কুরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার এক অনন্য বার্তা

জেরুযালেম ও বায়তুল ‍মুকাদ্দাস : ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা (পর্ব-৩)

post title will place here

সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর জীবনে জেরুযালেম : আল্লাহর নবী সুলায়মান আলাইহিস সালাম বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন। তিনি এটাকে প্রথম নির্মাণ করেননি; বরং পুনঃনির্মাণ বা সংস্কার করেন। কেননা হাদীছে এসেছে, মাসজিদুল হারাম ও মাসজিদুল আক্বছা নির্মাণের মাঝের ব্যবধান হলো ৪০ বছর।[1] কাজেই যদি ধরা হয় যে, মাসজিদুল হারাম ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রথম নির্মাণ করেছেন আর সুলায়মান আলাইহিস সালাম বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেছেন, তাহলে উক্ত হাদীছ বাতিল সাব্যস্ত হবে। কেননা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আর সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর মাঝে বহু বছরের ব্যবধান রয়েছে। এজন্য মুহাক্বিক্ব উলামায়ে কেরাম বলেন যে, মাসজিদুল হারাম ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আর সুলায়মান আলাইহিস সালাম বায়তুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণ করেছেন। মসজিদ দুটি প্রথমে নির্মাণ করেছেন ফেরেশতাগণ অথবা আদম আলাইহিস সালাম অথবা তাঁর কোনো সন্তান।[2] সুলায়মান আলাইহিস সালামও একজন মহান নবী এবং বাদশাহ ছিলেন। মহান আল্লাহ বাতাস ও লোহাকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছিলেন। জিন, পাখি, পিঁপড়াসহ প্রায় সকল সৃষ্টিজীবের উপর তাকে ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন। সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর এই রাজত্বের মূল প্রাণকেন্দ্র ছিল এই জেরুযালেম। তিনি জেরুযালেমের পবিত্র মসজিদ বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণকাজ পরিচালনা করেন। তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দামি ও বিশাল পাথর জমা করে মসজিদ তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তারই আলোকে তিনি এই গুরুদায়িত্ব তাঁর অধীনস্থ জিনদেরকে প্রদান করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে তিনি একটি লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। তাঁর মৃত্যু সংঘটিত হলেও জিনেরা তা বুঝতে পারেনি। আর সুলায়মান আলাইহিস সালাম-কে তারা এত বেশি ভয় করত যে, তারা তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার সাহস করত না। এভাবে দীর্ঘদিন অতিক্রম হওয়ার পর যখন ঘুনপোকা সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর লাঠি খেয়ে ফেলে এবং তাঁর শরীর পড়ে যায় তখন জিনেরা বুঝতে পারে যে, তিনি মারা গেছেন। বিষয়টি কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ الْمُهِينِ ‘যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যুর ফয়সালা করলাম, তখন তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে জিনদেরকে জানান দেয় জমির পোকা, যারা তাঁর লাঠি খাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে যান, তখন জিনদের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যদি তারা গায়েব জানত তাহলে তারা এই লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তির মাঝে অবস্থান করত না’ (সাবা, ৩৪/১৪)

সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণকে লক্ষ্য করে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি ছহীহ হাদীছ নিম্নরূপ—

عن عبد الله ابن عمرو ابن الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّ سُلَيْمَانَ لَمَّا بَنَى بَيْتَ الْمَقْدِسِ سَأَلَ رَبَّهُ عَزَّ وَجَلَّ خِلَالًا ثَلَاثًا فَأَعْطَاهُ اثْنَتَيْنِ وَنَحْنُ نَرْجُو أَنْ تَكُونَ لَنَا الثَّالِثَةُ سَأَلَهُ حُكْمًا يُصَادِفُ حُكْمَهُ فَأَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَسَأَلَهُ مُلْكًا لَا يَنْبَغِي لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِهِ فَأَعْطَاهُ إِيَّاهُ وَسَأَلَهُ أَيُّمَا رَجُلٍ خَرَجَ مَنْ بَيْتِهِ لَا يُرِيدُ إِلَّا الصَّلَاةَ فِي هَذَا الْمَسْجِدِ خَرَجَ مِنْ خَطِيئَتِهِ مِثْلَ يَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ فَنَحْنُ نَرْجُو أَنْ يَكُونَ اللَّهُ قَدْ أَعْطَانَا إِيَّاهَا.

