জেরুযালেম বিজয়ে সংঘটিত অন্যান্য যুদ্ধ: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর পূর্বে রোমানদের সাথে যুদ্ধের জন্য তিনি আরেকটি বাহিনী তৈরি করেছিলেন, যেই বাহিনীর দায়িত্বভার দিয়েছিলেন মুতার যুদ্ধে নিহত সেনাপতি যায়েদ ইবনে হারেছা রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সন্তান ১৬/১৭ বছরের যুবক ও কিশোর উসামা ইবনে যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর হাতে, যাতে উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর পিতার হত্যাকারী রোমানদের থেকে যথোপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পারেন। এই বাহিনী রওয়ানা দিয়ে মদীনা অতিক্রম করার পর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যু হয়। অন্যদিকে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করা মাত্রই সারা আরবে ফেতনা ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ মুরতাদ হয়ে যায়, কেউ যাকাত দিতে চায় না, মিথ্যুক নবুঅতের দাবিদারদের আবির্ভাব ঘটে। তখন আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সব ছাহাবী পরামর্শ দিচ্ছিলেন যে, এখন যত সেনাবাহিনী আছে সবাইকে মদীনাতে থাকা উচিত। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মৃত্যুর খবর শুনে আমাদেরকে দুর্বল ভেবে শত্রুরা মদীনায় আক্রমণ করতে পারে। অতএব, উসামা ইবনে যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বাহিনীকেও মদীনায় রেখে দেওয়া উচিত। উত্তরে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন,وَالَّذِي لَا إِلَهَ غَيْرُهُ لَوْ جَرَتِ الْكِلَابُ بِأَرْجُلِ أَزْوَاجِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا رَدَدْتُ جَيْشًا وَجَّهَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَلَا حَلَلْتُ لِوَاءً عَقَدَهُ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘যদি উম্মাহাতুল মুমিনীনের পা কুকুর-শিয়াল টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়, তবুও আমি (আবূ বকর) ঐ সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নিব না, যাকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠিয়েছিলেন। আর সেই ঝান্ডা খুলে নিব না, যাকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তোলন করেছিলেন’।[1]
যদিও পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ ফেতনা তীব্র আকার ধারণ করার কারণে রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালু রাখা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ এক বছর যাবৎ আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু মুরতাদদের বিরুদ্ধে, মিথ্যা নবুঅতের দাবিদারদের বিরুদ্ধে, যাকাত আদায় অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। অভ্যন্তরীণ সকল ফেতনাকে পায়ের নিচে ধ্বংস করে দিয়ে তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেন। এক ভাগ খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে চলে যান পারস্য বিজয় করার জন্য। আরেক ভাগকে তিনি চার ভাগে ভাগ করে দেন, যাদেরকে তিনি পাঠান শাম, ফিলিস্তীন বা বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করার জন্য। বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের পথে আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর জীবদ্দশায় প্রথম যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেটা হচ্ছে আজনাদাইনের যুদ্ধ। আজনাদাইনের এই যুদ্ধ হচ্ছে সর্বপ্রথম আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত আমলে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকে বিজয় করার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে মুআয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু-সহ আরও বহু ছাহাবী অংশগ্রহণ করেছেন। ‘আজনাদাইন’ হচ্ছে বর্তমান ফিলিস্তীনের রামাল্লা থেকে মাত্র ৩০/৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই যুদ্ধে খালেদ বিন ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু মুজাহিদদেরকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,اعلموا إنكم لستم ترون