আপনি কি কখনও এমনটা ভেবেছেন, কেন আজকাল মানুষ এত বিভ্রান্ত, আতঙ্কিত বা বিভক্ত? কেন আমরা নিজেরাই নিজের শত্রু হয়ে উঠছি? এসবের পেছনে রয়েছে এক আধুনিক যুদ্ধের ধরন, যাকে বলা হয় ‘ফিফথ জেনারেশন ওয়ারফেয়ার’ (Fifth Generation Warfare) বা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ।
আজকের দুনিয়ায় যুদ্ধ আর আগের মতো হয় না। আগের যুদ্ধ মানেই ছিল সেনাবাহিনী, বন্দুক, ট্যাংক, ঢাল, তলোয়ার আর রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্তু এখন যুদ্ধ হয় আরও সূক্ষ্ম, নিঃশব্দ এবং অদৃশ্য উপায়ে। আপনি হয়তো প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু কোনো গুলি বা রক্তপাত ছাড়াই। আসলে আপনার বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস ও চিন্তাশক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় হচ্ছে। এটাই হলো পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ। আপনি হয়তো বুঝতেই পারছেন না, অথচ আপনি এই যুদ্ধের শিকার হয়ে পড়ছেন প্রতিদিন। এই যুদ্ধের নাম ‘পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ’। এখন সংক্ষিপ্তাকারে একে একে সকল প্রজন্মের যুদ্ধ নিয়ে কিছু বলা যাক।
(ক) প্রথম প্রজন্মের যুদ্ধ (1st Generation Warfare):
প্রথম প্রজন্মের যুদ্ধ ছিল খুবই সোজাসাপ্টা ও ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির। এতে দুই পক্ষের সেনাবাহিনী সারিবদ্ধ হয়ে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করত। বন্দুক, ঢাল, তলোয়ার, বর্শা এসব ছিল যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র। যুদ্ধের কৌশল ছিল শৃঙ্খলা ও সংখ্যায় এগিয়ে থাকা। সেই যুগের যুদ্ধগুলো মূলত রাজতন্ত্রের মধ্যে সংঘটিত হতো। যেমন- নেপোলিয়নের যুদ্ধ বা ইউরোপের উপনিবেশিক যুদ্ধগুলো ছিল এই প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত।
(খ) দ্বিতীয় প্রজন্মের যুদ্ধ (2nd Generation Warfare):
দ্বিতীয় প্রজন্মের যুদ্ধের সময়কাল জুড়ে দেখা যায় প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গোলাবারুদের উপর নির্ভরতা। এতে ফায়ারপাওয়ার বা কামান, মেশিনগানের মতো অস্ত্র ব্যবহার করে দূর থেকে শত্রুকে ধ্বংস করা হতো। সৈন্যরা ট্রেঞ্চ বা খন্দকে লুকিয়ে যুদ্ধ করত। এই যুদ্ধগুলো অনেক সময় স্থবির ও দীর্ঘস্থায়ী হতো এবং এতে হতাহত বেশি হতো। যেমন- প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের যুদ্ধের উদাহরণ।
(গ) তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধ (3rd Generation Warfare):
তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধকে বলা হয় ‘চলনভিত্তিক যুদ্ধ’ (Maneuver Warfare)। এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল গতি ও পরিকল্পনা দিয়ে শত্রুর ঘাড়ে এসে পড়া, তাকে ঘিরে ফেলা। ফ্রন্টাল অ্যাটাকের বদলে পাশ থেকে আক্রমণ করা, বুদ্ধি দিয়ে যুদ্ধ জয় করাই ছিল কৌশল। ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, প্যারাট্রুপার এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত এলাকা দখল করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ব্লিটজক্রিগ (Blitzkrieg) বা বিদ্যুৎগতির হামলা ছিল এই কৌশলের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
(ঘ) চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ (4th Generation Warfare):
চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ অনেকটাই ভিন্ন ধরনের। এটি আর শুধু রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের যুদ্ধ নয়; বরং এখন যুদ্ধ হয় রাষ্ট্র বনাম বিদ্রোহী গোষ্ঠী, গেরিলা দল কিংবা সন্ত্রাসীদের মধ্যে। সরাসরি যুদ্ধের বদলে এখানে থাকে চোরাগোপ্তা হামলা, প্রচারযুদ্ধ ও ধর্মীয় বা আদর্শিক লড়াই। মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণের মন-মানসিকতা প্রভাবিত করাও এর অংশ। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে তালেবান বা মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধের দৃষ্টান্ত।
