কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

জেরুযালেম ও বায়তুল ‍মুক্বাদ্দাস: ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা (শেষ পর্ব)

post title will place here

শান্তির ললিতবাণী প্রচারকরা কোথায়?

সন্ধ্যার মৃদুমন্দ হাওয়ায় ঘুমাতে যাওয়া আর পাখির কোলাহলে আনন্দঘন পরিবেশে ঘুমজাগা শিশুটি যখন নিমিষেই হচ্ছে পিতৃহারা, মায়েরা হচ্ছে সন্তানহারা, স্ত্রীরা হচ্ছে স্বামীহারা; পিতৃহারা সন্তানের বুকফাটা আর্তনাদ, স্বামীহারা বিধবার গগণবিদারী চিৎকার, সন্তানহারা পিতার শোকের মাতম যখন পৃথিবীর আকাশ-বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলেছে, সকলের অলক্ষ্যে নির্যাতিত বান্দার আর্তচিৎকারে আল্লাহর আরশও যেন কেঁপে উঠেছে, সমগ্র পৃথিবী যখন এ গণহত্যায় শোকে মূহ্যমান সেই মুহূর্তেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্লজ্জভাবে উল্টো সহায়হীন ফিলিস্তীনীদের দায়ী করে বিষোদগার করেন। অন্যদিকে শপথ না নেওয়ার ঠুনকো অজুহাতে চুপটি মেরে ঠিকই বসে ছিলেন তথাকথিত ‘পরিবর্তন’ এর বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

শান্তির বার্তাবাহক (!) তকমা লাগিয়ে এই আমেরিকাই আবার পৃথিবীব্যাপী শান্তি ও নিরাপত্তার দারস দিয়ে যাচ্ছে। শিশু ও নারীর অধিকারের পক্ষে অবিরাম বুলি আওড়াচ্ছে। অথচ দীর্ঘ ৬২ বছর যাবৎ ফিলিস্তীনের বুকে যে অন্তহীন কান্নার প্রস্রবণ বয়ে চলেছে, তা তাদেরকে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটে না। পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে সবসময় সোচ্চারভাবে প্রচারিত হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে তথাকথিত নারী নির্যাতনের কাহিনী। কিন্তু ইসরাঈলের প্রকাশ্য লোমহর্ষক নারকীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছে। হাজারো মানবাধিকারবাদী, নারীবাদী, প্রাণীবাদী সংস্থা যারা দেশে দেশে মানব-প্রাণিকুল নির্যাতনের চিত্র সন্ধানে হয়রান হয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের কাছেও ফিলিস্তীনী নারী ও শিশুর বুকফাটা আর্তনাদ কোনোই প্রভাব ফেলে না। তবে কি মুসলিম নারী ধর্ষণ মানবতাবিরোধী কাজ নয়? মুসলিমদের উপাসনাস্থল ধ্বংস করা কি ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ন করা নয়? নিরীহ মুসলিমদের হত্যা করা কি গণহত্যা নয়? কেন শান্তির ললিতবাণী প্রচারকরা এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকে? কেন তাদের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের হুংকার সেখানে স্তব্ধ হয়ে যায়? এভাবেই কেবল আপন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরগরম গণতন্ত্র, শান্তি ও নিরাপত্তার ভড়ংধারী এই রাষ্ট্রগুলো মুসলিম বিশ্বের উপর চালিয়ে যাচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক নীরব গণহত্যা।

মুসলিম বিশ্বের নীরবতা : গাযার নিরীহ নির্যাতিত সম্বলহারা ভাইয়ের বুকফাটা আর্তনাদ যখন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে মুসলিমদের চক্ষুকে অশ্রুসিক্ত করছে, তখন মুসলিম বিশ্বের শাসকদের কাপুরুষোচিত নীরবতা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! বিশেষ করে আরব বিশ্ব পাশ্চাত্যের সুবোধ তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আজ মুসলিম বিশ্বের শাসকগণ ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদেরকে পরম শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে তাদের মনোরঞ্জনে নিয়োজিত রয়েছে। যে মুহূর্তে পবিত্র বায়তুল আক্বছায় ইয়াহূদীদের সিনাগগ তৈরি হচ্ছে, মুসলিম ভাইদের উপর অকথ্য যুলম-নির্যাতন চালানো হচ্ছে, তাদেরকে মরু বিয়াবানে শিয়াল-কুকুরের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, প্রতিবাদ করতে গেলে বুলেট-বোমায় বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, ট্যাংকের চাকায় পিষে মারছে, উদ্বাস্তু শিবির গুড়িয়ে দিচ্ছে, পাইকারিভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে; সেই মুহূর্তে আমাদের কাপুরুষ, হীন নেতাদের উপদেশবাণী (?) হলো ওদের হাতে পারমাণবিক বোমা আর মিসাইল, আকাশে ওদের একচ্ছত্র আধিপত্য, দরিয়ায় তাদের সুবিশাল নৌবহর, জমিনে ওদের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, দুনিয়াটা ওরা নিমিষে খতম করে দিতে পারে, ওদের মোকাবেলা করতে গিয়ে খামোখা তাজাপ্রাণ, মাল-সম্পদ নষ্ট করে লাভ কী?