للروم جيشا مثل هذا اليوم فإن هزمهم الله على أيديكم فما يقوم لهم بعدها قائمة أبدا فأصدقوا في الجهاد وعليكم بنصر دينكم وإياكم أن تولوا الأدبار فيعقبكم ذلك دخول النار ‘হে মুসলমানগণ! তোমরা রোমানদেরকে এত বেশি সংখ্যায় অতীতে কখনোই দেখোনি। আজকে যদি মহান আল্লাহ তোমাদের হাতে তাদেকে পরাজিত করে তাহলে এই দেশে আর তারা কখনোই টিকে থাকতে পারবে না। অতএব তোমরা অন্তর থেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও! আর তোমাদের জন্য জরুরী তোমাদের দ্বীনকে সহযোগিতা করা। আর অবশ্যই তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না তাহলে মহান আল্লাহ তোমাদেরকে জাহান্নামে দিয়ে দিবেন’।[2]
আজনাদাইনের যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করলেও সরাসরি জেরুযালেমে তারা প্রবেশ করতে পারেনি। আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মৃত্যুর পরে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ক্ষমতার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ক্ষমতার দায়িত্বভার গ্রহণ করা মাত্রই তিনি খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেন। এটা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর খেলাফত আমলের এক ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত ছিল। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিহাসের পাতায় আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। তবে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিজস্ব কিছু বর্ণনা সকল সমালোচনার জবাব হিসেবে যথেষ্ট।
উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন,إِنِّي لَمْ أَعْزِلْ خَالِدًا عَنْ سَخْطَةٍ وَلا خِيَانَةٍ، وَلَكِنَّ النَّاسَ فُتِنُوا بِهِ، فَخِفْتُ أَنْ يوكلوا إِلَيْهِ وَيُبْتُلُوا بِهِ، فَأَحْبَبْتُ أَنْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ هُوَ الصَّانِعُ ‘আমি ক্রোধের কারণে বা কোনো ধরনের খিয়ানতের কারণে খালেদকে অপসারণ করিনি। কিন্তু মানুষ তার কারণে ফেতনায় পড়ে গেছে (মানুষ মনে করে বসছে খালেদ ইবনে ওয়ালীদ থাকলেই যুদ্ধে বিজয় হয় আর খালেদ ইবনে ওয়ালীদ না থাকলে যুদ্ধে বিজয় হবে না। আমি মানুষের এই আক্বীদাকে নষ্ট করার জন্য খালেদ বিন ওয়ালীদকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করেছি)। আমি আশঙ্কা করছি যে, মানুষ তার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আমি চেয়েছি যে, যাতে মানুষ বুঝে যে, বিজয় আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, কোনো ব্যক্তির কারণে নয়’।[3]
আর ঠিকই খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অপসারণের পরে যখন আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলো, তখন তার নেতৃত্বে বায়সানের যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এই যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয় লাভ করেছিলেন। আর এই যুদ্ধে খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু একজন সাধারণ সেনা হিসেবে আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর অধীনে সেদিন যুদ্ধ করেছিলেন।
বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে বড় যুদ্ধ: বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ে সর্বশেষ, সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছে ইয়ারমূকের যুদ্ধ। আজনাদাইন এবং বায়সানের যুদ্ধে অব্যাহত পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তুরস্ক সীমান্তবর্তী আন্তাকিয়া থেকে রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াস আড়াই লক্ষ সেনাবাহিনীর বিশাল বহর নিয়ে রওয়ানা দিলেন মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
অন্যদিকে মুসলিমদের ছিল মাত্র ৩০ হাজার মুজাহিদ। আর মুসলিমদের প্রধান সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু। তিনি ২ লক্ষের অধিক বিশাল রোমান সেনাবাহিনী দেখে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকটে চিঠি লিখলেন,
فالعَجَلَ وقد سار القوم إلينا كالجراد المنتشر ونحن على نية الحرب والقتال فلا تغفل عن المسلمين وأمدنا برجال من الموحدين.
