জেরুযালেম যুদ্ধের অস্বীকৃতি ও আল্লাহর আযাব: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন,يَا قَوْمِ ادْخُلُوا الْأَرْضَ الْمُقَدَّسَةَ الَّتِي كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَلَا تَرْتَدُّوا عَلَى أَدْبَارِكُمْ فَتَنْقَلِبُوا خَاسِرِينَ - قَالُوا يَا مُوسَى إِنَّ فِيهَا قَوْمًا جَبَّارِينَ وَإِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا حَتَّى يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا فَإِنَّا دَاخِلُونَ - قَالَ رَجُلَانِ مِنَ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمَا ادْخُلُوا عَلَيْهِمُ الْبَابَ فَإِذَا دَخَلْتُمُوهُ فَإِنَّكُمْ غَالِبُونَ وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর ক্বওমকে বলছেন, ‘হে আমার জাতি! সেই পবিত্র জমিনে প্রবেশ করো, যেটা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে রেখেছেন। আর তোমরা পিছনে ফিরে যেয়ো না। অন্যথা তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ফিরে যাবে। তখন তারা বলল, হে মূসা, সেখানে অত্যাচারী নিষ্ঠুর জাতি রয়েছে। আমরা সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। তখন তাদের মধ্যকার আল্লাহকে ভয় করে এমন দুই জন লোক, যাদের উপর আল্লাহ তাদের দয়া করেছেন, তারা বলল, তোমরা এই শহরে প্রবেশ করো! যদি তোমরা এই শহরে প্রবেশ করো, তোমরাই বিজয়ী হবে। আর তোমরা ভরসা করো একমাত্র আল্লাহর উপর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো’ (আল-মায়েদা, ৫/২১-২৩)।
যুদ্ধের জন্য শুধু যেই দুই জন ঈমানদার ব্যক্তি রাজি হয়েছিলেন তারা হচ্ছেন, তাঁর ছোট ভাই হারূন আলাইহিস সালাম এবং তাঁর শিষ্য ইউশা ইবনু নূন। শুধু তারা দুইজনই যুদ্ধ করে বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করতে রাজি হয়েছিলেন।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,قَالُوا يَامُوسَى إِنَّا لَنْ نَدْخُلَهَا أَبَدًا مَا دَامُوا فِيهَا فَاذْهَبْ أَنْتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلَا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُونَ ‘তারা বলল, হে মূসা! এই শক্তিশালী জাতি যতক্ষণ সেখানে থাকবে ততক্ষণ আমরা সেখানে যাব না। অতএব, তুমি ও তোমার প্রতিপালক গিয়ে যুদ্ধ করো। আমরা এখানেই বসে থাকছি’ (আল-মায়েদা, ৫/২৪)।
তাদের এই উত্তর শুনে মূসা আলাইহিস সালাম হতাশ হয়ে আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ! আমি আমার ও আমার ভাইয়ের ব্যতীত অন্য কারও যিম্মাদারী নিতে পারছি না। তখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা গযবস্বরূপ বললেন,قَالَ فَإِنَّهَا مُحَرَّمَةٌ عَلَيْهِمْ أَرْبَعِينَ سَنَةً يَتِيهُونَ فِي الْأَرْضِ فَلَا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ ‘আমি এই পবিত্র ভূমি (জেরুযালেম ও বায়তুল মুকাদ্দাস) তাদের জন্য ৪০ বছরের জন্য হারাম করে দিলাম। এখন তারা উদ্ভ্রান্তের মতো এই সিনাই মরুভূমিতে ঘুরপাক খেতে থাকবে’ (আল-মায়েদা, ৫/২৬)। এই আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, জেরুযালেম থেকে বঞ্চিত হওয়াও এক প্রকারের আল্লাহর গযব। তাই উম্মাতে মুহাম্মাদীকে অতি দ্রুত সংশোধন হওয়া উচিত।
জেরুযালেম বিজয় করতে না পারায় মূসা আলাইহিস সালাম-এর আক্ষেপ: জেরুযালেমে প্রবেশের জন্য মূসা আলাইহিস সালাম-এর মনে এতটাই উদগ্র বাসনা ছিল এবং জেরুযালেমে প্রবেশ করতে না পারার বেদনা তার হৃদয়ে এতটাই গভীর ছিল যে, তিনি মৃত্যুর পূর্বে মহান আল্লাহর নিকট প্রর্থনা করেছিলেন যেন তার মৃত্যু জেরুযালেমের অতি নিকটে হয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, فَسَأَلَ اللّٰهَ أَنْ يُدْنِيَهُ مِنَ الأَرْضِ المُقَدَّسَةِ رَمْيَةً بِحَجَرٍ ‘আর মূসা আলাইহিস সালাম মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন যেন মহান আল্লাহ তাকে জেরুযালেমের পবিত্র ভূমি থেকে ঢিল নিক্ষেপের দূরত্বে মৃত্যু দান করেন’।[1] রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘আমি যদি আজ সেখানে থাকতাম তাহলে মূসা আলাইহিস সালাম-এর কবর তোমাদের দেখিয়ে দিতাম’।[2]
