অন্যান্য খলীফার শাসনামলে বায়তুল মুক্বাদ্দাস: শ্রেষ্ঠ চার খলীফার শাসনকে বলা হয় খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামল, যার ব্যাপ্তি প্রায় ৪০ বছর। তারপর উমাইয়া খেলাফাত, যার ব্যাপ্তি প্রায় ১৫০ বছর। তারপর আব্বাসীয় খেলাফত, যার ব্যাপ্তি প্রায় ৬০০ বছর। আব্বাসীয় খেলাফত আমলের একটি যুগ শক্তিশালী যুগ আরেকটি যুগ দুর্বল যুগ। আব্বাসীয় খেলাফতের শক্তিশালী যুগে আমরা খলীফা হারূন-অর-রশীদ, খলীফা মামূনুর রশীদের নাম জানি এবং শুনেছি। আর আব্বাসীয় খেলাফতের দুর্বল যুগে আব্বাসীয় খলীফার কোনো শক্তি, কোনো ক্ষমতা, কোনো দাপট, কোনো শৌর্য-বীর্য ছিল না। নামকাওয়াস্তে তাদেরকে খলীফা রাখা হতো আর শক্তি ক্ষমতা থাকত আঞ্চলিক বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর বা সাম্রাজ্যগুলোর হাতে। তার মধ্যে প্রথমদিকের সাম্রাজ্য হচ্ছে- ফাতেমীয় শীআ, উবাইদী, বাতেনী রাজ্য। দীর্ঘকালব্যাপী আব্বাসীয় খেলাফাতে তাদের প্রভাব ছিল। তারপরে এসেছে সেলজুক সাম্রাজ্য। তার পরে এসেছে আইয়ূবী। তারপরে মামলূকদের সাম্রাজ্য। এই তিন চারটা আঞ্চলিক শক্তির অধীনে তখন আব্বাসীয় খেলাফত পরিচালিত হতো নামকাওয়াস্তে। যেমন এখন ইংল্যান্ডের রাজা আছে, রাণী আছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। এরকম বহু দেশে রাজা-রাণী প্রথা এখনো অব্যাহত আছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাদের কাছে কোনো ক্ষমতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো ক্ষমতা তাদের কাছে নেই। ঠিক এরকম একটা অবস্থায় চলে গিয়েছিল আব্বাসীয় খেলাফত। নামকাওয়াস্তে খলীফা পদ আছে, তবে সকল ক্ষমতা বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির হাতে।
এই খেলাফত আমলগুলোর মধ্যে বায়তুল মুক্বাদ্দাসকেন্দ্রিক সবচেয়ে বেশি খেদমত হয় উমাইয়া শাসনামলে। খুলাফায়ে রাশেদীনের পর যখন উমাইয়ারা ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন দারুল খেলাফাহ (রাজধানী) মদীনা থেকে পরিবর্তন হয়ে সিরিয়ার দামেস্কে চলে আসে। কেননা মুআবিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহু খুলাফায়ে রাশেদীনের আমল থেকেই দীর্ঘদিন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন। তাই তার পরবর্তী বংশধরদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ও শক্তিশালী শহর ছিল দামেস্ক। আর তাঁর পরবর্তী বংশধরদের দারুল খেলাফাহ বা রাজধানী ছিল দিমাস্ক। মানচিত্রে দেখলে দেখবেন যে, দামেস্ক থেকে অতি নিকটে হচ্ছে ফিলিস্তীন বা জেরুযালেম। বরং তৎকালীন যুগে আজকের ফিলিস্তীন, লেবানন, জর্ডান ও ইসরাঈল সবই সিরিয়া বা শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এজন্য উমাইয়া শাসন আমলে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের যত খেদমত হয়েছে, যত সেবা হয়েছে, যত উন্নতি ঘটেছে- তা অন্য কোনো শাসন আমলে ঘটেনি। কেননা আব্বাসীয় খেলাফতের দারুল খেলাফাহ ছিল বাগদাদ। যেটা জেরুযালেম থেকে দূরে কিন্তু দামেস্ক জেরুযালেম বা বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে কাছে।
আরেকটি কারণে উমাইয়া শাসনামলে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খেদমত সবচেয়ে বেশি হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বিদ্রোহের কারণে তার অধীনে হেজায থাকার ফলে উমাইয়ার অনেক বড় শাসকগণ মক্কা এবং মাদীনা থেকে দূরে ছিলেন। তাই তারা তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হিসেবে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের প্রচুর খেদমত করার চেষ্টা করেছেন।