হে আমীরুল মুমিনীন! রোমানরা পঙ্গপালের মতো আমাদের দিকে ছুটে আসছে। আর আমরা যুদ্ধ ও কিতালের নিয়্যত করেছি। তবে আপনি মুসলিমদের থেকে গাফেল হবেন না এবং আমাদেরকে তাওহীদপন্থি আরো কিছু যোদ্ধা দিয়ে সহযোগিতা করুন![4]
উত্তরে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু লিখে পাঠালেন,فإن نصر الله خير لكم من معونتنا واعلموا إنه ليس بالجمع الكثير يهزم الجمع القليل وإنما يهزم الجمع القليل وإنما يهزم بما أنزل الله من النصر وأن الله عز وجل يقول وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئاً وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ [الأنفال: 19] وما النصر إلا من عند الله ‘নিশ্চয় মহান আল্লাহর সাহায্য তোমাদের জন্য উত্তম হবে আমাদের সহযোগিতার চেয়ে। আর তোমরা জেনে রাখো! কখনোই কোনো বড় দল কোনো ছোট দলকে পরাজিত করতে পারে না; বরং অনেক ছোট দলই বড় দলকে পরাজিত করে যদি তাদের সাথে মহান আল্লাহর সাহায্য থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, “আর তাদের সংখ্যাধিক্য তোমার কিছুই করতে পারবে না। নিশ্চয় মহান আল্লাহ মুমিনদের সাথে রয়েছেন” (আল-আনফাল, ৮/১৯)। আর সহযোগিতার মূল মালিক মূলত আল্লাহ তাআলা’।[5]
তারপর উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি আয়াত লিখলেন,قَالَ الَّذِينَ يَظُنُّونَ أَنَّهُمْ مُلَاقُو اللَّهِ كَمْ مِنْ فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ ‘আর যারা মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে, তারা বলে, কত অল্প সংখ্যক দল কত বেশি সংখ্যক দলের উপর বিজয় লাভ করেছে মহান আল্লাহর ইচ্ছায়। আর নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ ছবরকারীদের সাথে আছেন’ (আল-বাক্বারা, ২/২৪৯)।
উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর পাল্টা চিঠি পেয়ে আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে পরামর্শ করলেন। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু সরাসরি আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে প্রস্তাব দিলেন, শুনুন! আমি যেটা বলব, আপনি কি সেটা মানবেন? তখন আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, হ্যাঁ! আপনি যেটা বলবেন আমি সেটা মানব। তখন খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আজকের জন্য আপনি দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিন। আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু একমত হলেন এবং খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর যুদ্ধের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন।
এই যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনীর সামনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন আমর ইবনুল ‘আছ, মুআবিয়া ইবনে আবূ সুফিয়ান, আবূ হুরায়রা, আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ এবং মুআয ইবনে জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুম।
সেদিন ইয়ারমূকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজেই ইয়ারমূকের জায়গা চয়ন করেছিলেন। যেটা ছিল তিন দিক থেকে উঁচু পাহাড়ঘেরা মরুভূমির উপত্যকা। তার পরিকল্পনা ছিল রোমানদের বিশাল ২ লক্ষ সেনাবাহিনীকে ঐ উপত্যকায় আটকিয়ে দেওয়া এবং আশেপাশের পাহাড় থেকে যাতে যুদ্ধ করতে সহজ হয়। ছয় দিনব্যাপী ইয়ারমূকের যুদ্ধ চলমান থাকে। শুরুর দিকে খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু রক্ষণাত্মকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। শেষদিন তিনি মুসলিমদের উজ্জীবিত করে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এত লম্বা সময় যুদ্ধ চলমান থাকার পর এমন আক্রমণাত্মক কোনো সিদ্ধান্ত মুসলিমরা নিবে তা রোমানদের কল্পনাতেও ছিল না। ফলত, তারা ধীরে ধীরে পরাজিত হতে থাকে। মুসলিমরা বিজয় লাভ করে। আর এটাই ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের সর্বশেষ যুদ্ধ।