জেরুযালেম বিজয়ের জন্য মহান আল্লাহ সূর্যকে থামিয়ে দিলেন: মূসা আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর পর বানূ ইসরাঈলের দায়িত্ব পান তারই শিষ্য ইউশা ইবনু নূন। ৪০ বছরের আল্লাহর আযাব শেষ হলে তিনি তাদেরকে নিয়ে জেরুযালেম বিজয় করার জন্য রওনা দেন। যুদ্ধ শুরু হয়। প্রবল যুদ্ধের এক পর্যায়ে শুক্রবারের দিন বিকেল বেলা তারা যুদ্ধ জয়ের অতি নিকটে পৌঁছে যায়। কিন্তু তাদের দ্বীনের বিধান ছিল শনিবারের পবিত্র দিনে যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ থাকবে। আর শুক্রবার দিনের সূর্য ডুবে গেলে শনিবার শুরু হয়ে যাবে এবং তারা এই যুদ্ধ আর চলমান রাখতে পারবে না। তখন ইউশা ইবনু নূন মহান আল্লাহর নিকট দু‘আ করলেন এবং সূর্যকে লক্ষ্য করে বললেন, إِنَّكِ مَأْمُورَةٌ وَأَنَا مَأْمُورٌ، اللَّهُمَّ احْبِسْهَا عَلَيْنَا ‘হে সূর্য! তুমি আল্লাহর আদেশে আদিষ্ট আর আমিও আল্লাহর আদেশে আদিষ্ট। হে আল্লাহ! আপনি এই সূর্যকে আমাদের জন্য থামিয়ে দিন’।[3]
অতঃপর মহান আল্লাহ পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো সূর্যকে থামিয়ে দিলেন। শুধু জেরুযালেম বিজয় সম্পন্ন করতে দেওয়ার জন্য। আল্লাহু আকবার! রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,إِنَّ الشَّمْسَ لَمْ تُحْبَسْ عَلَى بَشَرٍ إِلاَّ لِيُوشَعَ لَيَالِىَ سَارَ إِلَى بَيْتِ الْمَقْدِسِ ‘সূর্য কখনো কোনো মানুষের জন্য থেমে যায়নি, একমাত্র ইউশা ইবনু নূনের জন্য কিছু সময় ছাড়া— যখন তিনি বায়তুল মাক্বদিস বিজয় করতে অগ্রসর হয়েছিলেন’।[4]
জেরুযালেম বিজয় ও বানূ ইসরাঈলের নিমকহারামি: ইউশা বিন নূনের জেরুযালেম বিজয়ের পরেও বানূ ইসরাঈলের নিমকহারামির স্বভাব পরিবর্তন হয়নি। এমনকি দীর্ঘ ৪০ বছরের আযাব শেষে সূর্যকে থামিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহ যে জেরুযালেমকে বিজয় করার সুযোগ ও তাওফীক্ব দিলেন, সেই জেরুযালেমে বিজয়ী অবস্থায় প্রবেশের সময় মহান আল্লাহ তাদেরকে শুকরিয়া আদায়ের আদেশ দিলেন। শুকরিয়া আদায়স্বরূপ মাথা নিচু করে সিজদার মতো করে তাদেরকে শহরে প্রবেশ করতে বললেন। প্রবেশ করার সময় মাথা নিচু করে মুখে মহান আল্লাহর ইস্তেগফার পাঠ করার আদেশ দিলেন। কিন্তু এত বড় বিজয়ের পরও তারা মহান আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল এবং আল্লাহর শেখানো ইস্তেগফারের যিকিরকে বিকৃত করল। এই বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন,وَإِذْ قُلْنَا ادْخُلُوا هَذِهِ الْقَرْيَةَ فَكُلُوا مِنْهَا حَيْثُ شِئْتُمْ رَغَدًا وَادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَقُولُوا حِطَّةٌ نَغْفِرْ لَكُمْ خَطَايَاكُمْ وَسَنَزِيدُ الْمُحْسِنِينَ ‘আর যখন আমরা তাদেরকে বললাম, ‘তোমরা এই শহরে প্রবেশ করো এবং প্রভূত রিযিক্ব স্বাচ্ছন্দে গ্রহণ করো। আর তোমরা শহরের দরজায় প্রবেশের সময় সিজদা অবস্থায় প্রবেশ করো এবং মুখে বলো হিত্তা (হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন)। তাহলে আমরা তোমাদের গুনাহগুলোকে ক্ষমা করে দিব আর আমরা মুহসিনদের আরো বেশি বাড়িয়ে দিব’ (আল-বাক্বারা, ২/৫৮)। মহান আল্লাহর এই আদেশ অমান্য করে তারা কী করেছিল তাও তিনি পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,فَبَدَّلَ الَّذِينَ ظَلَمُوا قَوْلًا غَيْرَ الَّذِي قِيلَ لَهُمْ فَأَنْزَلْنَا عَلَى الَّذِينَ ظَلَمُوا رِجْزًا مِنَ السَّمَاءِ بِمَا كَانُوا يَفْسُقُونَ ‘অতঃপর যারা যুলুম করেছে তারা আদিষ্ট সেই কথা পরিবর্তন করে অন্য কথা বলেছিল। অতঃপর যারা অন্যায় করেছে, তাদের পাপাচারিতার কারণে আমরা তাদের উপরে আসমান থেকে অপমানজনক শাস্তি অবতীর্ণ করেছি’ (আল-বাক্বারা, ২/৫৯)।