(ঙ) পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ (5th Generation Warfare):
পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ সবচেয়ে জটিল ও বিপজ্জনক। কারণ এটি চোখে দেখা যায় না। এর যুদ্ধক্ষেত্র হলো মানুষের মন এবং অস্ত্র হলো তথ্য, গুজব, ভুয়া সংবাদ, সোশ্যাল মিডিয়া, সংস্কৃতি, সিনেমা এমনকি জনপ্রিয় গানও। এখানে কেউ গুলি ছুঁড়ে না; তবুও এর মাধ্যমে মানুষের বিশ্বাস, চিন্তা ও মননকে ধ্বংস করা হয়। মানুষ নিজের ধর্ম, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়ে। এটি এমন এক যুদ্ধ, যেখানে মানুষ নিজের অজান্তেই পরাজিত হয়।
এই যুদ্ধের ভয়ংকর দিক হলো- এখানে শত্রু কারা আপনি তাদের চিনেন না; গোলাবারুদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় তথ্য, আবেগ, গল্প আর বিভ্রান্তি। অর্থাৎ আপনার চিন্তা, অনুভূতি, ও বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যুদ্ধ হচ্ছে আপনার মাথার ভিতরে। যেটা নোয়াম চমস্কি তার বহু বই ও বক্তৃতায় বলেছেন যে, জনগণের চিন্তা ও মতামত নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ও কর্পোরেশনগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। বিশেষ করে তার বই ‘Manufacturing Consent’ এবং ‘Necessary Illusions’ বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে, মূলধারার মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, বিনোদন শিল্প, এমনকি শিক্ষাব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে সাধারণ মানুষ নির্দিষ্ট একটি ভাবনা, মতামত বা বিশ্বাসে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
ধরুন, আপনি সকালে ঘুম থেকে উঠে ফেসবুক স্ক্রল করছেন। হঠাৎ একটি ভিডিও দেখলেন, যেখানে বলা হচ্ছে, ‘এই দেশ শেষ, এই জাতি কিছুই করতে পারবে না’। আপনি হয়তো তখন বিরক্ত হন, কোনো সময় উদ্বিগ্ন হন; কিন্তু বারবার এই ধরনের পোস্ট দেখলে একটা সময় আপনি নিজের অজান্তেই বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, আমরা আসলেই অক্ষম বা দুর্বল, আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এটাই হচ্ছে Fifth Generation Warfare এর প্রধান অস্ত্র তথা মনোবল ভেঙে দেওয়া।
এখানে খুব পরিচিত একটি গল্প বলি, এক ব্যক্তি তার কাঁধে করে একটি ছাগল নিয়ে যাচ্ছিল। তিনজন দুষ্টু লোক ঠিক করল, তারা তাকে বিভ্রান্ত করবে। প্রথমজন বলল, আপনি কাঁধে করে কুকুর নিয়ে ঘুরছেন? এটা শুনে সে পাত্তা দিল না। তবে কিছু একটা ভাবল। পথিমধ্যে দ্বিতীয়জন বলল, কালো কুকুর নিয়ে ঘুরছেন যে? তার এবার একটু সন্দেহ হলো নিজের উপর। আবার কিছুদূর যাওয়ার পর তৃতীয়জন বলল, আপনি তো মানুষকে হাসাচ্ছেন! কুকুর নিয়ে ঘুরছেন আপনি। একই কথা বারবার শুনে লোকটি নিজের চোখকেই সন্দেহ করতে লাগল এবং ছাগলটিকে কুকুর ভেবে ছেড়ে দিল।
সাইকোলজির ভাষায় এটাকে বলে Gaslighting বা মানসিক ও আবেগিক নিয়ন্ত্রণের কৌশল, যেখানে কাউকে বারবার ভুল তথ্য দিয়ে, সন্দেহ ঢুকিয়ে তার নিজের উপলব্ধি, স্মৃতি বা বিচারবোধকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এটা এমনভাবে করা হয়, যেন সে নিজেই নিজের বোধশক্তি নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করে।
সহজ করে বললে, Gaslighting হলো এমন এক মানসিক খেলা, যেখানে একজন ব্যক্তি অন্যজনকে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, সে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। নিজের বিশ্বাসকে ভুল হিসেবে গণ্য করতে থাকে। বারবার মিথ্যা কথা, অঙ্গীকার বা অভিযোগ দিয়ে তাকে বোঝানো হয় যে, সে ভুল দেখছে, ভুল মনে রাখছে অথবা অযথা চিন্তা করছে। এভাবে মিডিয়াগুলো বিভিন্ন ভুল তথ্য ও ভুল বিশ্বাস আমাদের মাঝে পুশইন করে আমাদেরকে বোকা বানাচ্ছে।
এই যুদ্ধ কীভাবে পরিচালিত হয়?
