জেরুযালেমে উচ্চারিত হলো মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম: তৎকালীন বিশ্বে দুই পরাশক্তি ছিল রোম ও পারস্য। রোম বলতে ইউরোপ বুঝায়। যারা মূলত খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিল। সিরিয়া, মিশর ও ফিলিস্তীন পর্যন্ত তাদের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। অন্যদিকে ফারসী ভাষায় যারা কথা বলে, তাদেরকে ফারিস বা ফুরস বলা হয়। সেটাকেই বাংলায় পারস্য লেখা হয়। ইরানের সাম্রাজ্যই মূলত পারস্য সাম্রাজ্য। পারস্যরা ছিল অগ্নিপূজক মাজূসী। এই দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। তাদের ক্ষমতার প্রভাব বলয়ে যেহেতু মক্কা-মদীনাও ছিল এবং মক্কা-মদীনার রাজনীতিও যেহেতু অনেকটাই তাদেরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান থাকত, তাই তাদের যুদ্ধের জয়-পরাজয় নিয়ে আরবেও চর্চা হতো। রোম সাম্রাজ্য ঈসায়ী খ্রিষ্টান ধর্ম তথা একটি আসমানী ধর্মের অনুসারী হওয়ায় মুসলিমরা তাদেরকে ভালোবাসত এবং পারস্যের অগ্নিপূজকরা মুশরিক হওয়ায় মক্কার কাফের-মুশরিকরা তাদের পক্ষ নিত। হিজরতের পর থেকে মক্কার কাফের-মুশরিকদের সাথে মুসলিমদের ছোট-বড় যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকে। হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলে উভয় দলই যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে রেহাই পায়। ফলশ্রুতিতে মক্কার কাফের-মুশরিকদের নেতা আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়ী দল ব্যবসার উদ্দেশ্যে সফরে বের হয়। অন্যদিকে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য দূত পাঠানো শুরু করেন।
এদিকে রোমান প্রধান কায়ছার মানত মেনেছিলেন যে, বায়তুল মাক্বদিস উদ্ধার করতে পারলে তিনি পায়ে হেঁটে বায়তুল মাক্বদিস যাবেন। হুদায়বিয়ার সন্ধিকালীন সময় তিনি সেই মানত পূরণ করতে বায়তুল মাক্বদিস চলে আসেন। ঠিক সেই সময়েই আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূত দিহইয়া আল-কালবী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চিঠি নিয়ে প্রথমে বাছরা যান, সেখান থেকে বায়তুল মাক্বদিস পৌঁছান সরাসরি কায়ছারের দরবারে। ঠিক সেই সময়েই আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ব্যবসায়ী দলও বায়তুল মাক্বদিস পৌঁছে। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুঅতের খবর আগে থেকেই কায়ছারের নিকট ছিল। এখন তার চিঠি পেয়ে তিনি আরো ভালোভাবে সেই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিষয়ে জানতে চান। তাই চিঠি পড়ার আগেই বিষয়টি বিশ্লেষণ করার জন্য তিনি আরবের ব্যবসায়ী দলকে ডেকে পাঠান। তাদের মধ্যে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটাত্মীয় কে তা জেনে নিয়ে আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সামনে বসান এবং কাফেলার সদস্যদেরকে তার পিছনে বসান। আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু যদি মিথ্যা বলে, তাহলে কাফেলার বাকী সদস্যরা সেটার বিরোধিতা করবে মর্মে কায়ছার নির্দেশ প্রদান করেন। যেহেতু স্বাভাবিকভাবে আরব বিশ্বে মিথ্যাকে চরম ঘৃণ্য বিষয় হিসেবে দেখা হয়, সেক্ষেত্রে কোনো গোত্রপ্রধান যদি মিথ্যুক প্রমাণিত হয়, তাহলে তার সম্মান বলতে কিছুই বাকী থাকে না। আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু নিজের সম্মানের খাতিরেই এবং তার সঙ্গী-সাথীদের নিকট তিনি যেন মিথ্যুক না হন এজন্য তিনি কোনো মিথ্যা উত্তর প্রদান করেননি।
নিম্নে হিরাক্লিয়াসের সাথে আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর কথোপকথন হাদীছের আলোকে তুলে ধরা হলো—
হিরাক্লিয়াস: তোমাদের মধ্যে যিনি নবুঅতের দাবি করেছেন, তার বংশ কেমন?