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন সুলায়মান বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন, তখন তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট তিনটি প্রার্থনা করেন। তন্মধ্যে দুটি প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন। আর আমরা আশা করি, মহান আল্লাহ আমাদেরকে তৃতীয়টি দান করবেন। তিনি প্রার্থনা করেন, যেন মহান আল্লাহ তাঁকে স্বীয় ফয়সালার অনুরূপ ফয়সালা করার তাওফীক্ব দান করেন! মহান আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। তিনি এমন রাজত্ব চান, যা তাঁর পরে আর কারো জন্য সংগত হবে না। মহান আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। তারপর তিনি দু‘আ করেন, যে ব্যক্তি এই বায়তুল মুকাদ্দাসে শুধু ছালাত আদায় করার জন্যই আসবে, ছালাত আদায় করবে, সে যেন সদ্য ভূমিষ্ট শিশুর মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায়। এই দু‘আ সুলায়মান আলাইহিস সালাম আল্লাহর নিকটে করেন। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমরা আশা করি যে, এটি (তৃতীয় দু‘আটি) আমাদের প্রদান করা হয়েছে’।[3]

জেরুযালেমের প্রথম ধ্বংস: সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর মৃত্যুর পরে বনী ইসরাঈল রাষ্ট্র দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়; উত্তরে ইসরাঈল রাষ্ট্র আর দক্ষিণে ইয়াহূদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরাঈল রাষ্ট্র খ্রিষ্টপূর্ব ৭২২ সালে অ্যাসিরিয়ানরা দখল করে আর ইয়াহূদা রাষ্ট্র খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ ব্যাবিলনীয়রা দখল করে নেয়। আর এসময় তাদের চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতন ঘটে। আল্লাহ তাআলা তাদের চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতন ঘটলে তাদের মাঝে অনেক নবী পাঠান তাদেরকে সংশোধনের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোনো নবীর সাথেই বনী ইসরাঈল ভালো ব্যবহার করতে পারেনি। কারো উপর অত্যাচার করেছে, কাউকে বন্দী করেছে, কাউকে হত্যা করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ইলইয়াস, আল-ইয়াসা, যুলকিফল-সহ অগণিত নবী। তাদের এই পাপের বোঝা ভারী হয়ে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর এমন শাস্তি আরোপ করেন।

বুখতিনাসার নামক ইরাকের এক বাদশাহ খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ সালে জেরুযালেমের উপর আক্রমণ করে পুরো জেরুযালেমকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়ে সকল বনী ইসরাঈলকে বন্দী করে নিয়ে ইরাকে চলে যায়, এটা জেরুযালেমের সমূলে ধ্বংস হওয়ার প্রথম ঘটনা। বাদশাহ বুখতিনাসারের হাতে বন্দী হওয়ার পর পারসিকদের মাধ্যমে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৮ সালে আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলকে মুক্তি দান করেন। পুনরায় বনী ইসরাঈল ফিরে এসে জেরুযালেম আবাদ করা শুরু করে এবং তারা খ্রিষ্টপূর্ব ৫১৬ সালে দ্বিতীয় মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। পুনরায় আল্লাহ তাআলা তাদের মাঝে নবী পাঠানোর ধারা শুরু করেন। কিন্তু তারা পুনরায় তাদের মাঝে পাঠানো নবীদের সাথে খারাপ ব্যবহার অব্যাহত রাখে।

মারইয়াম, ঈসা, ইয়াহইয়া ও যাকারিয়া আলাইহিমুস সালাম-এর জীবনে জেরুযালেম : জেরুযালেমে পুনরায় ফিরে আসার পর তাদের মধ্যে মহান আল্লাহ যে নবীদের প্রেরণ করেন, তাদের অন্যতম হচ্ছেন যাকারিয়া, ইয়াহইয়া এবং ঈসা আলাইহিমুস সালাম। জেরুযালেমের সাথে জড়িয়ে আছে ঈসা এবং তাঁর সম্মানিতা মা মারইয়াম আলাইহিমাস সালাম-এর ঘটনাপ্রবাহ। এগুলোর বর্ণনা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন। বর্ণনা নিম্নরূপ—

যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আল্লাহ! আমার পেটে যে সন্তান আছে এই সন্তানকে আমি তোমার রাস্তায় উৎসর্গ করে দিলাম। তোমার রাস্তায় মানে বায়তুল মুকাদ্দাসের জন্য উৎসর্গ করে দিলাম। যখন তিনি তাঁর সন্তান প্রসব করলেন তখন তিনি দেখলেন যে, তিনি মেয়ে প্রসব করেছেন। তখন তিনি তাঁর নাম রাখলেন মারইয়াম। আর মহান আল্লাহর নিকট মারইয়াম ও তাঁর সন্তানের জন্য শয়তান থেকে পরিত্রাণ চাইলেন। পরবর্তীতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে করা কৃত ওয়াদা পূরণের জন্য তিনি তাঁর সেই মেয়েকেই বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমতের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। মারইয়াম (আ.)-কে বায়তুল মুকাদ্দাসের খাদেমা করার পর কে তাঁর দায়িত্ব বহন করবে, এই নিয়ে বনী ইসরাঈলের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। লটারির মাধ্যমে মারইয়াম (আ.)-এর খালু যাকারিয়া আলাইহিস সালাম তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যখনই যাকারিয়া আলাইহিস সালাম তাঁর নিকটে প্রবেশ করতেন তখনই তিনি দেখতেন যে, তাঁর নিকটে অসময়ের ফলমূল। যেমন— যখন আম-লিচুর মওসূম নয়, তখন তার কাছে আম-লিচু রয়েছে। তখন তিনি বলেন, মারইয়াম! এই অসময়ের ফলমূল কোথায় থেকে আসে? তখন মারইয়াম (আ.) উত্তরে বললেন, এগুলো সব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে (দ্রষ্টব্য: আলে ইমরান, ৩/৩৩-৩৭)

এই দৃশ্য দেখে যাকারিয়া আলাইহিস সালামও এরকম একজন সৎ সন্তান চান। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা দিয়েছেন নিম্নরূপ—

সেখানে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম তাঁর প্রতিপালককে ডাকা শুরু করল। সেখানে বলতে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম জেরুযালেমের বায়তুল মুকাদ্দাসে আল্লাহ তাআলাকে ডাকলেন। তখন ফেরেশতারা তাকে ডাক দিয়ে বলল, যখন সে মেহরাবে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছিল, এই মেহরাব বায়তুল মুকাদ্দাসের মেহরাব। ফেরেশতারা বলল, আল্লাহ তাআলা আপনাকে একটি সৎ সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হবে ইয়াহইয়া এবং যাকে মহান আল্লাহ নবী করে দিয়েছেন। তখন যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বললেন, আমার কীভাবে সন্তান হতে পারে অথচ আমি বৃদ্ধ এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। তখন মহান আল্লাহ বললেন, আল্লাহ এভাবেই যা ইচ্ছা তা সৃষ্টি করতে পারেন (আলে ইমরান, ৩/৩৮-৪০)

অন্যদিকে মারইয়াম (আ.)-এর সাথেও এক ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা শুরু হয়। যেটা আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন,

إِذْ قَالَتِ الْمَلَائِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ - وَيُكَلِّمُ النَّاسَ فِي الْمَهْدِ وَكَهْلًا وَمِنَ الصَّالِحِينَ - قَالَتْ رَبِّ أَنَّى يَكُونُ لِي وَلَدٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ قَالَ كَذَلِكِ اللَّهُ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ إِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ - وَيُعَلِّمُهُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَالتَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ

ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ : ফেরেশতারা মারইয়াম (আ.)-কে বলল, আল্লাহ তাআলা তোমাকে সুসংবাদ দিচ্ছেন একজন সৎ সন্তানের, যার নাম হবে ঈসা ইবনু মারইয়াম। তথা তাঁর কোনো পিতা নেই, সে পিতাবিহীনভাবে মারইয়াম (আ.)-এর গর্ভে জন্ম নিবে, তাই তাঁর নাম হবে ঈসা ইবনু মারইয়াম। তখন মারইয়াম (আ.) আশ্চর্য হয়ে বললেন যে, কীভাবে আমার সন্তান হতে পারে! অথচ আমাকে কোনো পুরুষ মানুষ স্পর্শ করেনি? আল্লাহ তাআলা উত্তরে বলছেন, আল্লাহ যা চান, যেটা চান, যেভাবে চান তিনি সৃষ্টি করতে পারেন এবং তিনি সৃষ্টি করার উপর ক্ষমতাশীল। আল্লাহ তাআলা আরো বর্ণনা দিচ্ছেন যে, ঈসা আলাইহিস সালাম-এর যখন জন্ম হবে, তখন তিনি শিশু অবস্থাতেই মায়ের কোলে মানুষের সাথে কথা বলবেন, তাঁর মায়ের পবিত্রতার সাক্ষ্য দিবেন। আর মহান আল্লাহ তাকে তাওরাত, ইনজীল ও হিকমত শিক্ষা দিবেন। অতঃপর তিনি নবী হিসেবে মানুষকে সত্য ও সঠিক দ্বীনের দিকে আহ্বান করবেন (আলে ইমরান, ৩/৪৫-৪৮)