এই যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, নাটক-সিনেমা, এমনকি গানের কথাও। এসবের মাধ্যমে তৈরি হয় ভুল ধারণা, ভয়ের গল্প, বিভ্রান্তিকর বার্তা। যেগুলো বিবেককে বোকা বানিয়ে ধোঁকা দিয়ে আমাদের আবেগ অনুভূতি ও বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে।
ধরুন, একজন জনপ্রিয় নায়ক বা ইউটিউবার অথবা ইনফ্লুয়েন্সার হঠাৎ করে এমন কিছু প্রচার করল, যেটা ইতিহাস বিকৃত করে। আপনারা তাকে ভালোবাসেন এবং বিশ্বাসও করেন। তাই তার কথাও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কিন্তু আপনি জানেন না যে, সে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বার্তা ছড়াচ্ছে কিংবা তার পেছনে কারো উদ্দেশ্য আছে অথবা সে কারো দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বহুবার দেখা গেছে এই জিনিস।
ধরুন, আমেরিকায় ২০১৬ সালে নির্বাচনের সময় রাশিয়া ফেসবুকে ভুয়া পেজ খুলে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়িয়ে নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলেছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে এবং প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে। যেমন- ২০১৮ সালে ‘ছেলেধরা’ গুজবে দেশে কয়েকজন নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
এভাবেই Fifth Generation Warfare আপনাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করে, যা আপনি স্বাভাবিকভাবে কখনো করতেন না অথবা তা আপনার বিশ্বাসের পরিপন্থী এবং বিবেক বিবর্জিত বিষয়।
কীভাবে এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন?
১.ফিল্টার করতে শিখুন: ফিল্টার করা বলতে আখ যেমন মেশিনে মাড়িয়ে ছেঁকে শুধু রসটুকু গ্রহণ করা হয়, তেমনিভাবে সবকিছু ফিস্টার করুন বা ছাঁকুন। বুঝুন যে, সব খবর, পোস্ট ও ভিডিও সত্য নয়। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আমি এটা বিশ্বাস করলে কে লাভবান হবে? ধরুন, আপনি ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখলেন, যেখানে বলা হচ্ছে, এই নেতা দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে। সেটা শোনার পর মনের মধ্যে রাগ কমে, কিন্তু আপনি কি জানেন ভিডিওটির উৎস কী? এটা সত্যি ঘটনা নাকি কোনো পক্ষের অ্যাজেন্ডা? যাচাই করুন, ভাবুন, তারপর বিশ্বাস করুন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোনো ফাসেক্ব (পাপাচারী) তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও। এ আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো ক্বওমকে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে’ (আল-হুজুরাত, ৪৯/৬)।
২.কিছু সময় নিজের ভিতরে ফিরে যান: প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ বন্ধ রাখুন। একা থাকুন, নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি কে? আমি কী হতে চাই? আমি কী বিশ্বাস করি? আমি কোথায় যাব? আমার উদ্দেশ্য কী? আমি কেন এখন এখানে?