হে কাপুরুষ মুসলিম শাসক! ঐ শোনো ধর্ষিতা বোনের কান্না। ঐ শোনো ইয়াতীম শিশুর বুকফাটা আহাজারি। শোনো ঐ আশ্রয়হীন ছিন্নমূল লাখো দুস্থ, দুর্গত, নির্যাতিত, নিগৃহীত মুসলিম ভাইয়ের ক্রমাগত আর্তনাদ। শোনো ঐ ক্ষুধার্ত বুভুক্ষু মা-বোনদের আর্তচিৎকার। ওরা যাবে কোথায়? খাবে কী? ওদের অশ্রুসিক্ত নয়ন তো তোমাদের পানে চেয়ে আছে। বলো কী করবে?

আশ্রয়হীন ক্রন্দনরত নারী-শিশুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত-মাংস, অস্থিমজ্জা একাকার করে দেওয়ার পর শাসকদের এই যখন অবস্থা। এইভাবে এক গালে চড় মারার পর আরেক গাল পেতে দেওয়ার দৃশ্যে মহা গদগদ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবার কেবল চড়-থাপ্পড় নয়, জোড়া পায়ে লাথি মারতে শুরু করেছে। এই সুযোগে কেবল গাযা-পশ্চিম তীর নয়, ইরাক-আফগানকে একসাথে ধুলায় মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসীরা। মানবতার অধিকার ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং শান্তি, নিরাপত্তা ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে বিশ্বসংস্থার জন্ম, সেই জাতিসংঘে মুসলিম শাসকদের মহামান্য গুরু আমেরিকা ইসরাঈলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাবও যখন পাশ করতে দেয় না, তবুও কেন আমেরিকার কদমবুসি করে চলতে হবে? ১৫৫ কোটি মুসলিম আর কতকাল এভাবে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে অসহায় হয়ে চেয়ে থাকবে? কতকাল আর হাত-পা গুটিয়ে শির নুইয়ে অশ্রুপাত করবে?

সমাধান কোন পথে?

ফিলিস্তীন-ইসরাঈল সমস্যার সমাধান হতে পারে দুইভাবে— শান্তিপূর্ণ সমাধান অথবা রক্তক্ষয়ী সমাধান।

শান্তিপূর্ণ সমাধান: শান্তিপূর্ণ সমাধানের নামে ফিলিস্তীনীরাও বাধ্য হয়ে আমেরিকার দেওয়া রোডম্যাপ অনুযায়ী যে প্রস্তাব মেনে নিয়েছে তা হলো দ্বি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ। কিন্তু এই সমাধানেও কয়েকটি বাধা রয়েছে। তা হলো জেরুযালেমকে রাজধানী বানানো নিয়ে। ইসরাঈল ও ফিলিস্তীন উভয়েই চায় জেরুযালেমকে রাজধানী বানাতে এবং বায়তুল আক্বছাকে নিজেদের অধীনে রাখতে। এছাড়া আরেকটি বড় বাধা সৃষ্টি করছে ইসরাঈল। তারা প্রস্তাব অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালের সীমানায় ফিরে যাওয়া তো দূরে থাক বরং দখলকৃত স্থানে আরো বসতি স্থাপন করছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো আমেরিকা-ইউরোপ যদি ইসরাঈলের প্রতি এতই দরদি হয়, তাহলে নিজের ঘরে জায়গা দিচ্ছে না কেন? কেন অন্যায়ভাবে রক্তগঙ্গা বইয়ে অপরের জমি দখল করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে শান্তির বাণী প্রচারকদের? ফিলিস্তীনে সত্যিই কি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্বেগ তাদের রয়েছে?

রক্তক্ষয়ী সমাধান: এই পৃথিবীর প্রতিটি সচেতন মানুষ জানে যে, ফিলিস্তীন ফিলিস্তীনীদেরই। ইসরাঈল ও বর্তমান ফিলিস্তীন পুরোটাই দশ সহস্রাধিক বছরের ঐতিহাসিক জাতি ফিলিস্তীনীরা। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ইসরাঈলের অধিকৃত জমি পুরোটাই ফিলিস্তীনীদের। এটা পুনরায় উদ্ধার করা তাদের কর্তব্য। এই অধিকার আদায়ের স্বার্থে যদি ফিলিস্তীনীরা প্রতিনিয়ত ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যায় এতে আপত্তির কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীনতা যদি মানুষের জন্মগত অধিকার হয়, তাহলে সদ্য জন্ম নেওয়া ফিলিস্তীনী শিশুটিরও এ অধিকার রয়েছে। অতএব, যতই রক্তক্ষয়ী হোক না কেন এই পথে স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই।