একই সাথে তিনজন নবী যাকারিয়া, ইয়াহইয়া এবং ঈসা আলাইহিমুস সালাম তিনজন মহান নবীর সাথে বনী ইসরাঈল (তৎকালীন ইয়াহূদীরা) চরম পর্যায়ের খারাপ ব্যবহার করল। যাকারিয়া এবং ইয়াহইয়া আলাইহিমাস সালাম-কে হত্যা করল এবং ঈসা আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করার চেষ্টা করল। যদিও খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে যে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তাঁকে তারা হত্যা করতে পারেনি। ঈসা আলাইহিস সালাম-কে আসমানে জীবিত অবস্থায় আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে তাঁর মায়ের উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানসিক নির্যাতন সেই বনী ইসরাঈল অব্যাহত রাখল। তাদের এই পাপের বোঝা ভারী হয়ে গেলে আল্লাহ তাআলা তাদের দ্বিতীয়বারের মতো জেরুযালেম থেকে সমূলে ধ্বংস করে দেন। যেটা আমরা ইতিহাসের পাতায় জানি যে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৮ সালে পারসিকরা রোমানদের উপর জয় লাভ করার পর ইয়াহূদীরা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পায়। অতঃপর খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে গ্রীকরা পারসিকদের ‍উপর জয় লাভ করে, তখন ইয়াহূদীরা গ্রীকদের অধীনে চলে যায়, তারপর খ্রিষ্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমানরা গ্রীকদের উপর জয় লাভ করে। এসময় ইয়াহূদীরা রোমানদের শাসনাধীন হয়ে যায়। পরবর্তীতে ৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াহূদীরা রোমান শাসন থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিদ্রোহ করে, কিন্তু রোমকরা শক্ত হাতে দমন করে। রোমকরা ৬৬-৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৪ বছর জেরুযালেম অবরোধ করে রাখে। অতঃপর ৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুযালেম পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। ইয়াহূদীদের দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস করে। এরপর ইয়াহূদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছন্নছাড়া হয়ে যায়। যেটাকে তারা ডিসপার্স বলে থাকে। অবশেষে তারা ১৯৪৮ সালে আবার স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এটা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস বা জেরুযালেম ধবংস হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা।