আবূ সুফিয়ান: তিনি আমাদের মধ্যে উঁচু বংশের সন্তান।
হিরাক্লিয়াস: তার পূর্বে সেই বংশে কেউ কি নবুঅতের দাবি করেছিল?
আবূ সুফিয়ান: না! করেনি।
হিরাক্লিয়াস: নবুঅতের দাবিদার সেই ব্যক্তির বাপ-দাদার মধ্যে কেউ কি রাজা-বাদশাহ ছিলেন।
আবূ সুফিয়ান: না! ছিলেন না।
হিরাক্লিয়াস: যারা তাঁর অনুসরণ করেন, তারা কি উচ্চ পর্যায়ের, উচ্চ বংশের, সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষ না সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষ?
আবূ সুফিয়ান: যারা সমাজের সাধারণ স্তরের মানুষ, তারা তাঁর অনুসরণ করে।
হিরাক্লিয়াস: তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে?
আবূ সুফিয়ান: দিন দিন বাড়ছে।
হিরাক্লিয়াস: তার আনীত দ্বীনে প্রবেশ করার পর কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে বের হয়ে আসে?
আবূ সুফিয়ান: না! সেই দ্বীনে একবার প্রবেশ করলে কেউ বের হয়ে আসে না।
হিরাক্লিয়াস: নবুঅতের দাবি করার পূর্বে তাকে কি কখনো মিথ্যা বলতে দেখা গেছে?
আবূ সুফিয়ান: না! নবুঅত দাবি করার পূর্বে তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি।
হিরাক্লিয়াস: তিনি কি কখনো ওয়াদা বা চুক্তি ভঙ্গ করেছেন?
আবূ সুফিয়ান: না! তিনি কখনো ওয়াদা বা চুক্তি ভঙ্গ করেননি। তবে বর্তমানে তার সাথে আমাদের একটা চুক্তি চলমান আছে। এটার বিষয়ে উনি কী করবেন তা বলতে পারছি না।
হিরাক্লিয়াস: তার সাথে কি তোমাদের কখনো যুদ্ধ হয়েছে?
আবূ সুফিয়ান: হ্যাঁ! যুদ্ধ হয়েছে।
হিরাক্লিয়াস: যুদ্ধের ফলাফল কী?
আবূ সুফিয়ান: যুদ্ধের ফলাফল কুয়ার বালতির মতো। কখনো আমাদের হাতে আমরা পানি তুলেছি আর কখনো তার হাতে তিনি পানি ভর্তি করেছেন।
হিরাক্লিয়াস: তিনি তোমাদের কী বিষয়ে আদেশ দেন? তাঁর মৌলিক শিক্ষা কী?
আবূ সুফিয়ান: তাঁর শিক্ষা হচ্ছে, শিরক করো না। এক আল্লাহর ইবাদত করো, যে সমস্ত শিরকী কথা ও কাজ তোমাদের বাপ-দাদারা করে এসেছেন, তা পরিত্যাগ করো, ছালাত আদায় করো, সত্য বলো, যাকাত আদায় করো, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করো, হারাম সম্পর্ক থেকে নিজেকে পবিত্র রাখো।
জিজ্ঞাসাবাদের পর হিরাক্লিয়াসের মন্তব্য: উপরের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে আবূ সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর প্রতিটি উত্তরের উপর হিরাক্লিয়াস মন্তব্য পেশ করেন।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, নবুঅতের দাবিদার ব্যক্তির বংশ কেমন? তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি উঁচু বংশের। আর জেনে রাখো! নবীগণ উঁচু বংশেই প্রেরিত হয়ে থাকেন।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাঁর পূর্বে সেই বংশে কেউ কি নবুঅতের দাবি করেছিল? তুমি উত্তরে বলেছ, করেনি। যদি তাঁর পূর্বে কেউ নবুঅতের দাবি করে থাকত, তাহলে আমি ভবতাম তিনি তার দেখাদেখি এই কাজ করেছেন।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, নবুঅতের দাবিদার সেই ব্যক্তির বাপ-দাদার মধ্যে কেউ রাজা-বাদশাহ ছিল কি-না? তুমি উত্তরে বলেছ, ছিল না! আর জেনে রাখো, যদি তাঁর বংশে পূর্বে কেউ রাজা-বাদশাহ থাকত, তাহলে আমি ভাবতাম তিনি সেই হারানো রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য এই পথ ধরেছেন।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, নবুঅতের দাবি করার পূর্বে তাকে কি কখনো মিথ্যা বলতে দেখা গেছে? তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি। আর জেনে রাখো! যে ব্যক্তি মানুষের বিষয়ে মিথ্যা বলেন না, তিনি কীভাবে আল্লাহর বিষয়ে মিথ্যা বলবেন?