‘হিত্তাতুন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন। যেমন আমরা আরবীতে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলি। তেমনি হিব্রুতে হিত্তাতুন। বানূ ইসরাঈলেরা হিত্তাতুনের পরিবর্তে ‘হাব্বাতুন ফী শা‘রতিন’ (চুলের মাঝে একটি দানা, অর্থাৎ নিরর্থক একটি কথা দ্বারা পরিবর্তন করে) বলেছিল। আর তারা শহরে প্রবেশ করার সময় মাথা নিচু করে প্রবেশ না করে সম্পূর্ণ তার বিপরীতভাবে প্রবেশ করেছিল। তারা নিতম্বের উপর ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে শহরে প্রবেশ করে।[5]
এই কারণেই আমাদের নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন সেই দিন তিনি মক্কার উঁচু দিক থেকে মক্কায় এতটা অবনত মস্তকে প্রবেশ করেছিলেন, এসময় তাঁর থুতনি বাহনের সাথে লেগেছিল।[6]
দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর জীবনে জেরুযালেম: বানূ ইসরাঈলের এই নিমকহারামির কারণে তারা বারবার গযবের শিকার হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদেরকে আমালেকা গোত্রের জুলিয়েট (জালূত) নামক অত্যাচারী শাসককে তাদের ওপর চাপিয়ে দেন এবং জুলিয়েট শাসক পুরো জেরুযালেম দখল করে নেয় আর বনী ইসরাঈলের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালায়। বাদশাহ জালূত তাদেরকে জেরুযালেম থেকে বিতাড়িত করে দেয়। তারা ঘরছাড়া হয়ে পুনরায় উদভ্রান্তের মতো জীবনযাপন শুরু করে। ঘরছাড়া এই জীবনযাপনে ক্লান্ত হয়ে তারা পুনরায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে চায়। তাওবা-ইস্তেগফার করে পরিপূর্ণ মুমিন হয়ে যেতে চায়। এই মর্মে তারা তৎকালীন নবী স্যামুয়েলের নিকট গমন করে। নবীর নাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনে নেননি, কিন্তু তিনি সেই নবীর কথা পবিত্র কুরআনে বলেছেন। তবে তাওরাত, ইঞ্জীলে সেই নবীর নাম স্যামুয়েল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেউ কেউ সেই নবীর নাম ইউশা বিন নূন বলেছেন, কিন্তু সেটা সঠিক নয়।[7]
এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সূরা আল-বাক্বারার ২৪৬-২৪৮ নং আয়াতে বলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الْمَلَإِ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ بَعْدِ مُوسَى إِذْ قَالُوا لِنَبِيٍّ لَهُمُ ابْعَثْ لَنَا مَلِكًا نُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ هَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ أَلَّا تُقَاتِلُوا قَالُوا وَمَا لَنَا أَلَّا نُقَاتِلَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَدْ أُخْرِجْنَا مِنْ دِيَارِنَا وَأَبْنَائِنَا فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ تَوَلَّوْا إِلَّا قَلِيلًا مِنْهُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِينَ - وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللَّهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكًا قَالُوا أَنَّى يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِنَ الْمَالِ قَالَ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ وَاللَّهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ - وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ التَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِمَّا تَرَكَ آلُ مُوسَى وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلَائِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: অত্যাচারে ক্লান্ত হয়ে বানূ ইসরাঈলেরা তৎকালীন নবী স্যামুয়েলের নিকট আবদার জানায় যে, আপনি আমাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন একটি শাসকের ব্যবস্থা করে দিন, যেই শাসকের মাধ্যমে আমরা এই অত্যাচারী শাসকের কবল থেকে মুক্তি পাব এবং পুনরায় বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুযালেমে আবার সেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। এই অকৃতজ্ঞ ক্বওমের কথা নবী খুব ভালোভাবেই জানতেন। তাই তিন তাদের পালটা জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদেরকে বাদশাহ প্রদান করা হলে যে তোমরা জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না, তার কী নিশ্চয়তা রয়েছে? নবীর এই কথার উত্তরে বানূ ইসরাঈল বলল, আমরা কেন জিহাদ করব না বা কিতাল করব না, যেখানে আমরা আমাদের বাড়িঘর ও সন্তানাদি থেকে বিতাড়িত হয়েছি, অত্যাচারিত-নির্যাতিত হয়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের জন্য তালূতকে বাদশাহ হিসেবে পাঠালেন, তাদের উপরে সত্যিকারেই জিহাদের নির্দেশ জারি করা হলো বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করার জন্য, তখন তাদের অধিকাংশ মানুষই মুখ ফিরিয়ে নিল। পুনরায় তাদের চরিত্রের আসল রূপটা ফুটে উঠল। শুধু তাই নয়, তারা তালূতের বাদশাহ হওয়া নিয়ে নবীর সামনে প্রশ্ন উত্থাপন করল। বানূ ইসরাঈল নবীকে বলল, ‘কীভাবে তালূত বাদশাহ হতে পারে? অথচ আমরা তাঁর চাইতে বাদশাহ হওয়ার বেশি যোগ্য। তালূত তো অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র। আর আমরা সমাজের ধনী ও প্রভাবশালী। সেখানে আমরা রাজা-বাদশাহ না হয়ে তালূত কীভাবে রাজা-বাদশাহ হয়’। উত্তরে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাদের নবীকে বলে দিলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাই তাকে তোমাদের জন্য চয়ন করেছেন এবং তাকে জ্ঞানে ও শারীরিক ক্ষমতায় তোমাদের চাইতে বেশি দান করেছেন। সুতরাং সেই তোমাদের রাজা হওয়ার যোগ্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রাজা হওয়ার যোগ্যতার জন্য শারীরিক সক্ষমতা এবং জ্ঞানকে এখানে মানদণ্ড হিসেবে, মাপকাঠি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। বানূ ইসরাঈলের বিশ্বস্ততা অর্জন করার জন্য তাদের নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের বাদশাহ হওয়ার আল্লাহ প্রদত্ত নিদর্শন হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তোমাদেরকে তোমাদের হারানো সিন্দুক ফিরিয়ে দেবেন। আর এটাই তালূতের সত্য বাদশাহ হওয়ার প্রমাণ। মুফাসসিরীনে কেরাম তাবূতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তাবূত হচ্ছে ঐ বাক্স, যে বাক্সে মূসা আলাইহিস সালাম ও হারূন আলাইহিস সালাম-এর লাঠি, জামা, জুতা প্রভৃতি কিছু নবুঅতী মু‘জেযা ঐ বাক্সের মধ্যে সংরক্ষিত ছিল যেটাকে বানূ ইসরাঈল বরকতময় মনে করত এবং বিভিন্ন জিহাদে, যুদ্ধের মাঠে তারা সেটাকে সাথে করে নিয়ে যেত। কিন্তু যখন যালেম বাদশাহ জুলিয়েট বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুযালেম দখল করে, তখন সে সিন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। তাই এই সিন্দুক ফিরে পাওয়াটাকে বানূ ইসরাঈল নিজেদের জন্য অনেক বড় কল্যাণের কারণ হিসেবে মনে করত। সেজন্য তালূতের বিষয়ে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে তাদের নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের বাদশাহ হওয়ার নিদর্শন হলো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সেই তাবূত পুনরায় তোমাদের মাঝে ফিরিয়ে দেবেন।