সারমর্ম : উক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যে বিষয়গুলো আমরা স্পষ্ট করতে চেয়েছি, তা হচ্ছে— ইবরাহীম, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, ইউসুফ, মূসা, হারূন, ইউশা বিন নূন, দাঊদ, সুলায়মান, ইলইয়াস, আল-ইয়াসা, যুলকিফল, লূত, ঈসা, যাকারিয়া, ইয়াহইয়া আলাইহিমুস সালাম সকলের সম্পর্ক ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের সাথে বা জেরুযালেমের সাথে। এজন্য আজকের পৃথিবীর যারা ইয়াহূদী, আজকের পৃথিবীর যারা খ্রিষ্টান, আপনি কল্পনা করুন যে, আমেরিকার কাছে কী এমন কমতি রয়েছে টাকা-পয়সার, কী এমন কমতি রয়েছে ক্ষমতার, কী এমন কমতি রয়েছে প্রভাব-প্রতিপত্তির? সারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ার পরও, সুপার পাওয়ার হওয়ার পরও তারা নিজেদেরকে অসম্পূর্ণ মনে করে যদি তাদের হাতে জেরুযালেম না থাকে। কেননা (তাদের) নবী ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জন্মস্থান তো এই জায়গাতে, বায়তুল লাহাম বা বেথেলহাম। (তাদের) নবীর মায়ের তথা মারইয়াম (আ.)-এর থাকার জায়গা তো এই জায়গা। (তাদের) নবীর বেড়ে ওঠার জায়গা তো এই জায়গা। আপনি ইয়াহূদীদেরকে দেখুন, তারা যদি সারা পৃথিবীর সকল ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে, সারা পৃথিবীর সকল দেশ বিজয় করে ফেলে, তবুও তারা নিজেদেরকে অসম্পূর্ণ মনে করবে যদি জেরুযালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের হাতে না থাকে। কেননা তাদের যত স্মৃতি রয়েছে, সেটা দাঊদ আলাইহিস সালাম-এর স্মৃতি হোক, সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর স্মৃতি হোক, সকল স্মৃতি এই মাটির সাথে সম্পৃক্ত। এজন্য পৃথিবীর তিন ধর্ম একত্রে এই জায়গার দাবিদার, এভাবে অন্য কোথাও নাই। মক্কার দাবিদার ইয়াহূদীরাও নয়, খ্রিষ্টানরাও নয় বা মদীনার দাবিদার ইয়াহূদীরাও নয়, খ্রিষ্টানরাও নয় বা অন্য কেউ নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর এক সন্তান ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-কে রেখে গিয়েছিলেন মক্কায় এবং তাঁর বংশে একমাত্র নবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দান করেন। ফলত, মক্কার বা কা‘বার একমাত্র দাবিদার উম্মতে মুহাম্মাদী, মদীনার একমাত্র দাবিদার উম্মতে মুহাম্মাদী। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দাস এমন এক জায়গা, যেটার দাবিদার একসাথে পৃথিবীর বড় তিন ধর্মের অনুসারীরা। সুতরাং ক্বিয়ামতের নিকট মুহূর্তে যা কিছু ঘটবে তার সবকিছু এই বায়তুল মুকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে হবে। যত ফেতনার ঘটনা, দাজ্জালের উত্থান, দাজ্জালের পতন, ঈসা আলাইহিস সালাম-এর পুনরায় পৃথিবীতে আসা সবকিছু এই বায়তুল মুকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে হবে। পৃথিবীর সকল ধর্মের অনুসারীরা অপেক্ষায় আছে একজন মাসীহ এর। তিনি আসবেন এবং তাদেরকে উদ্ধার করবেন। মুসলিমরা অপেক্ষায় আছে একজন মাসীহ এর, যিনি ঈসা আলাইহিস সালাম। খ্রিষ্টানরা অপেক্ষায় আছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম পুনরায় আসবে আর ইয়াহূদীরা অপেক্ষায় আছে তাদেরকে একজন উদ্ধার করার জন্য আসবে এবং ক্বিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে একজন অবশ্যই আসবে। কিন্তু তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং তিনি হবেন ঈসা আলাইহিস সালাম। পৃথিবী ধ্বংসের নিকটবর্তী সময়ে মালহামা কুবরা বা বড় বড় যে যুদ্ধগুলো সংঘটিত হবে, মহাযুদ্ধগুলো সংঘটিত হবে তার সবগুলো এই বায়তুল মুকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে এবং জেরুযালেমের আশেপাশে এটাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হবে। কেননা এর চাইতে বড় ক্রাইটেরিয়া, এর চাইতে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কারণ পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় পাওয়া যায় না। আর পৃথিবীর এটাই একমাত্র জায়গা, যেটাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশিবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ঐতিহাসিকদের দাবি অনুযায়ী, জেরুযালেমের ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে ৫০ বারেরও অধিক এবং জেরুযালেমে যুদ্ধও হয়েছে ১০০ বারের কাছাকাছি শুধু জেরুযালেমের ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে। পৃথিবীর অতীত ইতিহাসে জেরুযালেমে দুইবার ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়ে।

(চলবে)

 ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।

 

[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪২৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৪৮।

[2]. হাশিয়াতুস ‍সিন্ধী আলা সুনানি ইবনু মাজাহ, ১/২৫৪; মিরক্বাতুল মাফাতীহ, ২/৪৬৮।

[3]. মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৬২৪; নাসাঈ, হা/৬৯৩, ইবনু মাজাহ, হা/১৪০৮, হাদীছ ছহীহ।

Magazine