আপনাকে দার্শনিক হতে হবে, তা বলছি না। তবে নিজেকে চিনুন, জানুন। আপনার মধ্য থেকে আপনাকে খুঁজে আনুন। আর মন কী বলছে, সেটা বুঝার চেষ্টা করুন।
সেই সুরটা বুঝার চেষ্টা করুন, যে সুর আপনি জন্মের সময় পেয়েছিলেন, যে সুর আপনার সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আসছে, যে সুরে আছে বিশ্বাস, গন্তব্যের প্রতি এক অদৃশ্য টান আর অনাবিল প্রশান্তি। এই সুর আপনাকে শোনানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে আপনার পরমাত্মা।
এরপর জানুন, নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে। আপনার সীমাবদ্ধতা কোথায় খুঁজে বের করুন। আপনার সোশ্যাল কমিটমেন্ট বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে চিন্তা করুন। আল্লাহর নেয়ামত অসহায় ও গরীব-মিসকীনদের মাঝে বণ্টন করার অসীলা হিসেবে আপনাকে নির্বাচন করে পর্যাপ্ত অর্থসম্পদের মালিক বানানো হয়েছে। তাতে আপনি কতটুকু শুকরিয়া আদায় করেছেন? অন্যান্য সামাজিক দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পেরেছেন আর কতটুকু ব্যর্থ হয়েছেন?
দেখুন, আপনি কতটুকু আবেগ কন্ট্রোল করতে পারেন? আপনার নীতি-নৈতিকতা ও বিশ্বাসের উপর কতটুকু দৃঢ় থাকতে পারেন? আপনি হয়তো প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস এর ‘Know Thyself’ বা ‘নিজেকে জানো’ উক্তিটি অনেকবার শুনেছেন অথবা ইমাম গাযালীর এই বাণীটি পড়েছেন, নিজেকে বিচার (মুহাসাবা) না করলে তাযকিয়া সম্ভব নয়। সমাজ বদলাতে হলে আগে নিজেকে বদলান।
৩.ভালো মানুষের সান্নিধ্যে থাকুন এবং ভালো পরিবেশে থাকুন: যারা সবসময় হতাশা ছড়ায়, নেতিবাচকতা ছড়ায়, তাদের এড়িয়ে চলুন। ধরুন, আপনাকে কেউ সবসময় বলে, এই দেশ কখনো ভালো হবে না। সে নিজেই বিশ্বাস হারিয়েছে, এখন আপনাকেও নিচে টানছে। এমন মানুষের বদলে নিজেকে ঘিরে রাখুন এমন কাউকে দিয়ে, যারা গঠনমূলক ও ইতিবাচক চিন্তা করে এবং ইতিবাচক কাজ করে। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের অনুসারী হয়। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে’।[1]
এই হাদীছ থেকে আমরা বুঝতে পারি, আমরা যার সঙ্গে চলছি, তার প্রভাব আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসে পড়ে। আজকের ফিফথ জেনারেশন ওয়ারফেয়ার-এ যদি আমরা ভ্রান্ত ও বিভ্রান্ত সঙ্গের মধ্যে থাকি, তাহলে আমাদেরও সেই মতবাদে ডুবে যাওয়া নিশ্চিত।
৪.হাতে-কলমে কিছু করতে শিখুন: নিজের হাতে কাজ করার অভ্যাস শুধু দারুণ আত্মতৃপ্তির উৎস নয়, বরং এটি আত্মনির্ভরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। এই যুগে যখন আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ডিজিটাল নির্ভরতা বাড়ছে, তখন হাতে-কলমে কিছু করতে পারা এক ধরনের শক্তি। ধরুন, আপনি নিজ হাতে নিজের ছাদের টবে সবজি চাষ করতে জানেন কিংবা ছোটখাটো মেরামতের কাজ নিজেই করতে পারেন, তাহলে আপনি যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন।
৪.হাতে-কলমে কিছু করতে শিখুন: নিজের হাতে কাজ করার অভ্যাস শুধু দারুণ আত্মতৃপ্তির উৎস নয়, বরং এটি আত্মনির্ভরতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। এই যুগে যখন আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ডিজিটাল নির্ভরতা বাড়ছে, তখন হাতে-কলমে কিছু করতে পারা এক ধরনের শক্তি। ধরুন, আপনি নিজ হাতে নিজের ছাদের টবে সবজি চাষ করতে জানেন কিংবা ছোটখাটো মেরামতের কাজ নিজেই করতে পারেন, তাহলে আপনি যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন।