এরপর তালূত বাদশার নেতৃত্বে বানূ ইসরাঈলের একটি দল জেরুযালেম বিজয় করার জন্য রওয়ানা দিলেন। সেই বিজয়াভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে সূরা আল-বাক্বারার ২৪৯-২৫১ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوتُ بِالْجُنُودِ قَالَ إِنَّ اللَّهَ مُبْتَلِيكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّي إِلَّا مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوا مِنْهُ إِلَّا قَلِيلًا مِنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ قَالُوا لَا طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو اللَّهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ - وَلَمَّا بَرَزُوا لِجَالُوتَ وَجُنُودِهِ قَالُوا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ - فَهَزَمُوهُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوتَ وَآتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَاءُ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ
ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ: যখন তালূত তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওয়ানা দিলেন। তখন সেই সেনাবাহিনীতে দাঊদ আলাইহিস সালামও ছিলেন। তখন দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর বয়স মাত্র ২০ বছর। মহান আল্লাহ যুদ্ধের আগে বানূ ইসরাঈলকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তালূত তার সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। সামনে একটি নদী আছে। তোমাদের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি এই নদীর পানি পান করবে, সে পরীক্ষায় ফেল করবে; সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। আর যে নদীর পানি পান করবে না, সে পরীক্ষায় পাশ করবে এবং একমাত্র তারাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে। অধিকাংশ বনী ইসরাঈল এই পরীক্ষায় ফেল করল। নদীর পানি পান করে নিল। পিপাসায় ধৈর্যধারণ করতে পারল না। মুফাসসিরীনে কেরাম এবং ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, ৮০ হাজার সৈন্যের মাঝে মাত্র ৩১৩ জন সৈনিক সেই দিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পরীক্ষায় পাশ করে পানি পান না করেই সাঁতরে নদী পার হয়ে দুর্বল, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় শক্তিশালী জুলিয়েটবাহিনীর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
নদী পার হওয়ার পর বিশাল জালূতবাহিনীকে দেখামাত্র ৩১৩ জন হতবিহ্বল হয়ে যায়। তারা বলল, এত বিশাল বাহিনীর সাথে আমরা এত অল্প সংখ্যক এত ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় কেমনে যুদ্ধ করব। তখন তাদের মধ্যে যারা আল্লাহওয়ালা পরহেযগার ছিলেন তারা বললেন, যুগে যুগে মহান আল্লাহ কত ছোট দলকে কত বড় দলের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন। অতএব, আমাদের ধৈর্য ধরা উচিত।
তারপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজে হাতে জালূতকে হত্যা করলেন। পূনরায় জেরুযালেম বিজয় হলো। এরপর মহান আল্লাহ দাঊদ আলাইহিস সালাম-কে নবী করে দিলেন। তাঁকে বিশাল রাজত্ব দান করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুযালেমকেন্দ্রিক সবচেয়ে শক্তিশালী যে সামাজ্য গড়ে উঠেছিলে সেই সাম্রাজ্যের স্থপতি দাঊদ আলাইহিস সালাম, যেটার রাজধানী বা হেডকোয়াটার ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুযালেম।
(চলবে)
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৩৯।
[2]. প্রাগুক্ত।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১২৪।
[4]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮২৯৮।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/২২৫৯।
[6]. হাফেয যাহাবী, তারীখুল ইসলাম, ২/৫৪৮।
[7]. তাফসীর ইবনু কাছীর, সূরা আল-বাক্বারা, ২/২৪৬-২৪৮-এর তাফসীর দ্রষ্টব্য।