তাদের খেদমতের একটা বড় অংশ ছিল পুরো মিশরের টানা সাত বছরের পুরো রাজস্ব আয় বায়তুল মুক্বাদ্দাস বা জেরুযালেমের উন্নয়নে ব্যয় করা। আর তখনই কুব্বাতুছ ছাখরা বা ডোম অব দ্য রক নির্মিত হয়। আমরা যে স্বর্ণালি গম্বুজটি দেখতে পাই, উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ানের শাসন আমলেই তা নির্মিত হয়। উল্লেখ্য, অনেকে এখন মনে করে যে, কুব্বাতুছ ছাখরাই হয়তো বায়তুল মুক্বাদ্দাস, আবার অনেকে মনে করে যে, না কুব্বাতুছ ছাখরা হয়তো বায়তুল মুক্বাদ্দাস নয়। সঠিক মত হচ্ছে, সরেজমিন থেকে উঁচু প্রাচীরঘেরা পুরো এরিয়াটাই পবিত্র ভূমির অন্তর্ভুক্ত। যেখানে কুব্বাতুছ ছাখরা আছে, গীর্জা আছে, মসজিদে আক্বছা আছে তার সবগুলোই পবিত্র ভূমির অন্তর্ভুক্ত।
বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পতন: আব্বাসীয় শাসনামলের দুর্বল সময়ে যখন ফাতেমীয় উবাইদিয়াদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি ছিল, তখনই মূলত মসজিদে আক্বছা পতনের সূচনা হয়। তারা জামিআতুল আযহার নির্মাণ করেছিল শীআ মাযহাব প্রচার করার জন্য। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায় যে, যখন তারা মিশরের শাসনভার গ্রহণ করে, তখন তারা মসজিদের দরজায় দরজায়, বাড়ির দরজায় দরজায় উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু, আবূ বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর নামে গালিগালাজ, মিথ্যা অপবাদ লিখে দিয়ে আসত, ঝুলিয়ে দিয়ে আসত এবং মানুষকে গালিগালাজ করতে বাধ্য করত। সুন্নী মাযহাবের বড় বড় আলেম-উলামাকে হত্যা করা, যবেহ করা, নির্যাতন করা, যুলুম করা এগুলো তাদের চিরাচরিত স্বভাবের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুরো ক্রুসেডের যুদ্ধের যারা ইতিহাস পড়বেন তারা সবাই দেখবেন যে, ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মুনাফেক্বী শীআরাই করেছে।
ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী মুজাহিদ নেতা ইমাদুদ্দীন জিনকি ও নূরুদ্দীন জিনকির মতো বড় বড় শাসককে তারা হত্যা করেছে। সবসময় তারা ক্রুসেডারদের সাথে আঁতাত করেছে গোপনে। যাহোক, মিশরের মাটিতে যেমন ফাতেমীয় উবাইদিয়া শীআদের উত্থান হয়, ঠিক তেমনি তার পাশাপাশি তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমন্তঘেঁষা অঞ্চলে সেলজুক সালতানাতের উত্থান হওয়া শুরু করে।
সেলজুক সালতানাত বা সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্থান হলে স্বয়ং আব্বাসীয় খলীফা আল-কায়েম বি আমরিল্লাহ সেলজুক সুলতানকে আমন্ত্রণ জানান বাগদাদ দখল করে এই শীআদের নিকট থেকে তাকে পরিত্রাণ দিতে। সেলজুকদের মহান সুলতান আলাপ আরসালান, তিনি বাগদাদ গিয়ে শীআদের নিকট থেকে বাগদাদকে উদ্ধার করত: পুরো মুসলিম বিশ্বে সেলজুক সালতানাতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর সেলজুক সালতানাতের মাধ্যমে আব্বাসীয় খেলাফাত পুনরায় সুন্নীদের কর্তৃক প্রভাবিত এবং সারা মুসলিম বিশ্বে সঠিক আক্বীদা এবং সঠিক আমলের প্রচারের একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
ক্রুসেডারদের ফিলিস্তীন আক্রমণের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয় মূলত সেলজুক সুলতানদের তুরস্ক আক্রমণের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, আজকের তুরস্ক এবং তখনকার কনস্টান্টিনেপোল যা বাইজাইটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী তখনো মুসলিমদের দ্বারা বিজিত হয়নি; বরং ক্রুসেডারদের ক্রুসেডের পুরো সময়ের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তুরস্কের মাটি।