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাঁর অনুসরণ যারা করে তারা কি উচ্চ পর্যায়ের, উঁচু বংশের, সম্ভ্রান্ত বংশের মানুষ না সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষ? তুমি উত্তরে বলেছ, দুর্বল শ্রেণির মানুষ। আর জেনে রাখো! নবীদের অনুসরণ প্রথমে দুর্বল স্তরের মানুষেরাই করে থাকে।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাঁর অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে? তুমি উত্তরে বলেছ, দিন দিন বাড়ছে। আর জেনে রাখো! ঈমানের অবস্থা এমনই! দিন দিন তাঁর অনুসারী বাড়তেই থাকবে যতক্ষণ না পূর্ণতা পায়।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাঁর আনীত দ্বীনে প্রবেশ করার পর কেউ কি অসন্তুষ্ট হয়ে বের হয়ে আসে? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আর জেনে রাখো! ঈমানের স্বাদ যে একবার পায় সে তা থেকে ফিরে আসে না।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তিনি কি কখনো ওয়াদা বা চুক্তি ভঙ্গ করেছেন? তুমি বলেছ, না। আর জেনে রাখো! নবীগণ ওয়াদা ও চুক্তি ভঙ্গ করেন না।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তাদের সাথে তোমাদের যুদ্ধের ফলাফল কী? তুমি উত্তরে বলেছ যে, যুদ্ধের ফলাফল কুয়ার বালতির মতো, কখনো আমাদের হাতে আমরা পানি তুলেছি আর কখনো তার হাতে তিনি পানি ভর্তি করেছেন। আর জেনে রাখো! নবীদের সাথে প্রথম প্রথম এমনই হয়। কেননা মহান আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা করে থাকেন। কিন্তু শেষ সফলতা তাদেরই হয়।
হিরাক্লিয়াস: আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তিনি তোমাদের কী বিষয়ে আদেশ দেন? তুমি উত্তরে বলেছ যে, তার শিক্ষা হচ্ছে, শিরক করো না, এক আল্লাহর ইবাদত করো, যে সমস্ত শিরকী কথা ও কাজ তোমাদের বাপ-দাদারা করে আসছে তা পরিত্যাগ করো, ছালাত আদায় করো, সত্য বলো, যাকাত আদায় করো, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করো, হারাম সম্পর্ক থেকে নিজেকে পবিত্র রাখো। জেনে রাখো! যদি তাঁর শিক্ষা এগুলোই হয়, তাহলে একদিন আমার পায়ের নিচে যে মাটি আছে (বায়তুল মাক্বদিস) তাও তাঁর করতলগত হবে। আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম শেষনবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসার সময় হয়েছে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্যে আসবেন তা জানতাম না। যদি আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম যে, আমি তার নিকট পৌঁছাতে পারব তাহলে তাঁর নিকট পৌঁছার জন্য যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতাম আর আমি যদি তার কাছে হতাম, তাহলে তার পা ধুয়ে দিতাম।
বাদশা হিরাক্লিয়াসের এই ভবিষ্যদ্বাণী রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস-কেন্দ্রিক চতুর্থ ঘটনা। বায়তুল মুক্বাদ্দাসে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম উচ্চারিত হলো। তিনি অথবা তাঁর উম্মাত অচিরেই বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করবেন তা উক্ত ঘটনা থেকে প্রমাণিত হলো।
জেরুযালেমের জন্য আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরযুদ্ধ: রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাতে দুই দুইটা বড় যুদ্ধ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিচালনা করেছেন, বায়তুল মুক্বাদ্দাস বা শাম বা ফিলিস্তিন বিজয় করার জন্য। তার মধ্যে একটা বিখ্যাত যুদ্ধ হচ্ছে মুতার যুদ্ধ।
