে পারে না। আমরা এর বিরুদ্ধে গণসংযোগ করব।[22]

প্রিয় পাঠক! এবার স্বাধীন বাংলাদেশে ইসকনের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা পেশ করা হবে।

বাংলাদেশের আলোচনায় ইসকন:

৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে স্বাধীনতা স্তম্ভে চট্টগ্রামের ছাত্র-জনতা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। তারপর বাংলাদেশের পতাকার উপর গেরুয়া রঙের পতাকা লাগায় ইসকন। পতাকা অবমাননার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করেন ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান। উক্ত মামলায় ইসকনের ১৯ জন সদস্যকে আসামী করা হয়। উল্লেখ্য, মামলার বাদি ফিরোজ আলমকে ইসকনের বিরুদ্ধে মামলা করায় বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়।[23] রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনের বিষয়ে তার অনুসারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গনে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ নিহত হয়।[24] ইসকন সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন মিডিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নিউজ করেছেন। সেক্ষেত্রে দেশীয় মিডিয়ার কথা বললে বলতে হয় প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও সময় টিভি। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কথা বলতে গেলে রয়টার্সের কথা বলতে হয়।[25]

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে ইসকনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও এই প্রথম নযিরবিহীন আন্দোলন হচ্ছে, লেখালেখি হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠন থেকে ইসকনের বিরুদ্ধে বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ইসকনের সমালোচিত বিষয়গুলো একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির কারণে ভাইরাল হয়ে উঠেছে।

(ইনশা-আল্লাহ! আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

ইবনু মাসউদ

 সহকারী পরিচালক, তামীরুল মিল্লাত সাহিত্য ফোরাম, টঙ্গী, গাজীপুর।


[1]. এস সুমন, ইসকন বিতর্ক (প্রকাশকাল: ২০২০, প্রকাশনী: এস এস প্রকাশন), পৃ. ৮০।

[2]. এ বিষয়ে হিন্দু সকল ধর্মগ্রন্থে আলোচনা আছে। এটা স্বাভাবিক এবং মৌলিক বিষয়।

[3]. দৈনিক ইনকিলাব, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪।

[4]. ইসকন বিতর্ক, পৃ. ৫৩।

[5]. প্রাগুক্ত।

[6]. দৈনিক ইনকিলাব, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪।

[7]. উইকিপিডিয়া।

[8]. ‘ইসকন বিতর্ক’ বইয়ের এই পৃষ্ঠাগুলোতে হিন্দুধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক সকল তথ্য পাওয়া যাবে— পৃ. ১৭, ৫৩, ৬৮, ৭১, ৭২, ৮০, ৮১, ৮৪, ৮৫, ১১৭, ১১৮, ১২১, ১২৪, ১৫০।

[9]. Woman does not have more than thirty-six ounce of brain substance, whereas in man it has been found that he has got up to sixty-four ounce. Now, this is modern science. Therefore generally, generally, woman, less intelligent than man. You cannot find any big scientist, any big mathematician, any big philosopher amongst woman. That is not possible. Although in your country, you want equal status with man, freedom, but by nature you are less intelligent. What can be done? (laughter).

[10]. ইসকন বিতর্ক, পৃ. ৫৭, ৬৮, ৭৯, ১০৫, ১০৭, ১০৮, ১০৯, ১১০, ১১১, ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১৫, ১১৬, ১২২, ১৪৬, ১৪৭।

[11]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১২।

[12]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।

[13]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩১।

[14]. দৈনিক নয়াদিগন্ত, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪।

[15]. এস সুমন, ইসকন বিতর্ক, পৃ. ১২৫।

[16]. এই ড্রাইভ লিংকে ক্লিক করে দেখুন: ইসকনের সেই ভিডিওটি https://drive.google.com/drive/folders/1Cimc6n68RiyXp8CW-a8kb8ikmg37cbWE

[17]. এস সুমন, ইসকন বিতর্ক, পৃ. ১৩২।

[18]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩৩।

[19]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬।

[20]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫০।

[21]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪১, ৪৩, ৫০।

[22]. দৈনিক ইনকিলাব, ২৩ মার্চ, ২০২১।

[23]. দৈনিক ইনকিলাব, ১ নভেম্বর, ২০২৪।

[24]. দৈনিক সমকাল, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪।

[25]. রয়টার্স, ২৭ নভেম্বর, ২০২৪। লিংক: https://www.reuters.com/world/asia-pacific/bangladesh-police-us-teargas-against-hindu-protesters-2024-11-26/?fbclid=IwY2xjawG86LZleHRuA2FlbQIxMQABHQ8eoKiCZI4sskwSi0-SBRXUvXwXKm22iJNbNhLiPBvqLq4o58t0dIXLgg_aem_HxB9J7cWpeuSfsv0sUOvOw

Magazine