জেরুযালেমবিজয়ে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু: এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে পুনরায় মুসলিমরা চার ভাগে বিভক্ত হয়ে বিজয় অভিযান পরিচালনা শুরু করেন। একদল জর্ডান বিজয়ের জন্য বের হয়ে যান, আরেকদল দামেস্ক বিজয়ের জন্য বের হয়ে যান। আর আমর ইবনুল ‘আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে তৃতীয় একটি দল ফিলিস্তীনের গাযা, ইয়াফা, হায়ফা, তেলআবীব এই অঞ্চলগুলো বিজয়ের জন্য বের হয়ে যান। আমর ইবনুল ‘আছ রাযিয়াল্লাহু আনহু বায়তুল মুক্বাদ্দাসের চার দিক থেকে সকল শহর, সকল এলাকা বিজয় করে ফেলেন, শুধু বাকি থাকে জেরুযালেম। জেরুযালেম তখন ছিল রোমানদের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গ, সবচেয়ে বড় কেন্দ্রস্থল। জেরুযালেমের নিকটে গিয়ে তিনি চিঠি লিখে পাঠালেন আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকটে। জেরুযালেম একাই আমার পক্ষে বিজয় লাভ করা সম্ভব নয়, আপনিও আসুন। তখন আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু আরো তিন দিকে যারা যুদ্ধ করছিলেন, তাদেরকেও জেরুযালেমে ডেকে পাঠালেন। সেনাবাহিনীর চারটি দল পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের চারপাশে একত্রিত হলেন। সেদিন জেরুযালেমে প্রায় ৪ হাজার ছাহাবী একত্রিত হয়েছিলেন। মুসলিমরা জেরুযালেম অবরুদ্ধ করে ফেলেন। যখন প্রধান সেনাপতি আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু জেরুযালেম এসে পৌঁছেন, তখন মুসলিমরা তাকবীর ধ্বনির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান। তাকবীর ধ্বনিতে ভেতর থেকে পাদ্রী বের হয়ে আসে। আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে দেখে সে তার হাতে থাকা তাওরাত বা ইঞ্জীলের সাথে মিলিয়ে দেখে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাস যার বিজয় করার কথা এই ব্যক্তি সেই ব্যক্তি নন। তখন আবার সে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের ভেতরে ফিরে গিয়ে অন্য পাদ্রীদের বলে, তোমরা শান্ত থাকো, যার হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় হওয়ার কথা সে এখনো আসেনি; অতএব কোনো চিন্তা নেই। কিন্তু খাদ্যের সংকটের কারণে, পানির সংকটের কারণে কিছুদিন পর পাদ্রীরা আবার বের হয়ে এসে মুসলিমদের সাথে কথা বলতে চায়। কথা বলতে বলতে মদীনায় থাকা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বৈশিষ্ট্যের আলোচনা আসে। যখন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বৈশিষ্ট্য পাদ্রী শুনে, তখন পাদ্রী বলে, হ্যাঁ, এই তো সেই ব্যক্তি, যার হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় হবে। আমাদের কিতাবে লেখা আছে।
‘এক শর্তে আমরা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের চাবি তোমাদের হাতে দিতে পারি, সেটা হচ্ছে স্বয়ং উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে উপস্থিত হতে হবে’।[6]
আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু চিঠি লিখে পাঠালেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্দেশ্যে। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু পাল্টা চিঠিতে জানালেন যে, আমি আসছি বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উদ্দেশ্যে। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু অর্ধপৃথিবীর খলীফা হওয়ার পরও মদীনা থেকে মাত্র একটা উট আর তার সাথে একজন গোলাম নিয়ে রওয়ানা হলেন, তার পরনে ছিল তালি লাগানো ছেঁড়া-ফাটা জামা। আর গোলামের সাথে তার চুক্তি ছিল এই লম্বা (১২০০ কিলোমিটার) রাস্তায় অর্ধেক রাস্তা আমি উটের পিঠে থাকব, তুমি রশি ধরে টানবে আর অর্ধেক রাস্তা তুমি উটের পিঠে থাকবে, আমি রশি ধরে টানব। যেই মুহূর্তে জেরুযালেমের দামেস্ক গেট-এর নিকটবর্তী চলে আসেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু, তখন তার পালা ছিল উটের রশি ধরে টানা আর উটের উপরে বসে ছিল গোলাম। আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হন্তদন্ত হয়ে কাছে গিয়ে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বললেন,يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْتَ تَفْعَلُ هَذَا، تَخْلَعُ خُفَّيْكَ وَتَضَعُهُمَا عَلَى عَاتِقِكَ، وَتَأْخُذُ بِزِمَامِ نَاقَتِكَ، وَتَخُوضُ بِهَا الْمَخَاضَةَ؟ مَا يَسُرُّنِي أَنَّ أَهْلَ الْبَلَدِ اسْتَشْرَفُوكَ، فَقَالَ عُمَرُ: «أَوَّهْ لَمْ يَقُلْ ذَا غَيْرُكَ أَبَا عُبَيْدَةَ جَعَلْتُهُ نَكَالًا لَأُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّا كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ فَأَعَزَّنَا اللَّهُ بِالْإِسْلَامِ فَمَهْمَا نَطْلُبُ الْعِزَّةَ بِغَيْرِ مَا أَعَزَّنَا اللَّهُ بِهِ أَذَلَّنَا اللَّهُ» ‘হে আমীরুল মুমিনীন আপনি আপনার জুতা খুলে কাঁধে নিয়ে, উটের রশি ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনি খুশি হবেন না যে, আপনাকে দেখে মুসলিমরা গর্ববোধ করুক! তখন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আবূ উবায়দা যদি তুমি না হয়ে অন্য কেউ এই কথা বলত। জেনে রাখো, হে আবূ উবায়দা! নিশ্চয় আমরা অপমানিত জাতি ছিলাম। আজ মহান আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। আমরা ইসলাম ব্যাতীত অন্য আর যেখানেই সম্মান খুঁজি না কেন মহান আল্লাহ আমাদেরকে পুনরায় অপমানিত করে দিবেন’।[7]
জেরুযালেম বিজয়ের পর পাদ্রীদের সাথে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি চুক্তি সম্পন্ন করেন। সেই চুক্তিনামাটি ফিলিস্তীনের কিয়ামা কানীসা বা কিয়ামা গির্জায় এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। চুক্তিটি নিম্নরূপ:
بسم الله الرحمن الرحيم
هذا ما أعطى عبد الله، عمر، أمير المؤمنين، أهل إيلياء من الأمان، أعطاهم أماناً لأنفسهم وأموالهم ولكنائسهم وصلبانهم وسقمها وبريئها وسائر ملتها. أنه لا تسكن كنائسهم ولا تهدم، ولا ينقص منها ولا من حيِّزها ولا من صليبهم ولا من شيء من أموالهم، ولا يُكرهون على دينهم، ولا يضارّ أحد منهم، ولا يسكن بإيلياء معهم أحد من اليهود. وعلى أهل إيلياء أن يُعطوا الجزية كما يُعطي أهل المدائن. وعليهم أن يُخرِجوا منها الروم واللصوص. فمن خرج منهم فإنه آمن على نفسه وماله حتى يبلغوا أمنهم. ومن أقام منهم فهو آمن، وعليه مثل ما على أهل إيلياء من الجزية. ومن أحب من أهل إيلياء أن يسير بنفسه وماله مع الروم ويخلي بِيَعهم وصلبهم، فإنهم آمنون على أنفسهم وعلى بِيَعهم وصلبهم حتى يبلغوا أمنهم. فمن شاء منهم قعد وعليه مثل ما على أهل إيلياء من الجزية. ومن شاء سار مع الروم. ومن شاء رجع إلى أهله، فإنه لا يؤخذ منهم شيء حتى يحصد حصادهم.
وعلى ما في هذا الكتاب عهد الله وذمة رسوله وذمة الخلفاء وذمة المؤمنين، إذا أعطوا الذي عليهم من الجزية.
كتب وحضر سنة خمس عشرة هجرية.
شهد على ذلك : خالد بن الوليد، وعبد الرحمن بن عوف، وعمرو بن العاص ومعاوية بن أبي سفيان.
সারমর্ম: এটি আল্লাহর বান্দা উমার-এর পক্ষ থেকে (আহলে ঈলিয়া) বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অধিবাসীকে প্রদত্ত নিরাপত্তা। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খ্রিষ্টান যত অধিবাসী আছে, সকলের জানমাল নিরাপদ। ইসলাম গ্রহণ করানোর জন্য জবরদস্তি করা হবে না। জেরুযালেমের অধিবাসীদেরকে মাদায়িনের অধিবাসীদের মতো জিযিয়া প্রদান করতে হবে। যারা জেরুযালেম থেকে বের হয়ে রোম বা অন্য কোথাও ফেরত যেতে চায়, তাদের জন্যও পরিপূর্ণ নিরাপত্তা থাকবে। আর জেরুযালেমে খ্রিষ্টানদের সাথে কোনো ইয়াহূদী বসবাস করতে পারবে না। আর এই চুক্তিটি রক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিম শাসক ও প্রত্যেক মুমিনের উপর জরুরী কর্তব্য। এটি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে ওয়াদা।[8]