নিম্নে গুগল ম্যাপ থেকে মুতা যুদ্ধের জায়গা থেকে জেরুযালেমের দূরত্ব দেখানো হলো।
উপরের ম্যাপে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মুতা থেকে মসজিদে আক্বছার দূরত্ব মাত্র ১৫০ কিলোমিটার। তথা মুতার যুদ্ধ যেখানে ছাহাবীগণ রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় লড়াই করেছিলেন, সেটা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অতি নিকটে। এটাই ছিল মুসলিমদের ইতিহাসে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করার জন্য প্রথম যুদ্ধ। যুদ্ধের সার-সংক্ষেপ নিম্নরূপ:
রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের অধীনে এই অঞ্চলের গভর্ণনের দায়িত্ব পালন করত শুরাহবিল ইবনু আমর আল-গাচ্ছানী। তার নিকটে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে। সে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতকে হত্যা করে। আর সমগ্র পৃথিবীতে নিয়ম এটাই যে, দূতকে হত্যা করতে হয় না। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও কখনো কোনো দূতকে হত্যা করেননি। যখন সে আর্ন্তজাতিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দূতকে হত্যা করল, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হলেন এবং অত্যন্ত দুর্বল শক্তির অধিকারী হওয়ার পরও, অত্যন্ত দুর্বল সাম্রাজ্যের অধিকারী হওয়ার পরও তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন। আর সেই সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সেনাপতি নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি বললেন, প্রথমে দায়িত্ব পালন করবে যায়েদ বিন হারেছা, তারপরে দায়িত্ব পালন করবে জা‘ফর ইবন আবূ তালেব, তারপরে দায়িত্ব পালন করবে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা। আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরপর তিনজন সেনাপতি নির্ধারণ করা প্রমাণ করে তাদের শহীদ হওয়ার বিষয়টি তিনি আগেই জানতে পেরেছিলেন। আর ছাহাবীরাও হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন যে, তারা এই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করবেন।
মুতার যুদ্ধে মুসলিমরা এক ভয়ংকর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তাদের বিপরীতে প্রায় ২ লক্ষ রোমান সৈন্যবাহিনী ছিল। আর মুসলিমরা ছিল মাত্র ৩ হাজার। ৩ হাজার মানুষ হাতে গণনা করা যায়। আর কোথায় ২ লক্ষ! দুই সেনাবাহিনীর বিপরীতে ৩ হাজার মুসলিমের এই অসম যুদ্ধে প্রথমে যায়েদ ইবনে হারেছা শাহাদাত বরণ করেন, তারপরে জা‘ফর ইবনু আবূ তালেব শাহাদাত বরণ করেন, তারপরে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাও শাহাদাত বরণ করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার ক্ষেত্রে বলা হয় যে, যখন মুসলিমরা একটু ভয় ভয় পাচ্ছিল, ভীত ভীত হচ্ছিল; বিশাল ১ লক্ষ মানুষের বিশাল বাহিনী দেখে আর মাত্র ৩ হাজার মুসলিমের সৈন্য দেখে, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা বলছিলেন, يَا قَوْمِ، وَاَللَّهِ إنَّ الَّتِي تَكْرَهُونَ، لَلَّتِي خَرَجْتُمْ تَطْلُبُونَ الشَّهَادَةُ، وَمَا نُقَاتِلُ النَّاسَ بِعَدَدِ وَلَا قُوَّةٍ وَلَا كَثْرَةٍ، مَا نُقَاتِلُهُمْ إلَّا بِهَذَا الدِّينِ الَّذِي أَكْرَمَنَا اللَّهُ بِهِ، فَانْطَلِقُوا فَإِنَّمَا هِيَ إحْدَى الْحُسْنَيَيْنِ إمَّا ظُهُورٌ وَإِمَّا شَهَادَةٌ ‘হে আমার জাতি, যেই জিনিসটা তোমরা অপছন্দ করছ, ঐ জিনিসের আকাঙ্ক্ষাতেই তো তোমরা বের হয়েছ। তোমরা তো শাহাদাত কামনা করো। শোনো, আমরা যুদ্ধ করি না সংখ্যা দিয়ে, আমরা যুদ্ধ করি না শক্তি দিয়ে, আমরা যুদ্ধ করি না আধিক্যতা দিয়ে; বরং আমরা যুদ্ধ করি এই দ্বীন দিয়ে, যেই দ্বীন দিয়ে আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। তোমরা সামনে এগিয়ে যাও! তোমাদের জন্য দুইটা কল্যাণকর জিনিসের একটি অপেক্ষা করছে। হয় বিজয়, না হয় শাহাদাত’।[1]
জা‘ফর ইবনে আবূ তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর ক্ষেত্রে সঠিক সনদসহ পাওয়া যায় যে, أَنَّهُ أَخَذَ اللِّوَاءَ بِيَمِيْنِهِ فَقَاتَلَ بِهِ حَتَّى قُطِعَتْ يَمِينُهُ، فَأَخَذَ الرَّايَةَ بِيَسَارِهِ فَقُطِعَتْ يَسَارُهُ، فَاحْتَضَنَ الرَّايَةَ وَقَاتَلَ حَتَّى قُتِلَ رَحِمَهُ اللَّهُ ‘যখন তিনি যুদ্ধের মাঠে নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করলেন, ডান হাতে (রায়াহ) ঝাণ্ডা গ্রহণ করলেন এবং তা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন, এক পর্যায়ে শত্রুর আক্রমণে তাঁর ডান হাত কেটে যায়। তখন তিনি বাম হাতে ঝাণ্ডা উত্তোলন করলেন। শত্রুর আক্রমণে তার বাম হাতও কেটে গেল। তখন তিনি (কর্তিত দুই হাত একত্রিত করে) সেই ঝাণ্ডা বুকে ধারণ করে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। এভাবে তিনি শহীদ হয়ে যান’।[2]
পরবর্তীতে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, তাঁর শরীরে ৭০ এর অধিক তিরের আঘাত এবং তরবারির আঘাত পাওয়া গিয়েছিল। ৭০ এর অধিক তিরের আঘাত এবং তরবারির আঘাত নিয়েও তিনি যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করেননি, যুদ্ধের মাঠ থেকে ঝাণ্ডা পরিত্যাগ করেননি। এটাই ছিল তাদের ঈমান।
যখন তিনজন সেনাপতি মারা যান, তখন খালেদ ইবনে ওয়ালীদ সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সেইদিন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় বসে বলছেন,أَخَذَ الرَّايَةَ زَيْدٌ فَأُصِيبَ ثُمَّ أَخَذَهَا جَعْفَرٌ فَأُصِيبَ ثُمَّ أَخَذَهَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيبَ وَإِنَّ عَيْنَيْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَتَذْرِفَانِ ثُمَّ أَخَذَهَا خَالِدُ بْنُ الوَلِيدِ مِنْ غَيْرِ إِمْرَةٍ فَفُتِحَ لَهُ ‘শোনো! যায়েদ বিন হারেছা ঝাণ্ডা বহন করেন, অতঃপর তিনি মারা যান, তারপর জা‘ফর ইবনু আবূ তালেব এই ঝাণ্ডা বহন করেন, তিনিও শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই ঝাণ্ডা বহন করেন তিনিও শাহাদাত বরণ করেন, এসময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। তারপর খালেদ ইবনে ওয়ালীদ ঝাণ্ডা গ্রহণ করেন’।[3] অন্য বর্ণনায় আছে, حَتَّى أَخَذَ الرَّايَةَ سَيْفٌ مِنْ سُيُوفِ اللَّهِ ‘তারপর ঝাণ্ডা গ্রহণ করেন আল্লাহর তরবারিগুলোর মাঝে একটি তরবারি। সেই তরবারি হচ্ছে খালেদ ইবনে ওয়ালীদ’।[4]
বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের জন্য মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় যুদ্ধ ছিল তাবূকের যুদ্ধ। মুতার যুদ্ধে একপ্রকার পরাজয় বরণ করে যখন রোমানরা পূর্ণ শক্তিতে মদীনার উপর আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তাদেরকে মদীনার বাইরে আটকাতে হবে। যদি মদীনার বাইরে আটকাতে না পারি, তাহলে ইসলামের এই ছোট্ট ক্ষুদ্র সাম্রাজ্য ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে। এজন্য রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রস্তুতিস্বরূপ মদীনার অসহায়, দরিদ্র মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিলেন দান করার জন্য, ছাদাক্বা করার জন্য। সেইদিন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলছেন,
أمرَنا رسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يومًا أن نتصدَّقَ فوافقَ ذلِكَ مالًا عندي فقلتُ اليومَ أسبِقُ أبا بَكْرٍ إن سبقتُهُ يومًا فَجِئْتُ بنصفِ مالي فقالَ رسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ما أبقيتَ لأَهْلِكَ قلتُ مثلَهُ قالَ وأتى أبو بَكْرٍ t بِكُلِّ ما عندَهُ فقالَ لَهُ رسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ما أبقَيتَ لأَهْلِكَ قالَ أبقَيتُ لَهُمُ اللَّهَ ورسولَهُ قلتُ لا أسابقُكَ إلى شيءٍ أبدًا.
আজকে তাবূকের যুদ্ধের জন্য যখন আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দানের আদেশ করলেন, এসময় আমার কাছে যথেষ্ট সম্পদ ছিল। তখন আমি মনে মনে বললাম, ‘যদি আমি কোনো দিন আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অতিক্রম করতে পারি, তবে আজকে আমি আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে অতিক্রম করতে পারব’। এই মনে করে আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে উপস্থিত হলাম। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ’? আমি উত্তরে বললাম, ‘যে পরিমাণ নিয়ে এসেছি, সে পরিমাণ বাড়িতে রেখে এসেছি। তথা অর্ধেক সম্পদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছি’। এরপর আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু আসলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবূ বকর! তুমি তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ’? তখন আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘আমি তাদের জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে রেখে এসেছি’! সেইদিন আমি উমার বললাম, ‘আমি কখনোই কোনো কিছুতেই আপনার অগ্রগামী হতে পারব না’।[5]
অতএব, তাবূকের যুদ্ধ এবং মুতার যুদ্ধ, এই দুইটা যুদ্ধ মক্কার কোনো কাফেরদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়নি, মক্কার আশেপাশের কোনো গোত্রের সাথে সংঘটিত হয়নি বা আরব অঞ্চলের কোনো গোত্রের সাথে সংঘটিত হয়নি; বরং রোমান খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছে। যাদের হেডকোয়ার্টার ছিল জেরুযালেম। সুতরাং জেরুযালেম বিজয়ের জন্য মুসলিমদের প্রথম দুটি যুদ্ধ হচ্ছে মুতা ও তাবূকের যুদ্ধ।
(চলবে)
[1]. সীরাত ইবনে হিশাম, ২/৩৭৫; উমদাতুল ক্বারী, ১৪/৩০৮।
[2]. ইবনু সাইয়্যিদিন নাস, উয়ূনুল আছার, ২/১৯৮।
[3]. ছহীহ বুখারী, হা/১২৪৬।
[4]. ছহীহ বুখারী, হা/৪২৬২।
[5]. আবূ দাঊদ, হা/১৬৭৮, হাসান।