সেলজুক সালতানাতের মহান সম্রাট আলাপ আরসালান, তিনি এই কনস্টান্টিনোপোল বিজয় করার জন্য অভিযান পরিচালনা করেন। সেই বিখ্যাত যুদ্ধকে বলা হয় মেলাযকুর্দের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয়। বাদশাহ রোমান্স গ্রেফতার হন। যদিও আলাপ আরসালান কনস্টান্টিনোপোল বিজয় করতে পারেননি, কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধের খবর যখন ইউরোপে পৌঁছে যায়, তখন তারা আশঙ্কা করে যে, কনস্টান্টিনোপোলের পতন হয়ে যেতে পারে। এই পতনের আশঙ্কা থেকেই মূলত ক্রুসেড আরম্ভ হয়। তারা কনস্টান্টিনোপোল রক্ষায় মুসলিমদের উপর পাল্টা আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, তৎকালীন ইউরোপে রাজা-বাদশাদের তেমন কোনো মূল্য ছিল না। সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ছিল গীর্জার পাদরিদের। গীর্জার পাদরিরা চাইলে যে-কোনো শাসককে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারতেন। গীর্জার শাসকেরা চাইলে যে-কোনো শাসককে ক্ষমতায় বসাতে পারতেন। এই অবস্থা ছিল ফ্রান্স, ইতালি, ব্রিটেন ও জার্মান থেকে শুরু করে সকল বড় ইউরোপিয়ান দেশগুলোর।
সেই সময়ের গীর্জার পাদরিদের উসকানিতেই মূলত ক্রুসেডের শুরু হয়। ক্রুসেডাররা দুইটা রাস্তা দিয়ে আসত। স্থলপথে আসলে তুরস্ক দিয়ে আসত; তুরস্ক দিয়ে ভূমধ্যসাগরের ধার হয়ে ত্রিপলি, আক্কা, হাইফা, তেল আবিব, গাজা ইত্যাদি ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চল দিয়ে ফিলিস্তীনে প্রবেশ করত। অথবা দ্বিতীয় রাস্তা হলো সরাসরি পানিজাহাজে ভূমধ্যসাগরের কোনো এক তীরে অবতরণ করে ফিলিস্তীনে প্রবেশ করা।
এখানে আরো একটি বিষয় স্মর্তব্য যে, তৎকালীন সময়ের ইউরোপ আজকের মতো উচ্চশিক্ষিত উন্নত ইউরোপ ছিল না। তখন মূলত ছিল ইউরোপের অন্ধকার যুগ। যখন বাগদাদ আলোকোজ্জ্বল ছিল। গ্রানাডা জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র ছিল, তখন ইউরোপ ছিল অন্ধকার। ছিল গরীব, মিসকীন, ফকীর, গণ্ডমূর্খ ও জাহেল। পাদরিদের উসকানিতে এই ধরনের হাজারো-লাখো গণ্ডমূর্খ জাহেল অশিক্ষিত, অসভ্য, বর্বরকে পাঠানো হয়েছিল মুসলিমদেরকে হত্যা করার জন্য। প্রথম ক্রুসেডে তাদেরকে পরাজিত হতে হয়। প্রথম ক্রুসেডে ইউরোপ কোনো প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী পাঠায়নি। জার্মান, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি প্রভৃতি দেশের অশিক্ষিত, অসভ্য, মূর্খ, জাহেল, বর্বর, কৃষক শ্রেণির মানুষদেরকে স্রোতের পালের মতো পাঠানো হয়েছিল প্রথম ক্রুসেড যুদ্ধে। তখন এই সেলজুক সালতানাতেরই একজন সম্রাট ছিলেন কিলিজ আরসালান। তিনি প্রথম ক্রুসেডে তাদেরকে একদম কচুকাটা করে শেষ করেছিলেন। ভয়ংকরভাবে পরাজিত করেছিলেন। ক্রুসেডাররা ভাবল এরকম সাধারণ মানুষকে উসকিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে লাভ নেই। প্রশিক্ষণের দরকার আছে। তখন তারা প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনী তৈরি করল, যাদেরকে বলা হতো নাইট যোদ্ধা।
প্রশিক্ষিত নাইট যোদ্ধাদের মাধ্যমে শুরু হয় দ্বিতীয় ক্রুসেড। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শক্তিশালী সেলজুক সালতানাত যেখানে প্রথম ক্রুসেড যুদ্ধে ইউরোপিয়ানদের চরমভাবে নাকানিচুবানি খাইয়ে বিতাড়িত করেছিল; সেই সেলজুক সালতানাতের এমনভাবে অধঃপতন হলো, যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ভাইয়ে ভাইয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আলাপ আরসালানের পরবর্তী সন্তানেরা তাঁর পৌত্রেরা, চাচা-ভাতিজা, ভাই-ভাই এমনভাবে গণ্ডগোল এবং মারামারি শুরু হয়ে গেল যে, কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা অবশিষ্ট থাকল না। কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা বাকী না থাকার কারণে হালাব (সিরিয়ার একটা শহর), হালাব-এর একজন আমীর; হিমস (সিরিয়ার একটা শহর) হিমস-এর একজন আমীর; দামেস্ক (সিরিয়ার একটা শহর) সেটার একজন আমীর। ত্রিপলি, (এটা লিবিয়ার ত্রিপলি নয়। সিরিয়ারই ত্রিপলি) তার একজন আমীর। আক্কা আলাদা শহর, আলাদা আমীর। হাইফা আলাদা শহর, আলাদা আমীর। এভাবে পুরো সিরিয়া যাবতীয় কেন্দ্রীয় শাসন থেকে মুক্ত হয়ে খণ্ডবিখণ্ড আকার ধারণ করল। শুধু তাই নয়, এক আমীর আরেক আমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ চলতে থাকে; কোনো কেন্দ্রীয় শাসন নেই। এই রকম দুর্বল সময়ে দ্বিতীয় ক্রুসেড আসে এবং দ্বিতীয় ক্রুসেডাররা বিনা বাধায় তুরস্ক থেকে সমুদ্রের তীর হয়ে একদম বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত কোনো যুদ্ধ ছাড়াই, কোনো সমস্যা ছাড়াই বায়তুল মুক্বাদ্দাস দখল করে নেয় এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পতন ঘটে।
এটা ছিল ১০৯৯ খৃস্টাব্দ, মোতাবেক ৪৯২ হিজরী; ১৫ই জুন, শা‘বান মাস। ক্রুসেডাররা জেরুযালেমে প্রবেশ করে এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পতন হয় এবং ৭০ হাজারেরও বেশি মুসলিমদেরকে তারা একই দিনে যবেহ করে জেরুযালেমে। ৭০ হাজারেরও অধিক মুসলিমকে তারা একদিনে যবেহ করেছে ফিলিস্তীনের জেরুযালেমে। ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে, ক্রুসেডারদের ঘোড়ার পাগুলো মুসলিমদের রক্তের স্রোতে ডুবে গিয়েছিল।
বায়তুল মুক্বাদ্দাস উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা: বায়তুল মুক্বাদ্দাস পতনের পর রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে ৫০৫ হিজরীতে সর্বপ্রথম উদ্ধার যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। যেহেতু বাগদাদ তখন মারকাযুল ইলম বা জ্ঞানের কেন্দ্র ছিল এবং বাগদাদে মাদরাসা নিজামিয়া ছিল, মানুষজনের মাঝে জ্ঞানের চর্চা ছিল। মানুষজনের চাপে পরে তৎকালীন বাগদাদের নামকাওয়াস্তে আব্বাসী খলীফা কেন্দ্রীয় শাসনবিহীন রাজা-বাদশাহদেরকে ডেকে একটি রাজনৈতিক ঐক্য করেন। রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তিতে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। এই রাজনৈতিক ঐক্য সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্রই মুনাফেক্বী দেখা দেয়। কেননা এটি জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ছিল না, আল্লাহর সন্তুষ্টি ছিল না, বায়তুল মুক্বাদ্দাস অর্জনের ইচ্ছা ছিল না; নিজের ক্ষমতা টিকানোর স্বার্থ ছিল, নিজের দেশ বা নিজের মাতৃভূমি বা নিজের ক্ষমতা, নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি ধরে রাখার স্বার্থ ছিল।
বায়তুল মুক্বাদ্দাস মুক্ত করতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কোনো জাতীয়তাবাদী ধারা, জাতীয়তাবাদী মতবাদ বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ দিয়ে জেরুযালেম বিজয় সম্ভব নয়।
বায়তুল মুক্বাদ্দাস উদ্ধারের পটভূমি: বায়তুল মুক্বাদ্দাস উদ্ধারের সূচনা মূলত সেলজুক সুলতানদের আমলেই শুরু হয়। যখন তারা আব্বাসীয় খলীফার অনুরোধে বাগদাদ থেকে শীআদের বিদায় করলেন, তখন আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোকে সুন্নী মাযহাবের জ্ঞান ছড়ানোর জন্য বাগদাদে মাদরাসা নিজামিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়।