ইসরাঈলের ধ্বংস সুনিশ্চিত: সূরা আল-আ‘রাফের ১৬৮ নম্বর আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইয়াহূদীরা কোনোদিন ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপন করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি তারা ইসরাঈল নামে একটি নিজস্ব রাষ্ট্র সৃষ্টি করে প্রায় ৬০ বছর ধরে সমবেত হচ্ছে। মূলত, ইসরাঈল কখনোই একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়। বরং মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তিবর্গের সৃষ্ট একটি সামরিক কলোনি মাত্র। এই বশংবদ কলোনিটিকে রাষ্ট্র নাম দেওয়াটাও বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনৈতিক খেলা। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বর্তমান ইসরাঈলে তাদের জমা হওয়াটা চূড়ান্ত ধ্বংসের আলামত হতে পারে এবং এই আলামত ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। ইসরাঈল এর সত্যিকারের বিপদ, আসল হুমকি তার ঘরের মধ্যেই মাথাচাড়া দিচ্ছে। ইসরাঈলের মোট জনসংখ্যা ৭.১ মিলিয়ন। তন্মধ্যে ইয়াহূদী ৫.৫ মিলিয়ন আর বাকী ১.৬ মিলিয়ন মুসলিম। গাযা ও পশ্চিম তীরে বসবাসকারী সব মুসলিম মিলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫.৫ মিলিয়ন। এখনই মুসলিমরা ইয়াহূদীদের থেকে ১ লাখ বেশি।[1] তথা জনসংখ্যার বিচারেই একদিন ইসরাঈল হুমকির মুখে পড়বে। এমনিতেই দৃশ্যপট পাল্টে যাবে। তাইতো অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, ফিলিস্তীনীদের উচিত দ্বৈত-রাষ্ট্র (Two States) সমাধানের আশা বাদ দিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা করা। তাতে যদিও কয়েক দশক লেগে যাবে; কিন্তু এতে ইসরাঈলীদের বিপদ ঘটবে।

এছাড়া এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে, অত্যাচার করে কেউ কোনোদিন টিকে থাকেনি। বরং অসত্যের পতন অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং ইসরাঈলও একদিন ধ্বংস হবে। কেননা শত সহস্র শহীদের পথ থেকে ফিলিস্তীনীরা একচুল সরে দাঁড়ায়নি। পুরনো প্রজন্মের ফিলিস্তীনীরা মুক্তিযুদ্ধের সাথে সামান্যতম আপসকামিতা দেখায়নি। শহীদের রক্ত, বোমায় ঝাঁঝরা হওয়া শরীর কথা বলতে শুরু করেছে। শরণার্থী শিবিরে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটাও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর। শহীদ হওয়ার মাঝে যে জাতি আনন্দ পায় তাদেরকে হত্যা করা যায়, ধ্বংস করা যায় না। অবরুদ্ধ করা যায়, কিন্তু স্বাধীনতার আকাশছোঁয়া স্বপ্নচ্যুত করা যায় না। হয়তো অচিরেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটবে এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বলে দিয়েছেন, ‘ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না মুসলিমেরা ইয়াহূদীদের সাথে লড়াই করবে। তারা ইয়াহূদীদের হত্যা করবে। ইয়াহূদীরা পাথরখণ্ড ও গাছের আড়ালে লুকাবে। তখন পাথর ও গাছগুলো বলবে, হে মুসলিম! এই যে ইয়াহূদী আমার পিছনে। এসো, ওকে হত্যা করো’।[2] তাই হতে পারে ফিলিস্তীনে তাদের জমা হওয়াটা চূড়ান্ত ধ্বংসের পূর্ব আলামত।

পরিশেষে বলব ফিলিস্তীন মুসলিমদেরই। বায়তুল আক্বছা মুসলিমদেরই। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাদেরকে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আর সত্যিই মুসলিম শাসকদের যদি কখনো সুমতি হয়, তবে প্রতিটি বিবেকবান মুসলিম আত্মা চলমান অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিজেদের ঈমানী দায়িত্বে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। আল্লাহ মুসলিম বিশ্বের পাঞ্জেরীদের সঠিক চেতনা দান করুন- আমীন!


* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব;
এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।


[1]. Can Israel Survive? টিম ম্যাকগাক, দি টাইম ম্যাগাজিন, ১৯ জানুয়ারি; অনুবাদ: ইফতেখার আমিন, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৯ জানুয়ারি, ২০০৯, পৃ. ৬।

[2]. ছহীহ মুসলিম, হা/৮২, ‘কিতাবুল ফিতান; মিশকাত, হা/৫১৪৪


Magazine