আধুনিক সময়ে বাজারে যেসব খাবার পাওয়া যাচ্ছে, তার বড় একটি অংশই অস্বাস্থ্যকর। হাইব্রিড বীজ, রাসায়নিক সার, ফরমালিন ও বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদানে ভরা খাদ্যপণ্য আমাদের শরীরে নীরবে ক্ষতি করছে। এর প্রভাবে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি ও হৃদরোগের হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। কিন্তু যারা নিজে খাবার উৎপাদন করতে জানেন, তারা অন্তত জানেন যে, তারা কী খাচ্ছেন। ইসলাম এই আত্মনির্ভরতার ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে কাজ করতেন। মিক্বদাম রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিজের হাতের উপার্জন থেকে উত্তম খাবার কেউ কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাঊদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতের উপার্জন থেকে খেতেন’।[2] তাঁর ছাহাবীরা অনেকেই নিজ হাতে খেজুরবাগান করতেন, ইট টানতেন। যেমনটি আমরা দেখি মসজিদে নববী নির্মাণের সময় রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মাটি টানছিলেন। এতে বুঝা যায়, সম্মানজনক কাজ মানে শুধু অফিসে বসে কাজ নয়; বরং হাল চাষ করা, কাঠ কাটা, দর্জির কাজ করা কিংবা নির্মাণশ্রমিক হওয়াও সম্মানের। ইবনু খালদুন তার প্রসিদ্ধ ‘মুক্বাদ্দিমা’-তে লিখেছেন, শ্রম হলো সভ্যতার ভিত্তি। শ্রম না থাকলে জ্ঞান ও অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। তাই কেবল পড়ালেখা বা ডিজিটাল দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, হাতে কাজ করার অভ্যাসও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানে ‘গ্রিন লাইফস্টাইল’, ‘আরবান ফার্মিং’, ‘সাস্টেইনেবল লিভিং’ ইত্যাদি নিয়ে শহরাঞ্চলে অনেক আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু ইসলাম বহু আগেই আমাদের শিখিয়েছে, আল্লাহর দেওয়া প্রকৃতি ও ফিত্বরাতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবনযাপন করাই মানুষের প্রকৃত শান্তির পথ। নিজের হাতে তৈরি করা খাবার, নিজের হাতে বানানো জিনিস এগুলো শুধু শরীর নয়, মনকেও সুস্থ রাখে। এটি আত্মবিশ্বাস তৈরি করে, পরিবারে প্রশান্তি আনে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের পথ তৈরি করে।
৫.বই পড়ুন, বিশেষ করে কুরআন, হাদীছ ও ইসলামের ইতিহাস: যদি আপনি সারাদিন শুধু সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতে থাকেন, তাহলে আপনার চিন্তার ক্ষমতা ধীরে ধীরে অন্যদের হাতে চলে যাবে। আপনি যা দেখছেন, তাই বিশ্বাস করতে শিখবেন; কিন্তু বই পড়লে আপনি ভাবতে শিখবেন। নিজেকে নিয়ে, সমাজকে নিয়ে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ তৈরি হবে। আর এই চিন্তার সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে কুরআন ও হাদীছ।
কুরআন মানুষকে চিন্তা করতে শেখায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কি চিন্তা করো না?’ এই প্রশ্নটি কুরআনে বহুবার এসেছে। মূসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের অন্যায় ক্ষমতার বিরুদ্ধে কীভাবে সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন, ইউসুফ আলাইহিস সালাম কীভাবে কারাগারের অন্ধকারে থেকেও সত্য ও ন্যায়ের দাওয়াত দিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে গোটা সমাজের চিন্তার ধারা বদলে দিয়েছেন— এসব গল্প শুধু-কাহিনি নয়, এগুলো জীবনের জন্য পথনির্দেশনা।
এছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে অনেক মহামানব আছেন। যেমন- উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু, যিনি খেলাফতের সময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অপরাজেয় বীর খালেদ ইবনে ওয়ালীদ রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর বীর বিক্রমে যুদ্ধের কাহিনি। ছালাহউদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুল্লাহ, যিনি জেরুযালেম বিজয় করেছিলেন। ইমাম গাযালী, ইবনু তায়মিয়্যাহ ও ইবনু খালদুন রাহিমাহুমুল্লাহ-এর মতো মনীষীরা জ্ঞানচর্চা এবং আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পুরো সমাজের চিন্তা ও জ্ঞানের কাঠামো গড়ে দিয়েছেন। তাদের লেখা বইগুলো আজও মানুষকে সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশনা দেয়। ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, জ্ঞান একটি আলো, যা আল্লাহ যার অন্তরে চান, তাকে দেন। তাই যদি আপনি সত্যিকারের স্বাধীন চিন্তা করতে চান, নিজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ ধরে রাখতে চান, তাহলে বই পড়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। বই-ই পারে আপনাকে ভেতর থেকে গড়ে তুলতে।
৬.নিজের জীবনের গল্প নিজেই লিখুন: আপনার জীবনের নিয়ন্ত্রণ যেন কখনোই অন্য কারও হাতে না যায়। আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিপদ হলো মানুষ নিজের সিদ্ধান্ত নিজের জন্য নিচ্ছে ভেবে খুশি থাকে; অথচ তার বিশ্বাস, লক্ষ্য ও স্বপ্ন অনেক আগেই অন্য কারো হাতে প্রোগ্রাম হয়ে গেছে মিডিয়া, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর মাধ্যমে।
ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিটি মানুষই আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন খলীফা বা প্রতিনিধি, যে নিজের জীবন ও আমানতের জন্য দায়বদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের কাজ আমরা তার গ্রীবায় বেঁধে দিয়েছি’ (আল-ইসরা, ১৭/১৩)। হাদীছে আছে যে, তাক্বদীর নির্ধারিত। তার মানে এই নয় যে, অন্যজনের কাছে আপনার ভাগ্যের চাবিকাঠি দিয়ে দিবেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে’ (আর-রা‘দ, ১৩/১১)। এবার ভাবুন, আপনি কী করবেন? আপনার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ অন্যজনের হাতে দিবেন কি-না?
আরও সহজ করে বললে, আপনার জীবন কেমন হবে, তার দায়িত্ব আপনার নিজের। আপনি যদি আপনার লক্ষ্য লিখে রাখেন, প্রতিদিন নিজেকে নিজের উদ্দেশ্য মনে করিয়ে দেন, তাহলে দুনিয়ার বিভ্রান্তি আপনাকে সহজে টলাতে পারবে না।
মনোবিজ্ঞানে একে বলা হয় Self-Authoring অর্থাৎ নিজের জীবনের গল্প নিজে পরিকল্পনা ও লিখে ফেলার প্রক্রিয়া। গবেষণা বলে, যারা নিজেদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য স্পষ্ট করে লেখে এবং তদনুযায়ী পরিকল্পনা করে চলে, তারা মানসিকভাবে স্থিতিশীল থাকে এবং বড় ধরনের বিভ্রান্তি বা চাপ সামলাতে পারে।
ইতিহাসে আমরা দেখি, ছালাহউদ্দীন আইয়ূবী রাহিমাহুল্লাহ ছোটবেলায় মুসলিম ভূমি মুক্ত করার স্বপ্ন লিখে রেখেছিলেন এবং সারাজীবন সেই লক্ষ্য পূরণে কাজ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ ব্যবসায়ী হয়েও নিজের ইলম অর্জনের লক্ষ্যে এত দৃঢ় ছিলেন যে, শত শত বছর ধরে তার ফিক্বহ সারাবিশ্বে সমাদৃত।
রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও জীবনের প্রতিটি ধাপের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করেছেন—ইসলামের দাওয়াত, হিজরতের পরিকল্পনা, মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সবই ছিল লক্ষ্যভিত্তিক ও আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী।
নিজের জীবনের গল্প নিজে লিখতে গেলে তিনটি জিনিস জরুরী—
(ক) স্পষ্ট উদ্দেশ্য: আপনি কেন বেঁচে আছেন, তা জানা।
(খ) লক্ষ্যের সাথে আমল: শুধু স্বপ্ন নয়, প্রতিদিনের কাজে সেই লক্ষ্য প্রতিফলিত হওয়া।
(গ) আত্মসমালোচনা (Muhasaba): নিজের কাজের ভুলত্রুটি পর্যালোচনা করা এবং ঠিক করা।
যদি আপনি আপনার লক্ষ্য না ঠিক করেন, তবে নিশ্চিত থাকুন, কেউ না কেউ আপনার জন্য সেটা ঠিক করে দেবে আর তখন আপনি আপনার নিজের গল্পের প্রধান চরিত্র না হয়ে এক্সট্রা চরিত্রে পরিণত হবেন।
৭.আপনি যাদের গল্প দেখেন বা যাদের ভালো লাগে, তারা যেন আপনার চরিত্র গঠনে সহায়ক হয়: ধরুন, আপনি যদি সবসময় এমন সিরিজ, দেখেন যেখানে হিরো হচ্ছে একজন ঠক, লোভী, খুনি বা প্রতারক অথবা কোনো নায়িকা তথা মেয়ের পিছনে ছুটে; তাহলে আপনি নিজের অজান্তেই সেই আচরণগুলোকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করবেন। তখন আপনি ভাববেন, সবাই তো এমনই করে এবং নিজের ক্ষেত্রেও এটা স্বাভাবিক বলে ধরে নিবেন। স্পাইডারম্যান, হাল্ক, থর ইত্যাদি অবাস্তব চরিত্রের উপর কেন আকৃষ্ট হন? এরকম চরিত্রগুলো কি নিজের জীবনে বা সামাজিক জীবনে আপনার কোনো উপকার করেছে? নাকি এই চরিত্রে চরিত্রবান হয়ে কারো কোনো উপকার করতে পেরেছেন? তাহলে কেন দেখবেন এসব চরিত্র বা কেন আকৃষ্ট হবেন এসব অবাস্তব কিছুতে? এটাই ভয়ংকর। তার বদলে এমন চরিত্র খুঁজুন, যাদের জীবন আপনাকে অনুপ্রাণিত করে।
শেষ কথা:
পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ হচ্ছে এমন একটি যুদ্ধ, যা আপনি দেখতে পান না; কিন্তু প্রতিদিন আপনার মনন, চিন্তা, আত্মবিশ্বাস সবকিছুকে গ্রাস করে নেয়। এই যুদ্ধের শিকার আপনি, আমি, আমরা সবাই। কিন্তু আপনি চাইলে এই যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে পারেন। সে জন্য দরকার সচেতনতা, জ্ঞান, সাহস ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। শেষে এই বার্তাগুলো মনে রাখুন—
(ক) তথ্য যাচাই করুন: বিশ্বাস করার আগে প্রশ্ন করুন, কে লাভবান হচ্ছে?
(খ) নীরবতা চর্চা করুন এবং নিজেকে চিনুন: প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা প্রযুক্তিমুক্ত সময় কাটান।
(গ) নিজেকে বুঝার চেষ্টা করুন: ভুল স্বীকার করে উন্নতির পথ ধরুন।
(ঘ) ভালো সঙ্গ ও ভালো পরিবেশ বেছে নিন: বিভ্রান্তিকর, নেগেটিভ মাইন্ডের মানুষের সঙ্গ ত্যাগ করুন।
(ঙ) পাঠাভ্যাস গড়ে তুলুন: কুরআন, হাদীছ, ইতিহাস ও সাহসী মানুষদের জীবনী পড়ুন। যেকোনো নতুন সৃজনশীল জ্ঞান আহরণ করুন, কর্মমুখী জ্ঞান অর্জন করুন।
এখন তাহলে কী করবেন? জেগে উঠুন, ভাবুন আর নিজের চিন্তাশক্তিকে আপনার সবচেয়ে বড় অস্ত্র বানান। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমীন!
সাঈদ আল মাহমুদ
এমএ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; প্রভোস্ট ও চিফ অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটিভ অফিসার, মুসলিম ইউনিভার্সিটি;
শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ, ডাঙ্গীপাড়া, পবা, রাজশাহী।
[1]. আবূ দাঊদ, হা/৪৮৩৩।
[2]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৭২।