শীআ, উবাইদী, ফাতেমীয়রা যেমন জামি‘আতুল আযহার প্রতিষ্ঠা করেছিল শীআ মাযহাম প্রচারের জন্য, তেমন তাদের কাছ থেকে বাগদাদকে মুক্ত করার পর, সঠিক আক্বীদা, সঠিক আমল, সঠিক বিশ্বাস প্রচার করার জন্য মাদরাসা নিজামিয়া প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশাল লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং মাদরাসা নিজামিয়া থেকে পরবর্তীতে বড় বড় আলেম-ওলামা, বড় বড় মুহাদ্দিছের আবির্ভাব হয়েছে। তারিখে দিমাস্কের লেখক ইবনু আসাকের, গাযালী, আল-ইয বিন আব্দুস সালামের মতো বড় বড় আলেম-ওলামা এবং ঐতিহাসিকদের জন্ম, উত্থান এবং পড়াশুনা এই মাদরাসা নিজামিয়ায়। মাদরাসা নিজামিয়ার এই আমল-আখলাক এবং জ্ঞানের চর্চা, সঠিক আক্বীদা এবং আমলের চর্চা থেকেই মূলত পরবর্তীতে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো মুজাহিদ তৈরির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়।
যে নিজামুল মুলক মাদরাসা নিজামিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন তিনি সেলজুক সালতানাতের একজন মন্ত্রী ছিলেন। যাকে ইসলামের ইতিহাসের মহান মন্ত্রী বলা হয়, সবচেয়ে মহান মন্ত্রী, ওয়াজিরে ‘আলা। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার, তাক্বওয়াবান, আল্লাহভীরু মানুষ। তার খলীফা মালিক শাহও পরহেযগার, তাক্বওয়াবান, আল্লাহভীরু মানুষ। এই দুইজনের যিনি নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন নূরুদ্দীন জিনকির দাদা এবং ইমাদুদ্দীন জিনকির পিতা।
তথা সেলজুক সালতানাতের একজন কর্মচারী বা নিরাপত্তারক্ষীর বংশধর থেকে আল্লাহ সুবহান ওয়া তাআলা ক্রুসেডারদের পতনের যাত্রাটা শুরু করেন। ইমাদুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ মুসেলের আমীর মওদূদের সাথে থেকে জেরুযালেম উদ্ধারের প্রথম রাজনৈতিক ঐক্যের জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। মুসেলের আমীর মওদূদের মৃত্যুর পর ইমাদুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ নিজে মুসেলের আমীর হন। তাঁর অন্তরের ইখলাছ, তাঁর অন্তরের নিঃস্বার্থ চাওয়া শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বায়তুল মুক্বাদ্দাস উদ্ধার করা। ইমামুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ সামান্য মুসেল, সিরিয়ার শহর মুসেলের আমীর হয়ে তিনি দুইটা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। যে দুইটা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হলে বায়তুল মুক্বাদ্দাস মুক্ত করা সম্ভব নয়:
(১) সিরিয়ার বিভিন্ন শহরভিত্তিক শতধা বিভক্ত ইমারতগুলোকে এক শাসনব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মুসলিমদের ঐক্য হচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতার ঐক্য। দুই দল এক হওয়া ঐক্য নয়। দুই আলেম এক হওয়া ঐক্য নয়। একক শাসনব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হওয়াই ঐক্য।
(২) সিরিয়ার সকল শহরকে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অধীনস্ত করার পরপরই মিশর আর সিরিয়াকে একত্রিত করতে হবে। যদি মিশর ও সিরিয়াকে এক শাসনের অন্তর্ভুক্ত না করা যায়, তাহলে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করা সম্ভব নয়। আজকেও আপনি ম্যাপ খুলে দেখেন যে, তৎকালীন সিরিয়া বা আজকের জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়া প্রভৃতি দেশ যদি এক না হয়, পাশাপাশি তাদের সাথে মিশর যদি এক না হয়, তাহলে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করা সম্ভব নয়।
ইমাদুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ এই পরিকল্পনা গ্রহণ করত সিরিয়ার বিভিন্ন শহরগুলোকে তার অধীনস্ত করা শুরু করে দিলেন। ইমাদুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ-এর পরে তাঁর ছেলে নূরুদ্দীন জিনকি এই একই ঝাণ্ডা বহন করলেন। একই টার্গেট। মিশর সিরিয়া এক শাসনের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারপর বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করতে হবে, নতুবা সম্ভব নয়। নূরুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ মুসলিমদেরকে উজ্জীবিত রাখার জন্য এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করার মানসিক উদ্দীপনা তৈরি করার জন্য একটা বিশাল মিম্বার তৈরি করলেন। মিম্বার তৈরি করে ঘোষণা দিলেন- যেদিন বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় হবে, সেদিন এই মিম্বার বায়তুল মুক্বাদ্দাসে স্থাপন করা হবে। এই মিম্বার মানসিকভাবে মুসলিমদেরকে উজ্জীবিত রাখতে সহযোগিতা করে। নূরুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ মোটামোটি সিরিয়ার বড় শহরগুলোকে নিজের অধীনে করে নিয়েছিলেন। যেহেতু তাঁর পিতা এই কাজ শুরু করেছিলেন, তিনিও একই পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। বাকী ছিল শুধু মিশর। আর মিশরে তখন উবাইদী শীআ এদের শাসন অব্যাহত আছে। বাগদাদ মুক্ত হয়েছে কিন্তু মিশর মুক্ত হতে পারেনি। তখন নূরুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ তাঁর প্রধান সেনাপতি আসাদুদ্দীন শেরকোকে পাঠালেন মিশরকে মুক্ত করার জন্য এই মুনাফেক্ব শীআদের কবল থেকে। আসাদুদ্দীন শেরকো তাঁর ভাতিজা ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে সাথে করে নিয়ে মিশর গেলেন শীআ, উবাইদী, ফাতেমীদের কবল থেকে মিশরকে উদ্ধার করার জন্য। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও, পরবর্তীতে তিনি সফল হন। সফল হওয়ার পর তিনি মিশরে ২৫ বছরের যুবক ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীকে মিশরের শাসক নির্ধারণ করে নূরুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ-এর নিকটে ফিরে আসেন। ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুল্লাহ মিশরের শাসনভার গ্রহণ করার পরে উবাইদী, শীআ ফেতনাকে জড় থেকে সমূলে উৎখাত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মিশরকে শীআ মুক্ত করার এই সংস্কার কাজের দুই তিন বছর যেতে না যেতেই প্রধান নেতা নূরুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। নূরুদ্দীন জিনকি রাহিমাহুল্লাহ-এর মৃত্যুর পরে একদল কুচক্রী মহল তাঁর ১০/১১ বছরের সন্তানকে শাসক বানিয়ে খেলাফতের ঘোষণা দিয়ে দেয়। তখন ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুল্লাহ বিপদে পড়ে যান। কেননা ১০ বছরের শিশুর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না। আশেপাশের কুচক্রী মহল দ্বারা প্রভাবিত সে যে-কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর বাস্তবে হলোও তাই। ক্রুসেডার ও শীআদের যৌথ চক্রান্তে সিরিয়ার মসনদ থেকে ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী-বিরোধী প্রচারণা শুরু হয়ে গেল। অবস্থা বেগতিক দেখে ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুল্লাহ মিশর থেকে বিশাল বাহিনী নিয়ে সিরিয়া অভিযান পরিচালনা করেন। ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুল্লাহ পুনরায় পুরো সিরিয়া আর পুরো মিশরকে নিজের এক শাসনের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। সিরিয়া এবং মিশর যখন এক শাসনের অন্তর্ভুক্ত শেষে এখন কাজ শুধু বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয় করা।
(চলবে)
* ফাযেল, দারুল উলূম দেওবান্দ, ভারত; বি. এ (অনার্স), মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব; এমএসসি, ইসলামিক ব্যাংকিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ইউনিভার্সিটি অফ ডান্ডি, যুক্তরাজ্য।