উক্ত চুক্তিতে ইয়াহূদীদের বসবাস না করার বিষয়টি মূলত খ্রিষ্টান পাদ্রীদের চাপাচাপিতে যুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু খ্রিষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালাম-এর হত্যাকারী হিসেবে ইয়াহূদীদেরকে দায়ী করত। তাই তারা কখনোই চাইত না ইয়াহূদীদের দ্বারা তাদের পবিত্র ভূমি নাপাক হোক। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর এই চুক্তি উমাইয়া, আব্বাসীয়, মামলূক থেকে শুরু করে উছমানীয় খেলাফতের শেষ দিন পর্যন্ত মুসলিমরা লঙ্ঘন করেনি। কোনোদিন জেরুযালেমে বসবাসরত কোনো খ্রিষ্টানের সাথে তারা খারাপ আচরণ করেনি। কোনো গির্জায় আক্রমণ করা হয়নি। কোনো গির্জাকে নষ্ট করা হয়নি। অথচ আজকের খ্রিষ্টানরা তথা আমেরিকা ও ইউরোপ উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে করা চুক্তিভঙ্গ করেছে। আজকে তারা বায়তুল মুক্বাদ্দাসে ইয়াহূদীদেরকে বসবাস করতে দিচ্ছে।
যাহোক, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু চুক্তি সম্পন্ন করার পর পাদ্রীর নিকট ছালাত আদায় করতে চাইলেন। পাদ্রী তাকে গির্জায় নিয়ে গেলেন। গির্জায় ঢুকার পর পাদ্রী উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলল, আপনি এখানে ছালাত আদায় করুন। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু সেখানে ছালাত আদায় করতে চাইলেন না। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আপনি আমাকে মাসজিদুল আক্বছায় নিয়ে চলুন। পাদ্রী বলল, আপনি কি ওই জায়গা খুঁজছেন, যেই জায়গাকে ইয়াহূদীরা সবচেয়ে বেশি সম্মান করে? তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি ঐ জায়গা খুঁজছি, যেটাকে ইয়াহূদীরা সবচেয়ে বেশি সম্মান করে। তখন পাদ্রী তাকে এক বিশাল উঁচু জায়গায় নিয়ে গেলেন। জায়গাটিতে বড় বড় পাথর রাখা, অপরিচ্ছন্ন, অপরিষ্কার অবস্থায় পড়ে আছে। তখন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পরিষ্কার করা শুরু করলেন। তার সাথে ছাহাবীগণও হাত লাগিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পরিষ্কার করা শুরু করলেন। তখন কা‘ব আল-আহবারকে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা! কোথায় মসজিদ তৈরি করব আমরা? কা‘ব আল-আহবার বললেন, এই পাথরকে ইয়াহূদীরা সবচেয়ে বেশি সম্মান করে, ইয়াহূদীরা ক্বেবলা হিসেবে ব্যবহার করে। আপনি এই পাথরের পেছনে মসজিদ তৈরি করুন। তখন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি কী বলো? এই পাথরের পিছনে মসজিদ তৈরি করলে তো ইয়াহূদীরা বলবে যে, মুসলিমরা এই পাথরকে সিজদা করছে। না! এই পাথরের পিছনে মসজিদ তৈরি করা যাবে না। তিনি পাথরের সামনে এগিয়ে গিয়ে একদম শেষ মাথায় মসজিদ তৈরি করলেন। বর্তমান যে আল-আক্বছা মসজিদ কম্পাউন্ড দেখা যায় তার পুরো উঁচু এরিয়াটাই মূলত পবিত্র ভূমি। সেই উঁচু এরিয়ার সম্পূর্ণ ক্বেবলা বা কা‘বার দিকে যে চত্বর, সেখানেই মসজিদ তৈরি করেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু, যা বর্তমানে কিবলী মসজিদ নামে পরিচিত। সেটিই মূলত প্রকৃত মসজিদে আক্বছা। আর বর্তমানে যেটি কুব্বাতুছ ছখরা (স্বর্ণালি গম্বুজ) দেখা যায়। সেই কুব্বাতুছ ছখরার নিচেই রয়েছে ইয়াহূদীদের সেই পবিত্র পাথর।
মসজিদে আক্বছায় বেলাল রাযিয়াল্লাহু আনহু আযান দিলেন এবং উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু ফজরের ছালাতে ইমামতি করলেন। এভাবেই জেরুযালেম ও মসজিদে আক্বছা মুসলিমদের অধীনে চলে আসে। ফালিল্লাহিল হামদ!
(চলবে)
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক
ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,
সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।
[1]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৬/৩০৫।
[2]. ফুতূহ আশ-শাম, ১/৪৪-৫০।
[3]. তারীখ ত্ববারী, ৪/৬৮।
[4]. ফুতূহ আশ-শাম, ১/১৬৭।
[5]. প্রাগুক্ত।
[6]. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৯/৬৫৬।
[7]. মুসতাদরাকে হাকেম, হা/২০৭।
[8]. তারীখ ত্ববারী, ৩/৬০৯।